পেরিক্লেস ছিলেন একজন গ্রীক রাষ্ট্রনায়ক, প্রাচীন গ্রিক গণতন্ত্রকে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। পেরিক্লেস নিয়ে অমর ব্রিটিশ নাট্যকার শেক্সপিয়ার নাটক লিখেন। নাটকের দ্বিতীয় অংকে অসাধারণ সংলাপ ছিল।
১ম জেলে: কর্তা! মাছ পানিতে কিভাবে বাঁচে?
বড় জেলে: কেন? বড়রা ছোটদের গিলে খায়।
তৎকালীন সামন্তবাদী ধনবাদী সমাজের চিত্র ছিল ওটা, সাধারণ নাগরিকরা রাষ্ট্রের ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে। ধনীরা রাষ্ট্রের সবকিছু ভোগ করতো! এটা আসলে বিগত ২৫০০ বছরের একই চিত্র। গরিবদের দুর্দশার ও শোষণের কাহিনি কমবেশি একই রয়ে গিয়েছে।
করোনার ধাক্কা শেষ হতে না হতেই রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় বড় ক্রাইসিস তৈরি করেছে। সেই ক্রাইসিস তাবৎ বিশ্বের ছোট–বড় সব দেশকেই প্রভাবিত করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ২০ বছর মহামন্দায় ভুগেছিল অর্থনীতিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় অর্থনীতি সচল হতে ১৫ বছর লেগেছিল।
এই ধরনের অর্থনৈতিক মন্দায়ও কিছু বিত্তবানদের সম্পদ বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বিশ্বব্যাপী ১০০ টিরও বেশি কোম্পানি ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশও মুনাফা করেছে। অতিরিক্ত মুনাফাকারী কোম্পানিগুলো তথ্যপ্রযুক্তি, ই–কমার্স, ঔষধ ও ভ্যাকসিন প্রস্তুত এর সাথে সম্পর্কিত। আমাজন, অ্যাপল, মাইক্রোসফট, টেনসেন্ট, পেপলসহ বহু ঔষধ ও ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। দুর্ভাগ্যক্রমে বড় কোম্পানিগুলো সব বিদেশের। বিশ্বব্যাপী যে সমস্ত কোম্পানি ২০০ থেকে ৪০০ গুন সম্পদ বৃদ্ধি করেছে তার মধ্যে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির আমাজন, অ্যাপল, মাইক্রোসফট, গাড়ি নির্মাতা টেসলা, অনলাইন গেমিং এর টেনসেন্ট, অনলাইন পেমেন্ট এর পে–পল ইত্যাদি। আমাদের দেশেও কিছু বড়লোকের সম্পদ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে করোনাকালীন সময়েও।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে যে হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ও বর্তমানে হচ্ছে তাতে ২০২১ সালের মধ্যে অতি দরিদ্রমুক্ত হওয়ার কথা ছিল এবং ২০৪১ সালে অর্থাৎ ২০ বছর পরে উচ্চমধ্যবিত্ত দেশে পরিণত হওয়ার প্রজেকশন রয়েছে। কিন্তু করোনা ও তৎপরবর্তী যুদ্ধ সব হিসেব ওলট–পালট করে দিয়েছে। যেমন ৭৫ কোটি মানুষ অতিদরিদ্র হয়ে পূর্বের সংখ্যার সাথে যুক্ত হয়েছে হয়েছে। এদের দৈনিক আয় বাংলাদেশি টাকায় বর্তমান ডলার মূল্যে ১৮০ টাকার মতো।
কমপক্ষে চারজনের সংসার হলে জনপ্রতি খরচ ৪৫ টাকা। আবার দৈনিক গড় আয় ১৮০ টাকা হলেও এই হতদরিদ্ররা ৩৬৫ দিনের অর্ধেক বা তারও কম সময় কাজ পায়। এটাই সাধারণ মানুষের জন্য অর্থনীতি বোঝার সহজ উপায়। জিডিপি বর্তমানে অর্থনীতিতে একটি পুরাতন ধারণা রূপে বিবেচিত হয়। কারণ যে বড় লোকের গড় আয় ৫০ কোটি টাকা তার সাথে ১৮০ টাকা গড় করা কোন হিসাবের কাজ হয় না। যেমন জার্মানির প্রবৃদ্ধি ২% এর নিচে, ইথোপিয়ার প্রবৃদ্ধি ১৫% এর উপরে, দুটো দেশ সমান হল? এজন্য বর্তমানে জিডিপি ব্যবহার না করে MPI বা multi-dimensional proverty index ব্যবহার করা হয়।
