আমরা কখনও ভুলব না

কাজী রুনু বিলকিস | সোমবার , ৩০ মে, ২০২২ at ৮:৫৫ পূর্বাহ্ণ

 

 

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা। একুশে ফেব্রুয়াারি বাঙালির চেতনার প্রতীক এবং বাঙালি স্বাধীনতার লক্ষে পৌঁছানোর প্রথম আলোকবর্তিকা। আর একুশের যে গানটি ৭০ দশকের ও বেশি আমাদের চেতনায় আলো জ্বেলে রেখেছে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটির রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী। অন্তত এই গানটির জন্য তিনি বঙালিদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। যতদিন বাঙালি জাতি টিকে থাকবে, একুশের প্রভাতফেরি হবে ততদিন তিনি থাকবেন বাঙালির হৃদয় জুড়ে। তিনি ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন, পরবর্তীতে বাঙালির যতগুলো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুতেই তাঁর অসামান্য অবদান ছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখছেন, ‘২২শে ফেব্রুয়ারী পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হয়ে কিছুদিন এখানে ওখানে থাকার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হই। কারণ ব্যাথা অসহ্য হয়ে উঠেছিল। গোড়ালি ফুলে উঠেছিল। হাঁটতে পারতাম না। একমাস ছিলাম হাসপাতালে।’ ১৯৫৫ সালে শহীদ দিবস পালন করতে গিয়ে আবারও পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। ভাষা আন্দোলনের সাথে যখন যুক্ত হন তখন তিনি কলেজের গন্ডিও পার হননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের মুখপত্র একমাত্র পত্রিকা জয় বাংলা তিনি সম্পাদনা করতেন, পাশাপাশি লিখতেন অসাধারণ কলাম। যুদ্ধের মাঠে গিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যুগিয়েছেন, ক্যাম্পে মডারেটর হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের সংগ্রামমুখর গৌরবদীপ্ত ইতিহাসের সাক্ষী শুধু নন তিনি একজন যোদ্ধাও বটে। ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে আমরা তাঁকে দেখতে পাই সক্রিয় প্রগতিশীল লেখক ও ইতিহাসের পর্যবেক্ষক হিসেবে। পাঠকের প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা ছিল তাঁর লেখার অনুপ্রেরণা। তিনি খুব স্পষ্টভাষী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ, দুর্নীতি তাছাড়া বাংলাদেশের সবরকম উত্থান পতনকে তিনি তাঁর লেখার বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। প্রবাসে থেকেও তাঁর গভীর, সুতীক্ষ্ম দৃষ্টি ছিল দেশের প্রতি। অসংগতি দেখলেই কলম ধরেছেন শক্ত হাতে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এখন লেখার মানুষের অভাব নেই। সরকারকে খুশি করে নানা সুযোগ সুবিধা আদায় করার বহু মুখোশধারী বুদ্ধিজীবীকে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ই অগাস্টের পর অনেককে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

যে সময় বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা অপরাধ বলে গণ্য হতো সেই সময়ে তিনিই কলম ধরেছিলেন। শেষ পর্যন্তও তিনি তাঁর কমিটমেন্টের জায়গা থেকে সরে আসেননি। তিনি দেশকে ভালোবাসতেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতেন। অসামপ্রদায়িক সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। তাই বলে মুক্তিযুদ্ধের দাবীদার সরকারকে তিনি ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি সরকারের কড়া সমালোচনা করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ নয়। এরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে না। বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির মূলধন হিসেবে ব্যবহার করে। এখানেই আওয়ামী লীগের পদস্খলন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর শাসকদের বাঙালিদের উপর যে নিপীড়ন, শোষণ ও নির্যাতনের সাক্ষী এবং আন্দোলন সংগ্রামে সম্পৃক্ত যে বয়োজ্যেষ্ঠ জনগোষ্ঠী তাঁরা এখনও আওয়ামী লীগের প্রতি একধরনের সহানুভূতিশীল। শুধুমাত্র অন্যদল ক্ষমতায় আসলে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে দিতে চায় বলে। এই সরকার সুশাসন দিতে পারছে না, নির্বাচনীব্যবস্থা প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারছে না এসব বিষয়গুলো তাঁর লেখায় বারবার এসেছে। গাফ্‌ফার চৌধুরীকে হারিয়ে আমরা একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক মানুষকে হারালাম। গাফ্‌ফার চৌধুরী সাহিত্যেও অবদান রেখেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩০টি। তারমধ্যে আছে, ‘ভয়ংকরের হাতছানি,’ ‘সম্রাটের ছবি,’ ‘ডানপিটে শওকত,’ চন্দ্রদীপের উপাখ্যান , ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’, ‘শেষ রজনীর চাঁদ’ ও ‘কৃষ্ণপক্ষ’।

তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে। বাবা ওয়াহিদ রেজা ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলার আইনসভার সদস্য ছিলেন। তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় স্থানীয় মাদ্রসা এবং হাইস্কুলে। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৪ সালে লন্ডনে তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য গেলে ৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘদিন তাঁকে দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি। সামরিক শাসক নিষিদ্ধ করেছিল তাঁর লেখা । পরবর্তীতে পরিবার নিয়ে তিনি লন্ডনে স্থায়ী হয়েছিলেন। গাফ্‌ফার চৌধুরীর চার মেয়ে ও এক ছেলে। তার মেয়ে বিনীতা চৌধুরী গত ১৩ এপ্রিল মৃত্যু বরণ করেন। হাসপাতালে বসেই মেয়ের শোকাবহ সংবাদ পান। বিনীতা চৌধুরী লন্ডনে বাবার সাথে থাকতেন। সন্তান হারানোর শোক অসুস্থ শরীরে আর হয়তো নিতে পারেননি। গত ১৯ শে মে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে নানা জটিল অসুখে ভুগছিলেন। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কার এছাড়া রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারেও ভূষিত হন। আমরা বেড়ে উঠেছি একুশের প্রভাত ফেরিতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গান গেয়ে। আবদুল গাফফার চৌধুরীকে চেনার আগেই তাঁর অমর সৃষ্টির সাথে আমাদের পরিচয়! এমন দেশপ্রেমিক মানুষটাকে আমরা কখনও ভুলব না। বিনম্র শ্রদ্ধা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধব্রাজিল