ডিসেম্বর-জানুয়ারির কনকনে ঠান্ডা ও বরফের মাঝে জাহাজ থেকে শোর-লীভ পেয়ে সাউথ-কোরিয়া ও জাপানের শহরগুলোতে ঘুরতে বের হয়েছি। জীবনে প্রথমবার জাহাজে করে মেরিনার হিসাবে সমুদ্রযাত্রা এবং বিদেশভ্রমণ। গত সপ্তাহেই চির-বসন্তের দেশ সিংগাপুর-ইন্দোনেশিয়ায় ভ্যাপ্সা গরমের মাঝে ছিলাম; আর হঠাৎ করেই এখন বরফের মাঝে নিজেদের আবিষ্কার করলাম। থার্মাল-শক একেই বলে- মেরিনারদের জীবনই এইরকম। আমরা বাসা থেকে জাহাজে জয়েনিং-এর জন্য বের হওয়ার সময়ে, স্যুটকেসে সব ঋতুর কাপড়-চোপড় নিয়েই বের হই। কারণ, জানিনা তো জাহাজ কখন কোন পোর্টে যাবে, সেখানের আবহাওয়া তখন কেমন হবে। বিশেষ করে উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধে গেলে, কয়েকদিনের ব্যবধানেই আমরা গ্রীষ্মকাল থেকে শীতকালে পৌঁছে যাই। যা হোক, সেদিন কিন্তু শীতের মাঝে মোটা জ্যাকেট- সোয়েটার পড়লেও, আমার চরম অসুবিধা একটাই- মাথা দিয়ে ঠান্ডা ঢুকে মুন্ডু-মগজ জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে। আর হবেই না বা কেন? মাত্র কয়েকদিন আগে পলিওগ থেকে শেলব্যাকে উন্নীত হয়েছি; তার জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত- আমার ন্যাড়ামাথা। সেখান দিয়েই হু হু করে শীতের কনকনে বাতাস ঢুকে আমার চাঁদি আর ভিতরের ঘিলু জমিয়ে দিচ্ছে। অ্যা! কী বললাম? পলিওগ-শেলব্যাক! চিনতে পারছেন না? আচ্ছা, পরিচয় করিয়ে দেই আপনাদের সাথে। তার আগে একটু ভূগোল-বিদ্যা ঝালাই করে নেই।
বিষুবরেখা বা নিরক্ষরেখা (Equator ) তো আমরা সকলেই চিনি। পৃথিবীর মাঝপেট বরাবর যেই অক্ষরেখা পূর্ব-পশ্চিমে পৃথিবীর পেটকে ঘিরে রেখেছে, সেইটা। মাঝপেট বলে শূন্য (নিরক্ষ)। সেরকমই শূন্য-দ্রাঘিমাংশ রেখা বা প্রাইম মিরিডিয়ান (Prime Meridian ) হলো যেটা ইংল্যান্ডের গ্রীনউইচ শহরের উপর দিয়ে গেছে, পৃথিবীর উপর থেকে নীচে (উত্তর থেকে দক্ষিণে)। আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ রেখা আছে, International Date Line প্রাইম মেরিডিয়ানের ঠিক ১৮০ ডিগ্রি উল্টাপাশে, যেটা প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে গেছে। এই লাইনের দুইদিকে দুইটা ভিন্নদিন, লাইনের দুইপাশে তারিখ ভিন্ন। এই লাইন পার হলে আপনি টাইম-ট্র্যাভেল করতে পারবেন- কখনো আপনার জীবন থেকে একটা দিন চিরতরে মিস্ হয়ে যাবে; আবার উল্টাদিকে গেলে একটা দিন দুইবার আসতে পারে।