একটা মানুষের খাওয়া–দাওয়া ছাড়াও সন্তান–সন্ততির শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেবায় খরচ, বিনোদনের খরচ ইত্যাদিরও প্রয়োজন হয়। আপনারা আয়ে যদি উল্লেখিত খরচগুলো ন্যূনতমভাবেও মেটাতে না পারেন তাহলে আপনি দরিদ্র। এজন্যই এই হিসাবটা উল্লেখ করা হয়। যেমন বর্তমান বিশ্ব গড় আয় ২৯২০ ডলার। কিন্তু বিশ্বের ৩৫০ কোটি মানুষ এই গড়ের অর্ধেকেরও কম দিয়ে এক মাস নয় বারো মাস অতিবাহিত করে। এখানেই আসলে বিশ্বব্যাপী মানুষে মানুষে বৈষম্যের চরম প্রকাশটা দৃশ্যমান হয়।
ভারতে ৩০ কোটি মানুষ দৈব বিপদ–যেমন অপারেশন, ক্যান্সার চিকিৎসা, মেয়ের বিয়ে, ছেলের পড়া বাবদ যে ঋণ করে তা জীবনেও শোধ করতে পারে না। ৬% মানুষ অর্থাৎ ৮ কোটি মানুষ পৈতৃক জমি যেটা বিক্রি করতে হয় দেনা শোধে।
বাংলাদেশের কোন তথ্য আমার কাছে নেই, আর্থসামাজিক অবস্থার নৈকট্যের কারণে আমাদের দেশের চিত্র ও ঐরকমই হওয়ার কথা। আমাদের দেশের সামগ্রিক উন্নতি দৃশ্যমান তাও কেউই অস্বীকার করবে না। কিন্তু আর্থসামাজিক অবস্থা যে একটা ডায়নামিক এবং তা নিত্য পরিবর্তনশীল তার প্রেক্ষিত মোকাবেলা একটা কঠিন কাজ। সরকারের প্রচেষ্টায় কমতি নেই, মানুষের সমাজের চাহিদার ও কমতি নেই। সরকারের অনেকগুলো সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প আছে। (ছাত্রী বৃত্তি, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা ইত্যাদি) এসব প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদী সুফল cost-effective কিনা তা ভবিষ্যতেই বলবে। যেটা অতি প্রয়োজন তা হচ্ছে মানুষের কর্মসংস্থান–সরকারি হউক বেসরকারি হউক। তারপরে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বেশি বিনিয়োগ যার সুফল যেন টার্গেট গ্রুপরা পায়। বছরে ২০ লাখ নতুন শিক্ষিত মানুষ কর্ম বাজারে প্রবেশ করে। তাদের জন্য তো কাজ নেই, মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে আশায় বুক বেঁধে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় তারা প্রবাসে ব্যয় করে। দুই চারজন আর্থিকভাবে সফল হয় স্থায়ীভাবে। বেশিরভাগই ২০ থেকে ২৫ বছর পর দেশে ফিরে অসুস্থ হয়। চিকিৎসার টাকা মেলে না, সন্তানের কর্মসংস্থান নেই, বিয়ের খরচ এর জন্য ঋণ অর্থাৎ দারিদ্রচক্রের বৃত্তে পুরুষানুক্রমে বসবাস। বলা হচ্ছে মানুষের আয় বেড়েছে। কিন্তু ব্যয় তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে মানুষের দৈন্য বাড়ছে। অর্থনীতিবিদরা অর্থনীতি বিশ্লেষণ করেন, বিকল্প বাজেট দেন, কিন্তু তৃণমূলের মানুষের অর্থনীতি ভালো যাচ্ছে না। ফকির শাহাবুদ্দিন একজন লোকজগানের শিল্পী। এই শিল্পীর একটা গান আছে –আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম–সেই গানের শেষের কয়েকটি লাইন–
করি ভাবনা
সেদিন আর পাবনা
দিন হতে দিন।
আসলে কঠিন,
গরিব দীনহীন
কোন পথে যাইতাম
বড়লোকদের বিনোদন, স্বাস্থ্য সেবা, জিডিপি, মেগা প্রকল্প, স্কাই লাইন সবই দৃশ্যমান। কিন্তু শতাব্দীর সেই বৈষম্য এখন আরও প্রকট! শেক্সপিয়ার বেঁচে থাকলে হয়তো নতুন ডায়লগ লিখতেন: বড়রা ছোটদের আর কতকাল গিলে খাবে?
লেখক : চিকিৎসক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট












