ইউরোপ ও রুশ–ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মানুষের উদ্বেগ উৎকন্ঠা বিশেষত আমাদের দেশে পত্র পত্রিকায় নানা বক্তব্য এবং দৈনিক আজাদীর পাতায় বিজ্ঞ কলামিষ্টদের লেখাগুলো পড়ে সামগ্রিকভাবে ইউরোপের যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং এর মূল কারণ ও দিবালোকের মত স্পষ্ট অথচ অনালোচিত কিছু বিষয় নিয়ে লিখার নৈতিক দায় অনুভব করছি। এসব লেখা পড়ে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানে গণহত্যা ও দখলদারিত্বে সরাসরি অংশগ্রহণকারী “ন্যাটোই” হল ইউরোপে এ মুহুর্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতার একমাত্র রক্ষাকবচ এবং ইতোমধ্যে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদান যথার্থ হয়েছে এবং তাতে তাঁদের কথামত ইউরোপের “সব অশান্তির” মূল কারণ পুতিন ও রাশিয়াকে রুখে দেয়া যাবে।
১৯৪৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ও বৃট্রেন এবং ফ্রান্স এর সহযোগিতা ও সমর্থনে সদ্য সমাপ্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউরোপকে সামরিকায়নের অংশ হিসাবে কমিউনিষ্ট বিরোধী যুদ্ধজোট ন্যাটো গঠন করে ঠান্ডা বা স্নায়ু যুদ্ধের সূচনা করা হয়। পূর্ব ইউরোপ তখন সোভিয়েত বলয়ে। ইউক্রেন ও বেলারুশ এর আগে থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভুক্ত ছিল। ভৌগলিক দিক থেকে ইউরোপ মহাদেশের দুই তৃতীয়াংশই ছিল তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অধীনে। ক্রমাগত মার্কিন হুমকির মুখে বাধ্য হয়ে ১৯৫৫ সনে এসে সোভিয়েত রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ মিলে গঠন করে পাল্টা কমিউনিষ্ট যুদ্ধ জোট “ওয়ারশ”। একইসময়ে কমিউনিজম ঠেকানোর নামে মার্কিন নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ায় সেন্টো এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় দক্ষিণ পূর্ব এশীয় যুদ্ধ জোট বা সিয়াটো গঠন করা হয়। পাকিস্তানের অংশ হিসাবে তখন আমরা এই দুই যুদ্ধ জোটের সদস্য ছিলাম। নেহেরু নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারত মার্কিন চাপ সত্ত্বেও জোট নিরপেক্ষ ছিল। পাকিস্তান আমলে আমাদের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ঐতিহাসিক কর্মসূচি ১১ দফায় ঐ দুই যুদ্ধ জোটের বাইরে থাকার দাবী ছিল। আর পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের জন্ম এবং ইরানের বিপ্লব ঐ দুই যুদ্ধ জোটের অপমৃত্যু ঘটায়। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের ফলে “ওয়ারশ” জোট বিলুপ্ত হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে ন্যাটোর প্রয়োজন তখন ফুরিয়ে যায়, কিন্তু ন্যাটোকে আমেরিকা টিকিয়ে রাখে। কমিউনিজম ঠেকানোর নামে পুরো সমাজতান্ত্রিক বলয়ের দেশগুলোর বিরুদ্ধে আর্থ–রাজনৈতিক অবরোধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়াকে ঠেকানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। অন্যদিকে ঐ সময় কালে আমাদের দেশসহ তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর প্রগতিকামী নেতাদের উৎখাত বা হত্যা করে সামরিক অভ্যুত্থানে সহায়তা দিয়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রবক্তা যুক্তরাষ্ট্র পুরো পৃথিবীতে পুলিশি ভূমিকা পালন করেছে। একথা এখন প্রমাণিত সত্য যে, বঙ্গবন্ধু, আলেন্দে সহ তৃতীয় বিশ্বের জনপ্রিয় নেতাদের হত্যাকান্ডে সরাসরি যুক্ত ছিল আমেরিকা। সাম্প্রতিক সময়ে ইরাকে, লিবিয়ায় আফগানিস্তানে, সিরিয়ায়, ইরানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা, বর্বরতা, গণহত্যা দুই রাষ্ট্র প্রধান সাদ্দাম ও গাদ্দাফিকে সরাসরি হত্যা এসব কিছুই কি আমাদের কলাম লেখকরা বিস্মৃত হয়ে গেলেন? রুশ–ইউক্রেন যুদ্ধ কি ইতিহাসের সব নির্মমতা, হত্যা, ধ্বংস বিভীষিকাকে ঢেকে দিল? আজ মনে পড়ছে সদ্য প্রয়াত কলামিষ্ট সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর কথা, যিনি তাঁর প্রতিটি লেখায় দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের হিংস্র আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবিমিশ্র ক্ষোভ ও ঘৃণা উগরে দিতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বরাজনীতির খলনায়ক, সুহার্তো, মার্কোস, পিনোচেট, আইয়ুব এর মতো অসংখ্য স্বৈরশাসকের জন্মদাতা, পৃথিবীর নানাপ্রান্তে সংঘটিত বর্বরতম সব হত্যাকান্ডের নায়ক, ’৭১ এর গণহত্যার প্রত্যক্ষ সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার নায়ক বলতে চান তাঁদের নিয়ে আমার কিছুই বলার নেই। তাঁদের লেখায় মনে হয় ইউক্রেনে এক অভূতপূর্ব গণহত্যা চালাচ্ছে রাশিয়া এবং এরকম আগ্রাসন যেন ইউরোপ আর পৃথিবী ইতোপূর্বে কখনো দেখেনি।
প্রশ্ন হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী কানাডা বা মেক্সিকো যদি যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী কোন যুদ্ধজোটে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিতো তাহলে কি হত? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরের দেশ ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে, শুধু এই মিথ্যা অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করে সে দেশের বৈধ প্রেসিডেন্টকে ফাঁসি দিয়ে দেশটি ধ্বংস্তুূপে পরিণত করল। পুতিন হস্তক্ষেপ না করলে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের পরিণতি এতদিনে গাদ্দাফি ও সাদ্দামের মতই হত। পানামা খাল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনার “অপরাধে” পানামার প্রেসিডেন্ট নরিয়েগাকে বেঁধে নিয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্র। দশকের পর দশক ধরে বিশ্বব্যাপী আমেরিকার এসব দূর্বৃত্তপনা আমাদের প্রিয় কলামিষ্টদের চোখে পড়ল না আর পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ, পারমাণবিক শক্তিধর বৃহৎ শক্তি রাশিয়া তার সীমান্তবর্তী দেশ, এক সময়ের একই রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত ইউক্রেনকে বৈরীযুদ্ধ জোট ন্যাটোতে নিজের নিরাপত্তার কারণে যোগ না দিতে রাজী করাতে না পেরে এবং উল্টো সেই দেশে আমেরিকার গোপন সামরিক তৎপরতা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে যখন সে দেশ আক্রমণ করল, তাই তাদের চোখে বড় হয়ে ধরা দিল। যে কোন কারণেই হোক এ আক্রমণকে অবশ্যই কেউ সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু কোন বৃহৎ শক্তি কি নিজ সীমান্তে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে? কেন “নিরীহ ইউক্রেন” ন্যাটো আর রাশিয়ার রণক্ষেত্র হতে গেল।
অনেক দিন থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে রুশ বিরোধী ইউক্রেনী জাতীয়তাবাদকে সুপরিকল্পিতভাবে উস্কে দিয়ে জনবিক্ষোভের মাধ্যমে ইউক্রেনের রুশপন্থী সরকার অপসারণ করে পুতুল সরকার বসিয়ে ইউক্রেনকে ন্যাটো ও পশ্চিমমুখী অবস্থান নিতে উৎসাহিত করে আসছে। রাশিয়া পাল্টা জবাবে ২০১৪ সালে তার সাবেক ভুখন্ড ১৯৫৬ সাল থেকে ইউক্রেনের অংশ ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। সেই থেকে পশ্চিম ইউক্রেনকে জাতীয়তাবাদী আবেগে উদ্বুদ্ধ করে জেলেনস্কি দেদার মার্কিন অস্ত্রে নিজেকে শক্তিশালী করতে থাকে, যাতে ন্যাটোতে যোগদান করলে সম্ভাব্য রুশ আক্রমণ মোকাবেলা করা যায়। গড়ে তোলে নাৎসী বাহিনীর মত উগ্র জাতীয়তাবাদী আজভ ব্যাটেলিয়ান। এসবের সূদর প্রসারী লক্ষ্য ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পর ন্যাটোর মত ব্যয়বহুল যুদ্ধ জোটের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যখন জার্মানী ফ্রান্স ও অন্যত্র জনমনে প্রশ্ন উঠছে তখন তা এড়াবার জন্য ১৯৯০ সালে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ন্যাটোকে তখন আরো পূর্ব দিকে বা রাশিয়া অভিমুখে সম্প্রসারণ করে সামরিক উত্তেজনা তৈরি করা যাতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করতে বাধ্য হয় এবং যাতে ন্যাটোর অস্তিত্ব বজায় রাখার পক্ষে ইউরোপে পুনরায় জনমত প্রবল হয়ে উঠে। এই আক্রমণের সুযোগে ব্যাপক অপপ্রচারের মাধ্যমে পুরো ইউরোপ এখন ন্যাটো যুদ্ধজোটের অংশ হতে যাচ্ছে। বস্তুত রুশ ইউক্রেন যুদ্ধ এখন রাশিয়া বনাম ন্যাটোর যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।
