শিক্ষকতা ও শিক্ষকদের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা!

অধ্যাপক সরওয়ার জাহান | মঙ্গলবার , ১০ মে, ২০২২ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

কেউ বলতে পারবে না সমস্যামুক্ত কোন প্রশাসন আছে। যত উন্নত, গতিশীল এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপর প্রশাসনের ভিত স্থাপিত হোক না কেন, সমস্যা থাকবেই। অনেক ভালো উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায় উপযুক্ত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সক্ষমতার অভাবে। এর জন্য যারা প্রশাসনের দায়িত্বে থাকেন তাঁদের প্রয়োজন যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ। শিক্ষকদের কাছে মানুষের আস্থা বেশি থাকলেও যথাযত যোগ্যতা এবং বাস্তবায়নে অদূরদর্শিতার কারণে প্রশাসনে ব্যর্থ হতে দেখা যায়। নানা রকম বৈষম্য ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞতার অভাবে, গতানুগতিক অনমনীয় প্রশাসন থেকে বেরিয়ে এসে অংশগ্রহণমূলক নমনীয় ব্যবস্থাপনায় অধিক সুফল পাওয়া যায়।

অব্যাবস্থাপনার কারণে বিভিন্ন সমস্যা প্রশাসনের গতিপথে অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে বাস্তবতার আলোকে সুপরিকল্পনা, দক্ষ নেতৃত্ব এবং বিকেন্দ্রীকরণ প্রশাসনকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে যেতে সাহায্য করে। প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার সফলতা এবং ব্যর্থতা নির্ভর করে বিভিন্ন প্রভাব, সুষ্ঠু কাঠামোগত বিন্যাস পরিচালনাগত পারদর্শীতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা। স্বচ্ছতার নামে আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা, সন্দেহ প্রবনতা, একগুঁয়ে ও সময়ের সাথে না চলা প্রশাসনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ও প্রতিষ্ঠানে স্থবিরতা, ভীতিকর ও বিভাজন নিয়ে আসে। উত্তম প্রশাসনে থাকে, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, প্রশাসক-কর্মীর আন্তঃসুসম্পর্ক। কর্তৃত্বমূলক প্রশাসন সাময়িক সুফল দিলেও দীর্ঘস্থায়ী সফলতা অর্জন করে না। আমাদের দেশে প্রশাসন এখনও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার রাহুগ্রাস মুক্ত হতে পারেনি, যার ফলে শিক্ষকরা প্রশাসনের কাজে ব্যর্থ হন। তাঁরা শিক্ষাসুলভ কাজ এবং চিন্তাভাবনা প্রশাসনে নিয়ে আসেন। সবাইকে তাদের ছাত্র ভাবেন। প্রশাসনের লোকদের মতে তারা ধীর, ভুল সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রায়শই এমনভাবে অনমনীয় স্বিদ্ধান্ত নেন যা চলমান প্রক্রিয়ার বিপরীত।

