বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বজ্রপাতে মৃত্যু

অনুপ দাশ গুপ্ত | শুক্রবার , ২৭ মে, ২০২২ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

রাচ্যেল লুইস কারসন একজন আমেরিকান পরিবেশবিদ, সামুদ্রিক বিজ্ঞানী, লেখক এবং গবেষক। ১৯৬২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তাঁর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘নীরব বসন্ত’ বা ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ প্রকাশিত হয়। এই বহুল পঠিত এবং বিখ্যাত পরিবেশ বিজ্ঞান গ্রন্থটিতে লেখক দেখান যে, কীভাবে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও ডিডিটি ব্যবহারের ফলে আমেরিকার কৃষিতে ও প্রকৃতিতে বিপর্যয় ঘটছে এবং ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত, টর্নেডো, খরা ও ঘূর্ণিঝড় বেয়ে যাওয়ার ফলে অসংখ্য নিরীহ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে। তিনি এও দেখান যে, প্রকৃতি থেকে কীভাবে বসন্ত নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে এবং চিরহরিৎ বৃক্ষরাজির নীরব মৃত্যু ঘটছে নিয়মিত, ফলে প্রকৃতি কী রূপ বিভীষিকাময় হয়ে উঠছে! এটি একটি গবেষণা গ্রন্থ। যা তিনি প্রকাশ করেন, পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে তাঁর ১২ বছরের (১৯৫০ থেকে ১৯৬২) শ্রমসাধ্য গবেষণা কর্ম শেষ করার পর।

২০২০ সালের এপ্রিল মাসেই বজ্রপাতে ২০ দিনে ৫৭ জনের মৃত্যু হয় (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৪ এপ্রিল’২০)এবং গত বছরের ৫ আগস্ট’২১, বজ্রপাতে প্রমত্তা পদ্মানদীর পাড়ে ১৭ বর যাত্রীর করুণ মৃত্যুর খবরটা আমার মর্মে বেদনার ঝড় তোলে (সমকাল, ৫ অগাস্ট’২১)। অনেকদিন আগে পড়া টি এস এলিয়েট এর ‘দ্যা ওয়েস্ট ল্যান্ড’ বা ‘বন্ধ্যা ভূমি’-কবিতায় কবি এপ্রিল মাসকে ‘নিষ্ঠুরতম মাস’ বলেছিলেন। এলিয়েটের কথাটা আসলে মিথ্যা নয়। এপ্রিল মাসে প্রকৃতি তার নিষ্ঠুর রূপ দেখায়। কিন্ত গত ২০২০ সালের এপ্রিলের রুদ্ররূপ কয়েক শতাব্দীর সব এপ্রিলের চেয়ে ভয়ানক হয়ে এসেছিল। শুধু তাই নয় গত বছর, ২০২১ সালের আগষ্ট মাসে এসেও শ্রাবণের রুদ্ররূপ দেখতে হলো এবং এক নিমিষেই তাজা ১৭টি প্রাণ হারিয়ে গেলো বজ্রপাতে। এপ্রিল-মে তে কালবৈশাখীর কারণে বজ্রপাত বেশী হলেও, আমরা জানি মধ্য এপ্রিল থেকে বৈশাখী ঝড় শুরু হয় এবং আষাঢ়-শ্রাবণ মাস, মানে জুলাই ও মধ্য আগষ্ট পর্যন্ত বর্ষাকাল স্থায়ী হয়। এই সময় গুলোতে এক দশক আগেও বর্ষার রুদ্রমূর্তি এবং বজ্রপাতে এত মানুষের মৃত্যু হতো না। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে আজ কালবৈশাখী ঝড় ও ঘনঘোর বর্ষায় বজ্রপাতের হার বেড়ে চলেছে এবং গাছপালা তথা তুলনামূলক ভাবে বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠে তালগাছের মত উঁচু উঁচু গাছ কমে যাওয়ার ফলে, বজ্রপাতে গণ মানুষের প্রাণহানির সংখ্যাও বেড়ে চলেছে।