জাহাজে আনকোরা নতুন কেউ আসলে, বৈচিত্র্য আনার জন্য সমুদ্রের মাঝে একটু মজা করা হয়। আনকোরা নতুন বলতেই ধরে নিচ্ছি ক্যাডেট যখন প্রথম জাহাজে জয়েন করে। এছাড়াও মাঝে মাঝে জাহাজে নতুন ভাবীদের সঙ্গেও মজাটা করা হয়। জাহাজ চলতে চলতে যখন উপরের কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ রেখার কাছে আসে, তখন তাদেরকে বোকা বানানোর জন্য বলা হয়, সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে বিষুব রেখা বা প্রাইম মেরিডিয়ান বা ডেইট-লাইন দেখতে পাবেন। তারা ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে থেকে পানির উপরে সেই লাইনগুলো খুঁজার চেষ্টা করে। আসলে, এগুলো তো কোন সত্যিকারের দাগকাটা লাইন না যে দেখা যাবে। এগুলো আমাদের সকলের সুবিধার জন্য কল্পনা করে নেওয়া হয়েছে – পৃথিবীর উপরে আমাদের পজিশান নির্ণয় করা (GPS), জাহাজ-প্লেন চলাচল, সময়ের হিসাব রাখা এরকম আরো সব গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য। যাহোক, অনেকক্ষণ পরে তাদেরকে বুঝানো হয় যে, এগুলো দেখা যায় না। তখন সকলেই বোকার হাসি উপভোগ করি। এটা তো গেলো নিরীহ মজা; কিন্তু জাহাজে আরেক ডিগ্রী উপরে আরো একটা ট্রেডিশানাল সেরিমোনী আছে সেইটা নিয়ে আজকে বলি।
জাহাজী-জীবনের একঘেয়েমি কাটানোর জন্যে, এগুলো একটা নিছক বিনোদনমূলক ট্রেডিশান। আশাকরি সকলে খোলামনেই মজাটুকু গ্রহণ করবেন। সমুদ্রের মাঝে সবসময়ই পার্টি করার উছিলা খুঁজা হয় – বার্থডে, এনিভার্সারি, এনগেজমেন্ট, প্রমোশান এগুলো তো আছেই। সেইসঙ্গে ধর্মীয়পর্ব অনুষ্ঠান – ঈদ, ক্রীস্টমাস অথবা নিউ-ইয়ার ইত্যাদি। পোর্টে থাকলে আমাদের ভীষণ ব্যস্ততা থাকে মাল বোঝাই বা খালাসের জন্যে, ইঞ্জিন মেইন্টেন্যান্সের জন্যে। আবার, অনেকে হয়তো শোর-লীভ নিয়ে বাইরে ঘুরতে যায়। তাই আমরা পার্টিগুলো করি সমুদ্রে গেলে – কখনো কখনো পোর্টে করতে না পারলে সমুদ্রে ক্বাজা করেও করি। যাহোক, জাহাজ যদি বিষুবরেখা, শূন্য-দ্রাঘিমা বা ডেইট-লাইন দিয়ে যায়, তার কয়েকদিন আগে থেকেই জাহাজে পলিওগ খুঁজা শুরু হয়। Polliwog বা pollywog মানে হচ্ছে ব্যাঙাচি, ব্যাঙের পোনা। আর এদেরকে খুঁজে বেড়ায় shellback-রা। রোমান মিথোলোজিতে সমুদ্রের রাজা হলো কিং নেপচুন (গচীকদের জন্যে পসেইডন)। নেপচুনের রাজ্যে পলিওগ (নবাগত ক্যাডেট) বিনানুমতিতে ঢুকে পড়ে গর্হিত অপরাধ করেছে। তাকে এখন মাশুল দিতে হবে। শেলব্যাকেরা হলো নেপচুনের প্রিয়জন; তারা অনেক অনেক বছর ধরে সমুদ্রে বসবাস করছে, কাজ করছে- মানে অভিজ্ঞ নাবিকেরা, সিনিয়রেরা। তারাই ধরে আনে পলিওগ – মানে প্রথমবার জয়েন করা আনকোরা নতুন ক্যাডেটদের। জাহাজেরই একজনকে কিং নেপচুন সাজিয়ে