বায়তুশ শরফের মরহুম পীর বাহরুল উলূম শাহ্সূফী হযরত মাওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন সাহেব ছিলেন এক কালজয়ী প্রতিভা। জ্ঞানে গুণে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। বিজ্ঞ মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও আরবি ভাষাবিদ হিসেবে তিনি সর্বজন প্রশংসিত। তাঁর কাব্যিক প্রতিভাও ছিল অসাধারণ। হক্কানী আলেম, বিখ্যাত ওয়ায়েজ হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। এরূপ বড় বড় পরিচয়, খ্যাতি ছাড়িয়ে তিনি একজন কামিল পীর হিসেবেই সর্বত্র বেশি পরিচিত। আধ্যাত্মিক সাধক মানব প্রেমিক হিসেবে সর্বশ্রেণির লোকের নিকট তিনি শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। একই সাথে ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক, দেশ দরদি মানবপ্রেমিক এবং সমাজসেবক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি ছিল সমধিক। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শরীয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন।
মওলানা শাহ মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহরের অদূরে বৃহত্তর সাতকানিয়া (বর্তমান লোহাগাড়া) উপজেলার অন্তর্গত আধুনগরস্থ সুফি মিয়াজি পাড়ায় ১৯৩৮/৩৯ খ্রিস্টাব্দে এক ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত আলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মওলানা মরহুম মুসলেহ উদ্দিন এবং মাতা মরহুমা রায়হানাহ বেগম। তাঁর পিতা ছিলেন লোহাগাড়া থানাধীন ঐতিহ্যবাহী চুনতি হাকিমিয়া আলিয়া মাদরাসার একজন সুযোগ্য শিক্ষক। তাঁর মাতা চরিত্রবতী, পর্দানশীন অত্যন্ত পরহেজগার মহিলা ছিলেন। তিনি চুনতি হাকিমিয়া সিনিয়র মাদরাসার সেরা ছাত্রদের তালিকায় নিজের স্থান করে নেন। এ মাদরাসা থেকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে হাফতুম (দাখিল) কৃতিত্বের সাথে পাস করেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে একই প্রতিষ্ঠান হতে ছুয়াম (আলিম) ১ম বিভাগে ১৬তম স্থান এবং ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে উলা (ফাযিল) ১ম বিভাগে ৫ম স্থান অধিকার করে বিরল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
মাওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন হাদিস বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উম্মুল মাদারিস (মাদরাসা সমূহের জননী) খ্যাত চট্টগ্রাম চন্দনপুরা দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। এ মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে তিনি ‘কালের সেরা ছাত্র’ ও ‘মাদরাসার গৌরব’ হিসেবে আখ্যায়িত হন। তিনি ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে কামিল (হাদিস) ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করায় ‘গোল্ড মেডেল’ লাভ করেন। এ ঈর্ষণীয় ফলাফল লাভের সুবাদে পূর্ব পাকিস্তান মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক তাঁকে দু’বছর সময়কাল গবেষণা করার জন্য বৃত্তি প্রদান করা হয়। কিন্তু পারিবারিক কারণে তিনি সেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন নি।
কামিলে ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করার পর তাঁর শ্রদ্ধাভাজন পীর, বায়তুশ শরফের মহান প্রতিষ্ঠাতা হযরত মওলানা মীর মোহাম্মদ আখতর (রহ.) এর নিকট দোয়া নিতে এলে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়ে সেদিন বাদে জুমা মাদারবাড়িস্থ তাঁর বাংলায় (ইবাদতখানা) উপস্থিত সবাইকে মিষ্টি মুখ করান এবং তাঁর কারুকার্যখচিত টুপিটি স্বহস্তে মওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিনের মাথায় পরিয়ে দেন। তাঁর ব্যবহৃত সাদা রুমালখানা দ্বারা মাথায় পাগড়ি বেঁধে দিয়ে “বাহরুল উলূম” (বিদ্যাসাগর) উপাধিতে ভূষিত করেন।
ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. আহসান সাইয়েদ তাঁর “বাহরুল উলূম শাহসুফি হযরত মওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রহ.)” প্রবন্ধে বলেন, “আরবি ভাষায় তাঁর পাণ্ডিত্য সর্বজন প্রশংসিত। তিনি এমন সহজ সাবলিলভাবে অনর্গল আরবিতে কথা বলেন এবং লিখেন যা দেখলে মনে হয় আরবি যেন তাঁর মাতৃভাষা। একই সাথে উর্দু এবং ফারসি ভাষায়ও তিনি সমান পারদর্শী। তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও বালাগাত (অলংকার শাস্ত্র) এ সকল বিষয়ে তাঁর রয়েছে গভীর জ্ঞান। তাঁর জ্ঞান গরিমায় মুগ্ধ হয়ে দেশের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ তাঁকে ‘বাহরুল ‘উলূম’ উপাধিতে ভূষিত করেন।” মওলানা মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে সাতকানিয়া থানার রসুলাবাদ সিনিয়র মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। তাঁর মেধা, বিচক্ষণতা, জ্ঞানের গভীরতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা বিবেচনা করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাঁকে সুপারিনটেনডেন্ট পদে পদায়ন দেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর অত্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অবৈতনিকভাবে তাঁর পীর শাহ্ আবদুল জব্বার (রহ.) প্রতিষ্ঠিত বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল (অনার্স-মাস্টার্স) মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে ১ জুন, ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৭ সালে তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে অধ্যক্ষের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেও অবৈতনিক ওস্তাদ হিসেবে বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসার ছাত্রদেরকে বুখারি শরীফ ও মুসলিম শরীফসহ অন্যান্য বিষয়ে পাঠদানের পাশাপাশি মাদরাসা পরিচালনা পরিষদের (গভর্নিং বডির) সম্মানিত সভাপতি ও সহ-সভাপতি হিসেবে ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বিশেষ অবদান রেখেছেন।
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব হযরত মাওলানা ওবায়দুল্লাহ্ সাহেবের ইন্তেকালের পর ২০ নভেম্বর, ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ বেসরকারি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এবং ১৩ জানুয়ারি, ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এর শরি‘আহ সুপারভাইজরী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এছাড়াও তিনি আরো বহু দ্বীনি, সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন।
জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ১৯৯৮ উপলক্ষে তিনি চট্টগ্রাম জেলার ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান’ (অধ্যক্ষ) এবং ২০০০ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক তিনি জাতীয়ভাবে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান’ (অধ্যক্ষ) নির্বাচিত হন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা থেকে তিনি ‘স্বর্ণ পদক, নগদ অর্থ ও সনদপত্র’ লাভ করেন। সাথে সাথে তাঁর সুযোগ্য পরিচালনায় ও নিবিড় তত্ত্বাবধানে বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসা ২য় বারের মত শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয়ভাবে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ হওয়ার গৌরবময় স্বীকৃতি লাভ করে এবং পুরস্কৃত হয়। তাঁর দোয়ায় জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০১৮ সালে ৩য় বারের মত বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল (অনার্স-মাস্টার্স) মাদ্রাসা জাতীয়ভাবে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সম্মানিত অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. সাইয়েদ মুহাম্মদ আবু নোমান শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে সনদপত্র ও নগদ অর্থ পুরস্কার লাভ করেন।
হযরত মাওলানা কুতুব উদ্দিন সাহেব (রহ.) ছিলেন একজন স্বভাবজাত কবি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও অনুষ্ঠানে আরবি, উর্দু ও ফারসি ভাষায় উপস্থিত স্বরচিত কবিতা পাঠ করে তিনি হয়েছেন প্রশংসিত ও নন্দিত। তাঁর লিখিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘গুলহায়ে আকীদত’ নামে উর্দু ভাষায় একটি অমূল্য কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যাতে বিভিন্ন বিষয়ের উপর স্বরচিত প্রায় ৫০০ দুর্লভ কবিতা স্থান পেয়েছে। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৮টি। পারিবারিক জীবনে তিনি স্ত্রী, এক পুত্র ও ছয় কন্যার জনক ছিলেন। এই আধ্যাত্মিক সাধক, মানবপ্রেমিক, দানবীর তাঁর লক্ষ লক্ষ ভক্ত-অনুরক্তকে শোক সাগরে ভাসিয়ে মহামারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০ মে ২০২০ খ্রি: পবিত্র শবে কদরের দিন ঢাকার আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। আল্লাহ্ তাঁকে তাঁর সুকর্মের জন্য জান্নাতুল ফেরদৌসে দাখিল করুন।
লেখক : সম্পাদক, মাসিক দ্বীন দুনিয়া ও শিশু কিশোর দ্বীন দুনিয়া