প্রশাসনিক কাজের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতা সাথে সাংগঠনিক অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। প্রশাসনিক দক্ষতা প্রধানত প্রশাসকের ব্যক্তিত্ব এবং র্দীঘদিনের যে কাজ করেছেন তার ধারাবাহিকতার উপর নির্ভর করে। বেশিরভাগ শিক্ষক প্রশাসনের কাজের জন্য প্রস্তুত থাকেন না। কিন্তু প্রশাসক হতে চান। শিক্ষকরা শিক্ষার উপরই মনোযোগী এবং তাতেই পারদর্শী। শিক্ষকতা আন্তঃব্যক্তিক মিথস্ক্রিয়া। “কি-কেন-কীভাবে” গবেষণার মাধ্যমে উত্তর অন্বেষণ করেন। জানার জন্য বিশ্লেষণ করেন এবং তা বিশুদ্ধ জ্ঞান হিসাবে ছড়িয়ে দেন।
একজন গবেষক একা কাজ করেন, কিন্তু প্রশাসনে থাকলে তাঁকে দলের সাথে কাজ করতে হয়। তাই প্রশাসনে একজন শিক্ষককে অবশ্যই বিশেষ গুণাবলীর অধিকারী হতে হয়; সংগঠিত করার ক্ষমতা, দলে কাজ করা, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ,সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, দূরদর্শিতা এবং তাঁর সিদ্ধান্ত কাজের ফলাফল ভিত্তিক হওয়া। যা অনেক সময় শিক্ষকদের মাঝে পাওয়া যায় না। একজন প্রশাসক এবং একজন শিক্ষক উভয়ই অনেকে ভালো কাজ করেন। কিন্তু সাফল্যের ধারা ভিন্ন। শিক্ষকের সফলভাবে প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করার অনেক উদাহরণ রয়েছে। তবে প্রশাসক হিসেবে সফলতা অনেক কম। পেশা এবং কাজের চাহিদা কী তা বোঝার জন্য নমনীয়তা এবং সূক্ষ্মতা গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশাসনিক নেতৃত্ব ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে এই সত্যটি সকলের জানা। প্রশাসনের কাজ হলো এমন যা কাজকে এগিয়ে নিয়ে যায় বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। শিক্ষাবিষয়ক কাজ একজন শিক্ষকের যোগ্যতা, নেটওয়ার্ক এবং তাঁর গবেষণা এবং প্রকাশনার মাধ্যমে প্রাপ্ত খ্যাতির উপর ভিত্তি করে বিস্তৃত হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষাবিষয়ক কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাবিদের অবস্থানের জন্য কারো সাথে যোগাযোগের প্রয়োজন খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলে তাতে সুনির্দিষ্ট ভূমিকা প্রশাসকের ক্ষেত্রে তা নির্দিষ্ট। অন্যদিকে শিক্ষায় বেশ সাধারণ। শ্রেণিবদ্ধ সম্পর্ক প্রশাসকের মধ্যে শক্তভাবে সংজ্ঞায়িত আর শিক্ষাঙ্গনে ঢিলেঢালা – অর্থাৎ একজন শিক্ষকের একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে, তিনি শেখান এবং একই সময়ে তিনি যা চান তা করার আপেক্ষিক স্বাধীনতা তাঁর আছে। তাই শিক্ষকের সম্পূর্ণ ভিন্ন কাজের শৈলী এবং শেখা আচরণ রয়েছে যা একজন শিক্ষককে সাফল্যের দিকে নিয়ে যায়। গবেষক এবং প্রশাসক কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নন। দেশের স্বার্থে দুই ধরনের পেশার লোকেরই প্রয়োজন। কিছু শিক্ষকের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার অভাবে অবমূল্যায়ন হন। এটা একটা দেশেরে জন্য মোটেই ভাল নয়। অথচ শিক্ষকরাই প্রশাসক তৈরি করেন।

একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ওই প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় পদে অধিষ্ঠিত এবং প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার দক্ষ ব্যবস্থা অনেকাংশে প্রধানের দক্ষতার উপর নির্ভর করে। প্রধানের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান হল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষণ প্রক্রিয়াটিকে সবচেয়ে কার্যকর করার জন্য সমস্ত কার্যকলাপে কার্যকরভাবে নেতৃত্ব দেওয়া, পরিচালনা করা এবং অংশগ্রহণ করা, যা অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ এবং তা আরও কার্যকরী হয় যখন সেই ভূমিকার জন্য তিনি লৌহ মানব না হয়ে বরং আবেগ দিয়ে কাজ করেন। প্রশাসনে শিক্ষকের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলেঅর মধ্যে একটি হল বিভিন্ন চাপ এবং অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেওয়া। এটি সর্বদা সত্য নয় যে শিক্ষাবিদরা প্রশাসনে সবসময় ব্যর্থ, তবে র্দীঘদিন শিক্ষক হিসেবে কাজ করার কারণে তাদের পটভূমির প্রভাবে অনেকেই ব্যর্থ হন। তাঁরা তাঁদের একাডেমিক দক্ষতা বিকাশের জন্য অনেক সময় দেন এবং যখন প্রশাসনে চলে যান তখন নতুন ভূমিকার সাথে সামঞ্জস্য করতে পারেন না। শিক্ষকতার আত্মতৃপ্তি অনেক সময় তাঁদের অজান্তে প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিতে ফেলে দেন।