বিচারসভা বসানো হয়। চেষ্টা করা হয় গাট্টা-গোট্টা দেখতে, ভুঁড়িওয়ালা অথবা ইয়া দাড়িগোঁফওয়ালা কাউকে যদি পাওয়া যায়, তাহলে সেই-ই কিং নেপচুন সাজে। হাতে থাকে ত্রিশুল, সঙ্গে কয়েকজন সাঙ্গোপাঙ্গও যোগাড় হয় – তারাই শেলব্যাক। মাঝে মাঝে ডেভী জোন্স্েকও বানানো হয়। সমুদ্রডুবী হলে, কেউ ডুবে গেলে বা জাহাজের কিছু পানিতে পড়ে গেলে ডেভী জোন্সের সিন্দুকে সব ধনরত্ন জমা হয়। যাহোক, নেপচুনের পারমিশান ছাড়া এই জাহাজে নতুন পলিওগেরা বিষুবরেখা পাড়ি দিচ্ছে – ধারণা করা হয়, সে কারণে নেপচুন ক্ষেপে যাবে এবং জাহাজে বিপদ নেমে আসবে; ঝড়-ঝঞ্ঝার মাঝে পড়তে হবে। তাই এরকম অপরাধের কারণে পলিওগদের নানান রকম জরিমানা করা হয়। কিন্তু পরে সকলের করুণ আবেদনে নেপচুন দয়াপরবশ হয়ে তাদের গর্হিত অপরাধ মাফ করে দেন বটে, কিন্তু আদেশ দেন পলিওগদের ধরে চুল পুরাপুরি ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। নেড়ু হওয়ার পরে তাদেরকে কিং-এর তরফ থেকে সার্টিফিকেট দিয়ে শেলব্যাকে প্রমোশান দেওয়া হয় এবং সেই উপলক্ষ্যে সকলে মিলে পার্টি-উৎসব করে।
এই ট্র্যাডিশান বিশ্বের প্রায় সবদেশের নাবিকদের মাঝেই পালিত আছে। আর শুধুমাত্র মার্চেন্ট- মেরিনারদের মাঝে নয়, নেভীদের মাঝেও আছে। কোনো কোনো ট্র্যান্স-অ্যাটলান্টিক ক্রুজ শিপে প্যাসেঞ্জারদেরকেও পলিওগ থেকে শেলব্যাক করা হয় মজা করে। এগুলো হচ্ছে নিছক মজা করার উছিলা। যদিও, এই মজা করতে করতে অনেক অনভিপ্রেত ঘটনাও ঘটে যায়। মনোমালিন্য থেকে শুরু করে, শারীরিক বলপ্রয়োগ ইত্যাদি । কিন্তু বেশীরভাগ সময়েই এগুলো হয় আনন্দ-ফূর্তি করার জন্য।
আমি আর আমার দুই বন্ধু, ১৯৮৫ সালের শেষের দিকে আমাদের প্রথম জাহাজ ‘বাংলার মিতা’-য় করে মালেয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া কোরিয়া হয়ে জাপানে যাই। তারপরে আবারো একই পথে চট্টগ্রামে ফেরত আসি। আমাদের তিন পলিওগকেও একদিন ধরা হলো; এবং চুল কেটে দেওয়া হলো। সময়টা ছিলো ডিসেম্বর মাস। চুল কাটা হয়েছিলো নিরক্ষরেখার কাছে, সেখানে তো সবসময়ই গরম টেম্পারেচার। কিন্তু সাউথ কোরিয়া আর জাপানে প্রচন্ড বরফ ও শীতে একদম কাবু হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া তিন পলিওগ, এই প্রথম বিদেশে এসেছি, বরফ দেখেই কাপুত। তার উপরে মাথায় চুল নাই, মাথা দিয়ে ঠান্ডা ঢুকে মগজ জমিয়ে দিচ্ছিলো। তাড়াতাড়ি করে গরম-ক্যাপ, মাফলার কিনে আল্লাহ্ প্রদত্ত অল্প-স্বল্প যা মগজ ছিলো, সেইটা বাঁচালাম। এখনো সেই দিনের কথা মনে পড়ে। টলিডো, ওহাইও, ২০২২