ডিজাস্টার ফোরাম নামক এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলেছে ‘গত ২০২০ সালের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে বজ্রপাতে দেশে কমপক্ষে ১১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ধারণা করা যেতে পারে, রেকর্ডকৃত এই সংখ্যার বাইরে আরও প্রাণহানি ঘটার কথা’। এপ্রিল’ ২০২০ এ, শুধু ২০ দিনেই যে ৫৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৪৭ জনই পুরুষ। শুধু তাই নয়, এবছরের গত এপ্রিল মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে সারাদেশ বজ্রপাতে মৃত্যু হয় ৫২ জন লোকের, (২৩এপ্রিল’২২, আজকের পত্রিকা)। তারা বজ্রপাতের সময় কৃষি জমিতে কাজ করছিলেন বা মাছ ধরছিলেন। উদ্বেগের বিষয় হলো, গত এক দশকে দেশে বজ্রপাতে মারা গেছে প্রায় একহাজার আটশত জন। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে বিপুল গবাদিপশুরও। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দেয়। বজ্রপাত প্রতিরোধে বিভিন্ন জেলায় তাল গাছ লাগানোর কথা বলা হলেও সেটা কিন্তু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, তাই তাল গাছ লাগানো গেছে ছিকাই উঠে। বাস্তবতা হলো, কৃষক ধান কাটতে যেতেই হবে। বজ্রপাতের ভয়ে তাঁর পক্ষে ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় সব ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে মুঠোফোনের টাওয়ারে লাইটেনিং এরস্টোর লাগিয়ে ঝুঁকি কমানো যায়। এ ছাড়া হাওর ও বাঁওড় এলাকায় ফসলের মাঠে নির্দিষ্ট দূরত্বের পরপর এই যন্ত্র বসালে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার অনেক কমে আসবে।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন- বজ্রপাত বেড়ে যাওযার বড় কারণ পরিবেশের বিপর্যয় ও নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন। এছাড়াও রয়েছে পশুপাখি হত্যা ও প্রকৃতির পরিছন্ন কর্মী শকুন নিধন। পরিবেশ বিপর্যয় ও প্রতিবেশের কথা আসলেই আমার মনে পড়ে যায় ভারতের বিখ্যাত লেখক অরুন্ধতী রায়ের লেখা-‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ গ্রন্থের কথা। এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়েই নিদারুণ বেদনার্ত হৃদয়ে তিনি দেখিয়েছেন ভারতে কর্পোরেট ব্যবসার লোলুপ লাভের হাতছানির টানে- কিভাবে গরু মোটাতাজা করনের ওষুধ, গরুকে খাওয়ানো ডিডোফেনাক জাতীয় ওষুধের বিষ ক্রিয়ায় শকুন মরে যাচ্ছে ও বাদুড় প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করলেও এ দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপ এখনো পর্যাপ্ত নয়। সাধারণত কিউমুলোনিন্বাস মেঘ থেকে বজ্রপাত ও বৃষ্টি হয় এই মেঘকে বজ্রগর্ভ মেঘও বলা হয়ে থাকে (গ্রন্থ: ‘বৃষ্টি ও বজ্র’, লেখক :মুহাম্মদ ইব্রাহিম, পৃষ্ঠা:৯১)। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে এপ্রিল-মে মাসে বাংলাদেশে এই বজ্রগর্ভ মেঘের পরিমাণ বেড়েছে। বজ্রগর্ভ মেঘের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ এই অঞ্চলে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। পরিবেশ দূষণের মাত্রা যত বাড়ছে, গড় তাপমাত্রাও তত বাড়ছে। ফলে বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি হওয়ার আদর্শ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর এবং জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার তথ্যের বরাতে গবেষকরা আরও জানিয়েছেন-বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ২ হাজার ৪০০-এর মতো বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো, বিশ্বে সবচেয়ে বেশী বজ্রপাতের ঘটনা ভেনেজুয়েলা ও ব্রাজিলে ঘটলেও ওই দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বেশি।