প্রশাসনিক চাকরি এবং একাডেমিক চাকরির মধ্যে পার্থক্য আছে । যখন একজন শিক্ষক নন-একাডেমিক স্টাফদের সাথে কাজ করেন, তখন তাঁর এই ধরনের ক্ষেত্রগুলো যথাযথ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন এবং নন-একাডেমিক কর্মীদের মনোবিজ্ঞান এবং তারা কীভাবে কাজ করে তা বোঝা প্রয়োজন। বেশিরভাগ সময় শিক্ষকরা বস হয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না তাঁরা ছাত্রদের পড়াতেই বেশি পছন্দ করেন । তারা প্রশাসনে তেমন সহযোগিতাও পান না। যারফলে প্রশাসনিক কাজে যে স্টাইল ব্যবহার করেন না কেন তারা সর্বদা সমালোচিত হন। অনেক শিক্ষক পর্রামশ শুনেন কিন্তু নিতে চান না, কারণ তাঁরা মনে করেন অন্যরা তাঁকে আদেশ করছেন। যদি একজন শিক্ষকের ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা না থাকে তবে তাঁর ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যেমন মানব সম্পর্ক বৃদ্ধিতে দক্ষতা, দ্বন্দ্ব এবং বিভ্রান্তি তৈরি না করেই মানুষকে বোঝার এবং তাদের সাথে সদাচরণ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। এটি মানুষের সাথে ভালভাবে কাজ করার ক্ষমতা ও একটি দলের সদস্য হিসাবে কার্যকরভাবে কাজ করার সমবায় প্রচেষ্টা গড়ে তোলার ক্ষমতা। একজন শীর্ষ নির্বাহী হিসাবে, তাকে অবশ্যই সংর্কীনতা পরিহার করে যোগাযোগ, অনুপ্রেরণা এবং নেতৃত্বে অধস্তনদের সাথে কাজ করার সক্ষমতা থাকতে হয়। শুধু ভয়-ধমকি-হুমকিতে কাজ হয় না।

সরকার প্রায়শই সফল শিক্ষকদের প্রশাসনিক চাকরিতে সাময়িক সময়ের জন্য উন্নীত করে । প্রশাসনিক পদের প্রয়োজনীয়তা গবেষণা ও শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তার চেয়ে আলাদা। অনেক প্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জও থাকে, যেমন, বাজেটের সীমাবদ্ধতা, কর্মসংস্থানের পরিবেশ । শিক্ষকরা গবেষণা ছাত্রদেরকে সাধারণত দর কষাকষির জন্য তৈরি করেন না যা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনে থাকাকালীন করতে হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান চলে এক নিয়মে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চলে ব্যক্তি-গোষ্ঠীর ইচ্ছায় টিকে থাকার জন্যে। নিয়ম-কানুন মেনে আর্থসামাজিক বিবেচনায় অনেককেই খুশি করে চলতে হয়। তখন এটি প্রায়শই একটি ব্যর্থ অভিজ্ঞতা হয় কারণ তাঁরা বেসরকারি প্রশাসনের কার্যকলাপ এবং প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক সংস্কৃতি বোঝেন না। দুর্ভাগ্যবশত অধিকাংশ শিক্ষক তাঁদের স্বাভাবিক চুক্তি যথাযতভাবে সম্পন্ন করতে পারেন না। শিক্ষা অধিদপ্তরগুলোর আবস্থা সকলেরেই জানা ।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সততা এবং মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করেন প্রতিষ্ঠানের প্রধান। কিন্তু তিনি যদি শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে সহকর্মীদের ভালো না বোঝেন বা সম্মান না করেন, যার যে কাজ তাকে তা না দেন, তখন নতুন জ্ঞান তৈরির ক্ষেত্রে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য কেবল পরীক্ষায় পাশ-ফেল বা কেবল কৌশলী তৈরি করা নয়, বিশ্ববিদ্যালয় দেশে সভ্য সমাজ শিক্ষিত কর্মী ও পরবর্তী প্রজন্মকে মানবীয় গুণাবলীর জন্য তৈরি করে ।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের প্রশাসনের সমস্যা এত বেশি ও জটিল যে তা সমাধান দ্রুততার সাথে সম্ভব নয়। শিক্ষা সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্য প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। দুর্নীতি, দারিদ্রতা, অদক্ষতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় একা কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিভিন্ন ব্যর্থতার কারণে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের ক্রমনুসারে শিক্ষকরা যেখানে থাকার কথা আজ তাঁরা তা থেকে অনেক পিছনে।

শিক্ষাবিদদের ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে সামাজিক-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করা, উদার মনোভাবাপন্ন, নবীনদের নতুন ধারণা এবং অভিজ্ঞতাদের সমন্বয় সাধন, মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কার। প্রযুক্তি নিভর্রশীলতাই পারে শিক্ষাবিদদের প্রশাসনে সফলতা। মনে রাখতে হবে চোখের পলকেই পৃথিবী বদলে গেছে।এখন আমরা চর্তুথ শিল্প বিপ্লবে নতুন স্বাভাবিক বিশ্বে বসবাস করছি।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি ও
টেকসই উন্নয়নকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপরাধপ্রবণতায় নতুন মাত্রা ‘কিশোর গ্যাং’
পরবর্তী নিবন্ধচকরিয়ায় বাড়ির দরজা ভেঙে স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা লুট