এখানে শুধু একটা প্রসঙ্গই আসে আর তা হল ন্যাটোর মত একটি যুদ্ধ জোটের প্রয়োজন কোথায় এবং কেন? বর্তমান পৃথিবীতে ন্যাটোই হল একমাত্র যুদ্ধ জোট যা শুধু আঞ্চলিক নয় বৈশ্বিক বা পুরো ইউরোপীয় যুদ্ধ জোটে রূপ নিচ্ছে। আমেরিকা জানে যে, পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসোবে কোন অবস্থাতেই ন্যাটো বা বাকী ইউরোপের পক্ষে রাশিয়াকে সামরিকভাবে পরাস্ত করা সম্ভব নয়, আর তা করতে চাইলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য। এখন একটাই মোক্ষম সুযোগ আমেরিকার সামনে উপস্থিত হয়েছে আর তা হল রাশিয়াকে ইউক্রেন আক্রমণে বাধ্য করে পুরো ইউরোপে যুদ্ধাবস্থা জিইয়ে রেখে দেদার অস্ত্র বিক্রির রমরমা ব্যবসা চালানো। পত্রিকান্তরে খবর বেরিয়েছে মার্কিন অস্ত্র শিল্প কমপ্লেক্স গত ৫০ বছরে এত বেশি ব্যস্ত ছিল না।
ঠান্ডাযুদ্ধের সময়ের মত আজকের রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে আদর্শগত কোন পার্থক্য নেই। দু’দেশই অবাধ বাজার ব্যবস্থার নামে মুনাফালোভী লুটেরা অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। পুতিনের বহু ঘনিষ্ঠ রুশ ব্যবসায়ী শত শত বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি পশ্চিমে পাচার করেছে। তাহলে বিরোধটা কোথায়? বিরোধ হলো ব্যবস্থাগত পুরনো ত্রুটি অর্থাৎ পুজিঁবাদের অসম বিকাশ ও লুটেরা আধিপত্যবাদী এই দুই শক্তির আভ্যন্তরীণ ও ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে রাশিয়ার সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব খর্ব করে এশিয়া ও ইউরোপে রুশ প্রভাব কমিয়ে আনা। যাতে পুতিন সিরিয়া বা ইরানের মতো আর কোথাও মার্কিন বিরোধী ভূমিকা না নিতে পারে। এছাড়াও রাশিয়ার আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধ ও ক্ষেত্র বিশেষে বিচ্ছিন্নতাবাদ উস্কে দিয়ে যতদূর সম্ভব সে দেশের বিশাল তেল ও গ্যাস সম্পদের উপর আধিপত্য বিস্তার করা। পুজিঁবাদী বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার লুটেরা চরিত্র অনিবার্যভাবে যুদ্ধের দিকে পৃথিবীকে নিয়ে যাবেই। যুদ্ধ ছাড়া পুজিঁবাদ শেষ পর্যন্ত অচল। রুশ ইউক্রেন যুদ্ধ এক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়।
আমাদের মনে রাখা দরকার পৃথিবীতে এ পর্যন্ত দু’টি বিশ্বযুদ্ধ সূচনা হয়েছে ‘সুসভ্য’ ইউরোপে, পুজিঁবাদের আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে। শান্তিপূর্ণ ইউরোপের তথা বিশ্বের মূল শর্ত হলো যুদ্ধজোট মুক্ত ইউরোপ। ইউরোপীয়ানদের নিজেদের ইউরোপকে রক্ষা করতে হবে। বৃটেন ও ফ্রান্সের হাতেও রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র। কাজেই রুশ জুজুর ভয় অর্থহীন। ইউরোপের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও শান্তির স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রকে ইউরোপ থেকে হাত গুটাতে হবে। ইউরোপের যৌথ নিরাপত্তার জন্য ন্যাটো যুদ্ধ জোট বিলুপ্ত করে ইউরোপের বৃহত্তম দেশ হিসাবে রাশিয়ার আস্থাভাজন এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা বিকল্প সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলতে হবে। ন্যাটো বিলুপ্ত হলেই কেবল ইউরোপ ইউরোপীয়দের হবে। গড়ে উঠবে শান্তিপূর্ণ ইউরোপ। রাশিয়ার একার পক্ষে ইউরোপকে পদানত করা অসম্ভব বিষয় যা তার নিজের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর হতে বাধ্য। অন্যথা ন্যাটো যুদ্ধ জোট তথা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতিতে ন্যাটো বনাম রাশিয়ার সামরিক উত্তেজনা চলতে থাকবে এবং তা অব্যাহত রাখা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ভূরাজনীতির অংশ। রুশ ইউক্রেন স্থানীয় সংঘাতকে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে চায় পুরো ইউরোপে। কাজেই ন্যাটোর বিলুপ্তিই ইউরোপ তথা বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান পূর্বশর্ত– যা নির্ভর করে শান্তিকামী ইউরোপীয় জনমতের উপর।