খোলা মাঠে কাজ করা, বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা না জানা এবং বজ্রপাত বিষয়ে অসচেতনতাই এত বেশি মৃত্যুর কারণ বলে মনে করেন আবহাওয়াবিদরা। সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের শিকার হন খোলা মাঠে কাজ করা কৃষক ও জেলেরা। তাল গাছের মতো উঁচু গাছপালা বজ্রকে কাছে টেনে নিয়ে ভূমিতে বজ্রপাত ঠেকিয়ে দেয়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও আবহাওয়ার ধরন বজ্রপাতের জন্য অনুকূল। এ ছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সারা বিশ্বেই বজ্রপাত বাড়ছে। তাই বজ্রপাতে মৃত্যুও বাড়ছে। বাংলাদেশে বড় গাছ, বিশেষ করে উঁচু উঁচু তাল গাছের সংখ্যা কমে যাওয়াও বজ্রপাতে মৃত্যু বৃদ্ধির একটি কারণ। কোনও বাড়িতে উঁচু তালগাছ থাকলে সেই বাড়ির মানুষ বজ্রপাতের ঝুঁকি থেকে তুলনামূলক নিরাপদ থাকে। তাল গাছ হলো বিস্তৃীর্ণ ফসলি মাঠে বজ্রপাত থেকে ক্ষতি রোধের জন্য প্রাকৃতিক নিরাপত্তা ছাউনি। সেজন্য প্রতি বছর বর্ষা ঋতুতে বিস্তৃীর্ণ ফসলি মাঠের আলপথের মাঝে মাঝে তালগাছ রোপণ করা উচিত। বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘোষণার পর ২০১৭ সালে সরকার বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে দেশব্যাপী ১০ লাখ তালগাছ লাগানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু পরের বছর ২০১৮ সালের শুরুতেই ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব জানিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তালগাছ নয়, সারা দেশে ৩১ লাখ তালের আঁটি রোপন করা হয়েছে (দেশ রূপান্তর, ৬ আগস্ট’২১)। কাজের বিনিময়ে খাদ্য বা কাবিখা কর্মসূচির অধীনে এই তালের আঁটি রোপন করা হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রাস্তার দুইপাশে। কিন্তু সেবছরই পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদনে জানা যায়, তালের আঁটি রোপণের বিষয়টি কাগজে থাকলেও রাস্তার পাশে সেসব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! অন্যদিকে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, তালগাছের মতো গাছগুলো রোপণ করা উচিত খোলা মাঠে, তাহলেই এটি বেশি কাজে দেবে।

গ্রামাঞ্চলে প্রবাদ আছে-যে তালগাছ লাগায় সে ওই গাছের তাল খেয়ে যেতে পারে না, ফল খায় পরের প্রজন্ম। কথাটি দ্ব্যর্থবোধক। পরের প্রজন্মের জন্য ভালো ফল ভোগের ব্যবস্থা করে যেতে পারা ইতিবাচক ঘটনা। কিন্তু প্রশ্ন হলো লাখ লাখ তালের আঁটিতে কটা তালের চারা বড় হচ্ছে সেই খোঁজ কে রাখছে? অবশ্য সরকার যে শুধু তালের আঁটির ওপরই ভরসা করছে এমন নয়। সেসময় এর পাশাপাশি হাওর অঞ্চলে টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনাও নেয় সরকার। আশার কথা হলো তালগাছের প্রাকৃতিক প্রযুক্তির বাইরে বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানোর লক্ষ্যে দেশবাসীকে আগাম সতর্কবার্তা দিতে দেশের আটটি স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র বা লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর বসিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় (দেশ রূপান্তর, ৮ অগাস্ট’২১)। এসব সেন্সর দেশের আবহাওয়ার গবেষণায় কাজে লাগবে কিনা তাতে সন্দেহ।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধহিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ উত্তর জেলার সম্মেলন আজ