কর্ণফুলী, আমজনতা ও একটি নিছক গল্প
গত কয়েকদিনের স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদপত্রের পাতায় কর্ণফুলী নদী নিয়ে বেশকিছু সংবাদ চোখে পড়ল। তার সঙ্গে দখলে ও দূষণে মৃতপ্রায় কর্ণফুলী নদীর চিত্রও দেখলাম। দেখে মন খারাপ হয়েছে। মন খারাপ শুধু আমার নয় সরকারের মন্ত্রী, এমপি, ক্ষমতাবান নেতা, সরকারি আমলা আর দখল-দূষণকারী ছাড়া বাদবাকি সবারই হওয়ার কথা। সমস্যাটি হলো, যাদের মন খারাপ হলে হুলস্থুল কাণ্ড ঘটে যেত তাদের মন খারাপ না হয়ে হচ্ছে আমার মতো আমজনতার, তালপাতার সেপাইদের। আমাদের অনেক বছর ধরে তো মন খারাপ তাতে কিছু হচ্ছে না, যাদের হলে কিছু হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তাদের মন খারাপ হচ্ছে না। মনে পড়ছে, কয়েকবছর আগে উচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে বলেছিলেন, ‘নদী হচ্ছে জীবন্ত সত্তা’। প্রতিদিন সেই নদীর হত্যাকাণ্ড দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছি।
‘কর্ণফুলী নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন গত রোববার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশের গভীরতা ও দখল জরিপ ২০২২’ প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। তাতে বলা হয়, ‘২০০০ সালে কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ছিল ৯৩০.৩১ মিটার। কিন্তু বর্তমানে প্রস্থ দাঁড়িয়েছে ৪১০ মিটার। গত ২২ বছরে বিলীন হয়ে গেছে নদীর প্রায় ৫০০ মিটার এলাকা। এছাড়া একপাশে চর ও অন্যপাশে ক্রমশ মাটি সরে যাওয়ায় শাহ আমানত ব্রিজের দক্ষিণ পাশ ধসে যেতে পারে।’
কর্ণফুলী নদীর তলদেশের বাস্তব পরিস্থিতি ও দখল নিয়ে জরিপ পরিচালনা করা হয় চলতি বছরের ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। জরিপ কাজ পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও রোড কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ ড. স্বপন কুমার পালিত, কর্ণফুলী বিশেষজ্ঞ বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী ও মেরিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নোমান আহমদ সিদ্দিকি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, ম্যানুয়াল ও ফ্যাদোমিটারের মাধ্যমে ভাটার সময় নদীর তলদেশের গভীরতা পরিমাপ করা হয়। এতে দেখা যায়, কর্ণফুলী নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ চর পাথরঘাটা ব্রিজঘাট এলাকায় ২৫ ফুট, মাঝ নদী বরাবর ৩৮ ফুট, উত্তর পাশে ফিরিঙ্গিবাজার ব্রিজঘাট এলাকায় ২৪ ফুট। এই এলাকাটি নিয়মিত ড্রেজিং করায় নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ রয়েছে। কিন্তু এর ঠিক ৫০০ মিটার উজানে চাক্তাই খালের মোহনায় উত্তর পাশে কর্ণফুলীর প্রকৃত সীমানা থেকে তিনশ ফুট নদীর অংশে গভীরতা মাত্র ২ ফুট, মাঝ নদী বরাবর ১৩.৬ ফুট এবং দক্ষিণ পাশে তীরের কাছাকাছি গভীরতা ৪৮ ফুট। তাছাড়া নদীর আরও ৫০০ ফুট উজানে উত্তর পাশে রাজাখালী খালের মোহনায় মাঝনদীতে গভীরতা মাত্র ৪ ফুট। কিন্তু শাহ আমানত সেতুর তিন নম্বর পিলার বরাবর নদীর গভীরতা ৬০.৯ ফুট।
জরিপে আরও বলা হয়, কর্ণফুলী সেতুর উত্তর পাশে ১ ও ২ নম্বর পিলারের মধ্যখানে গভীরতা ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার পরিমাপ অনুযায়ী ২৫ ফুট থাকার কথা থাকলেও সেখানে বর্তমান গভীরতা হচ্ছে মাত্র ৭.৭ ফুট। এছাড়া ২ ও ৩ নম্বর পিলারের মধ্যখানে গভীরতা থাকার কথা ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার গভীরতা অনুযায়ী ৩৮ ফুট। বাস্তবে এই দুই পিলারের মধ্যখানে চর জেগেছে। আবার সেতুর ৩ ও ৪ নম্বর পিলার এলাকায় স্বাভাবিক গভীরতা ৩৮ ফুট থাকার কথা থাকলেও সেখানে বর্তমান গভীরতা বেড়ে ৬৪.৭ ফুট এবং সেতুর দক্ষিণ তীরে ৪ ও ৫ নম্বর পিলারে নদীর স্বাভাবিক গভীরতা থাকার কথা ২৮ ফুট। কিন্তু সেখানে গভীরতা ৭৮.৬ ফুট। এ কারণে প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে কর্ণফুলী সেতুর দক্ষিণ অংশটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। পূর্বেই বলেছি আমার কিছু বলার নেই, যেহেতু করারও কোনো ক্ষমতা নেই। আমি শুধু পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই। যেমন কর্ণফুলী নিয়ে গত কয়েকবছরের নানা উদ্যোগ।
২০১০ সালের ১৪ জুলাই কর্ণফুলী নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় পত্রিকায়। ১৮ জুলাই হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন জনস্বার্থে রিট আবেদন করে হাইকোর্টে। এর প্রেক্ষিতে কর্ণফুলী নদী দখল, মাটি ভরাট ও নদীতে সব ধরনের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনকে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে নদীর প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ করে প্রতিবেদনও দিতে বলেন আদালত। আদালতের নির্দেশের পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর কর্ণফুলীর দুই তীরে সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু করে। ন্যাভাল অ্যাকাডেমি সংলগ্ন নদীর মোহনা থেকে মোহরা এলাকা পর্যন্ত অংশে ২০১৫ সালে জরিপের কাজ শেষ হয়। জরিপে নদীর দুই তীরে দুই হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসন। প্রতিবেদনটি ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর উচ্চ আদালতে দাখিল করা হয়। এরপর ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ কর্ণফুলীর দুই তীরে গড়ে ওঠা স্থাপনা সরাতে ৯০ দিনের সময় বেঁধে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এক কোটি ২০ লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ চেয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী। এরপর টাকার জন্য চিঠি চালাচালি ও নানা জটিলতায় গড়িয়ে যায় সময়।
ওই সময় বলা হয়েছিল ২০ লাখ টাকার বন্দোবস্ত না হওয়ায় উচ্ছেদ অভিযান থমকে আছে। অবিশ্বাস বটে! এই টাকা চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ চাঁদা তুলেও দিতে পারত যদি প্রশাসনের পক্ষ থেকে জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হতো।
শেষতক আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে পাঁচ দিন সদরঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর তীরের ২৩০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। দখলমুক্ত করা হয় মাত্র ১০ একর জায়গায়। যদিও পরে এসব জায়গার অধিকাংশই আবার বেদখল হয়ে গেছে। পতেঙ্গা এলাকার মোহনা থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার এলাকায় কর্ণফুলীর দুই তীর থেকে দুই হাজার ১১২টি স্থাপনা উচ্ছেদ করার কথা জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে। এই উচ্ছেদ অভিযানের পর তিন বছর তিনমাস আর কোনো খবর ছিল না প্রশাসনের। এর মধ্যে অবশ্য হাইকোর্টের নিদের্শনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেদের জায়গায় গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা গুড়িয়ে দিতে অভিযান চালায় লালদিয়ার চরে। চরটি বছরের পর বছর চট্টগ্রাম বন্দরের হাতছাড়া ছিল। এর পাশেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে কর্ণফুলী নদীর পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতে রিট করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। পতেঙ্গায় বিমানবন্দর ঘাঁটি সমপ্রসারণের জন্য ১৯৭২ সালে কয়েক হাজার স্থানীয় বাসিন্দাকে সরিয়ে লালদিয়ার চরে পুনর্বাসন করে তৎকালীন সরকার। এ সময় ৪০০ পরিবারকে ১২৪ একর জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়। জায়গাটি ১৯৩৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের নামে অধিগ্রহণ করা বলে জানায় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এদিকে লালদিয়ার চরে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা প্রসঙ্গে ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রিট পিটিশনের আদেশ দেন। ওই আদেশের প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৯ মার্চ হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ১ মার্চ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপর আর খবর নেই উচ্ছেদের।
নদী নিয়ে লেখা হয়, জলাবদ্ধতা নিয়ে লেখা হয়, নগরের সব খাল ভরাট হয়ে রাস্তার চেয়েও উঁচু হয়ে গেছে সে কথাও লেখা হয় কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয় না। এই লেখার পরও যে কিছু হবে তেমন সম্ভাবনাও দেখছি না।
তার চেয়ে পাঠকদের আজ একটি গল্প বলি। প্রতিলেখায় সমস্যার কথা পড়তে পড়তে তাঁরাও ত্যক্ত-বিরক্ত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এক রাজ্যে ভীষণ দুর্ভিক্ষ চলছে। কাজ নেই, খাদ্য নেই। মানুষ বড় কষ্টে আছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে দু বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিল পাশের কোনো রাজ্যে চলে যাবে তারা। যেই ভাবা সেই কাজ। একদিন তারা বেরিয়ে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে উপস্থিত হলো একটি রাজ্যে। দু বন্ধু অবাক হয়ে দেখল সে রাজ্যে তেল ও ঘিয়ের দাম একই। দু বন্ধুর মধ্যে যে বন্ধুটি একটু পেটুক সে তার অপর বন্ধুকে বলল, দোস্ত চল এখানে থেকে যাই। কাজ করব আর তেলের দামে ঘি খাব। অপর বন্ধুটি বলল, তা ঠিক হবে না দোস্ত। যে দেশে তেল ও ঘিয়ের দাম একই সেদেশে কোনো বিচার নাই, ভালো-মন্দের ভেদাভেদ নাই সেইরকম দেশে থাকা যাবে না। প্রথম বন্ধুটি বলল, না ভাই আমি এই রাজ্যে থেকে যাব, তোমার না পোষাইলে তুমি যাওগা। অগত্যা বন্ধুটি তাকে রেখে চলে গেল অন্য রাজ্যে।
কেটে গেল বছর তিনেক। এবার প্রথম বন্ধুটি দেশে ফেরার জন্য রওনা হলো। ভাবলো যাবার পথে পেটুক বন্ধুটিকেও সাথে করে নিয়ে যাবে। যে রাজ্যে এবং যেখানে বন্ধুকে ছেড়ে এসেছিল সেখানে গিয়ে তার খবর নিতে গিয়ে জানল, কয়েকদিন আগে সে রাজ্যের সৈন্যসামন্ত এসে তাকে ধরে নিয়ে গেছে। কারণ কী জানতে গিয়ে সে জানল, কয়েকমাস আগে সে রাজ্যে একটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কোতোয়ালের লোকজন খুনিকে খুঁজে বের করতে পারেনি। তাতে রাজা প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে যেকোনো প্রকারে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন নইলে কোতোয়ালের গর্দান যাবে বলে নির্দেশ দিয়েছেন।এদিকে কোতায়াল কোনো কূল কিনারা না দেখে তার লোকদের নির্দেশ দিয়েছেন যে করেই হোক একজনকে ধরে আনতে হবে। কিন্তু সে একজন কে হতে পারে? অনেক শলাপরামর্শ করে তারা সিদ্ধান্ত নিল রাজ্যের সবচেয়ে মোটা লোকটাকে খুনি হিসেবে দরবারে হাজির করা হবে। আর রাজ্যের সবচেয়ে মোটা লোক হিসেবে তার বন্ধুটিকেই ধরে নিয়ে গেছে। তার সে বন্ধুটি তেলের বদলে ঘি খেয়ে খেয়ে দিনদিন শরীরের প্রস্থই বাড়িয়েছে হুলস্থুল।
এই বন্ধুটি সব শুনে তার নিরপরাধ বন্ধুকে বাঁচানোর উদ্যোগ নেয় এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে মুক্ত করে নিজ রাজ্যের উদ্দেশে রওনা দেয়। যেতে যেতে বন্ধুকে সে বলে, তোকে বলেছিলাম না, যে দেশে তেল ও ঘিয়ের দাম একই সে দেশে কোনো প্রকৃত বিচার নাই।
গল্পটি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে বলিনি। একটি নিছক গল্প। লেখক : কবি-সাংবাদিক