শ্রীলংকায় লুটপাট, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর বা অন্যের ওপর হামলা করতে দেখলে নিরাপত্তা বাহিনীকে সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ জারি করেছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। অর্থনৈতিক সঙ্কটের জেরে সরকারবিরোধী প্রবল বিক্ষোভ আর সহিংসতায় সোমবার শ্রীলঙ্কায় আটজন নিহত হয়। আহত হয় ২০০’র বেশি মানুষ। সরকার দলীয় এমপিদের ৫০টিরও বেশি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এর একদিন পরই ব্যাপক ক্ষমতা দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে মাঠে নামিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। সংঘাত নিয়ন্ত্রণে সোমবারই দেশজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়। যার মেয়াদ আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের দাবি মেনে সোমবার মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিলেও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে পদত্যাগ করছেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
বিক্ষোভকারীরা বলছে গোতাবায়া রাজাপাকসে পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তাদের বিক্ষোভ থামবে না। গতকাল সকালে মাহিন্দা রাজাপাকসের সরকারি বাসভবন ‘টেম্পল ট্রিজ’ ঘিরে ফেলে বিক্ষোভকারীরা। বাসভবন লক্ষ্য করে তারা অন্তত ১০টি পেট্রলবোমা ছুড়ে। বেশ কয়েকটি গাড়িতেও আগুনও ধরায় তারা। এরপর বিশাল সংখ্যক সেনা রাজাপাকসের বাসভবনে পৌঁছে সপরিবার তাকে উদ্ধার করে। সংবাদ সংস্থা এএফপি-কে সেনার এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিক্ষোভকারীরা বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের গেট ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ভোরেই সপরিবার রাজাপাকসেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে তিনি কিছু জানাননি। তবে বিভিন্ন খবরে বলা হয়েছে, ত্রিঙ্কোমালিতে নৌসেনাঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন মাহিন্দা রাজাপাকসে।
আনন্দবাজার পত্রিকার এক খবরে বলা হয়েছে, মাহিন্দা রাজাপাকসে পূর্ব উপকূলের ত্রিঙ্কোমালি নৌঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন খবর পেয়ে সেখানেও শুরু হয় বিক্ষোভ। কয়েক হাজার আন্দোলনকারী নৌঘাঁটি ঘিরে ফেলেন বলে সে দেশের সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ‘দেখা মাত্র গুলির’ সরকারি আদেশ প্রাণহানি বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বস্তুত, গত ৪৮ ঘণ্টার পরিস্থিতি দেখে শ্রীলঙ্কায় ফের গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা দেখছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ।
অপর এক খবরে বলা হয়, ক্ষমতাসীন দলের এমপি-মন্ত্রীদের দেশত্যাগ ঠেকাতে গতকাল শ্রীলঙ্কার বন্দরনায়েক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিয়েছে কাতুনায়েকে প্রি ট্রেড জোনের একদল তরুণ-তরুণী। তারা রাস্তা জড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বিমানবন্দরের প্রবেশপথ আটকে দেন।
গতকাল রাজধানী কলম্বোর পরিস্থিতি মোটের ওপর শান্ত থাকলেও থমথমে ছিল বলে বলে জানা গেছে। কলম্বোর সড়কগুলোতে হাজার হাজার সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। যদিও তাদের উপস্থিতির মধ্যেই গতকাল বিকালে কলম্বোর একজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার উপর হামলা করেছে উত্তেজিত জনতা। তাদের অভিযোগ, ওই পুলিশ কর্মকর্তা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়া বিক্ষোভকারীদের যথেষ্ট সুরক্ষা দিচ্ছেন না।
এদিকে পুরো কলম্বো জুড়ে সোমবার রাতের সংঘর্ষের চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আাছে। হ্র্রদের মধ্যে বাস ফেলে দেয়া হয়েছে। যত্রতত্র জানালা ভাঙা বাস পড়ে আছে। টায়ারে আগুন জ্বলতে বা ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে।
প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া সরকার সামরিক বাহিনী ও পুলিশকে কোনো পরোয়ানা ছাড়াই লোকজনকে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদ করার বিস্তৃত ক্ষমতা দিয়েছে। সামরিক বাহিনী লোকজনকে আটক করার পর পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার আগে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত তাদের হেফাজতে রাখতে পারবে। এর পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনী মানুষের বাড়ি, গাড়িতেও তল্লাশি চালাতে পারবে বলে মঙ্গলবার সরকারি এক গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। জরুরি এসব পদক্ষেপের অপব্যবহার হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কয়েকজন বিশ্লেষক।
স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সঙ্কট পড়া শ্রীলঙ্কার এ অবস্থার জন্য বিরোধী দলগুলো দুই রাজাপাকসে ভাইকে দায়ী করে আসছেন। সরকার এখন ৫১ বিলিয়ন দেনার ভারে ডুবে আছে। ঋণের কিস্তি হিসেবে দেশটির এই বছর ৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের কথা থাকলেও ওই অর্থও দেশটির হাতে নেই। এই পরিস্থিতিতে তারা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে হাত পাতলেও তেমন সাহায্য পায়নি।
শ্রীলংকার রাজনীতিতে প্রায় ২০ বছর ধরে আধিপত্য করে এসেছেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। তার সরকারই শ্রীলংকায় দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাতে তামিল টাইগারদের নির্মূল করেছিল। সেই পরাক্রমশালী নেতাকে বিদায় নিতে হল অর্থনৈতিক দুর্দশা আর বিক্ষোভের মধ্যে।