মাতৃমঙ্গল : মাতৃসেবার এক অনন্য দৃষ্টান্ত

বিচিত্রা সেন | মঙ্গলবার , ১০ মে, ২০২২ at ৫:৪২ পূর্বাহ্ণ

‘মা’ শব্দটি পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম শব্দ। ‘মা’ এমন একটি আবেগের নাম যার সাথে কোনো অনুভূতিরই তুলনা চলে না। একজন মা-ই জানে মা হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে কতটা যন্ত্রণা। অথচ বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবারেই নারী মাতৃত্বকালীন শুশ্রূষা থেকে বঞ্চিত। চারপাশে অনেক নারী সংগঠন চোখে পড়লেও নারীদের মাতৃত্বকালীন সংকট নিয়ে কার্যক্রম খুব একটা চোখে পড়ে না। তবে এ সংকট কখনো কখনো কোনো পুরুষেরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তেমনি একজন মানুষ ইঞ্জিনিয়ার ড.গোলাম মোস্তফা সাহেব। তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন নারীদের মাতৃত্বকালীন সংকট। প্রথম সন্তান জন্ম দিতে তাঁর স্ত্রীর কোনোরূপ জটিলতা না হলেও দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তাঁর স্ত্রী নানামুখী জটিলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন।

গোলাম মোস্তফা সাহেব ভাবলেন,এত পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো সত্ত্বেও যদি তাঁর স্ত্রী এত জটিলতার সম্মুখীন হন,তাহলে পুষ্টিহীনতায় ভোগা আমাদের দরিদ্র নারীরা কীভাবে সুস্থ সন্তান জন্ম দেবে? ঠিক এ ভাবনা থেকেই তিনি তাঁদের জন্য কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করেন। প্রাথমিকভাবে তিনি তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীদের সহায়তায় চারজন দরিদ্র নারীকে বাছাই করেন এবং তাদের প্রত্যেককে দৈনিক আধা লিটার করে দুধ সরবরাহ করতে থাকেন। মজার ব্যাপার হলো সেই চারজন নারী বা তাদের পরিবার জানতো না কে তাদের এই দুধ সরবরাহ করছেন। কারণ ইস্পাহানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ড. গোলাম মোস্তফা কখনো চাননি তাঁর নামটি প্রচারিত হোক। এইভাবে ২০০০ সাল থেকে তিনি কখনো বা এককভাবে কখনো বা বিত্তবান বন্ধুদের সহায়তায় তাঁর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এলাকার দরিদ্র সন্তানসম্ভবা নারীদের পুষ্টিপ্রদান থেকে শুরু করে একেবারে কম খরচে নিরাপদে সন্তান জন্মদান পর্যন্ত বিষয়টি তদারক করতেন।

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের “মাতৃমঙ্গল” কার্যক্রমের সূচনা কিন্তু এইভাবেই। এটা কোনো গোষ্ঠীগত চিন্তার ফসল ছিল না। সম্পূর্ণ একক চিন্তায় ড. গোলাম মোস্তফা “মাতৃমঙ্গলে”র বীজটি বপন করেছিলেন। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে এই কার্যক্রমের প্রসার ঘটাতে তাঁরই প্রস্তাবে প্রকল্পটির দায়িত্ব হাতে তুলে নেয় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। তারা চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ খুলশির ০২ নম্বর রোডে ১২ নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে প্রাথমিকভাবে এ কার্যক্রম শুরু করে। এখানে একজন সন্তানসম্ভবা মা প্রেগন্যান্সির প্রথম মাস থেকে সেবা পেতে শুরু করেন। তাঁকে নিয়মিত চেকআপ করেন একজন ডাক্তার। কম সময়ে অধিক রোগীর সেবা নিশ্চিত করার জন্য এখানে তিনজন ডাক্তারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখানে শুধু চিকিৎসা দিয়েই কার্যক্রম শেষ হয়ে যায় না। মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য প্রতিদিন একটি করে ডিমের ব্যবস্থা করা হয়। সাথে দেওয়া হয় বিনামূল্যে ওষুধ। আছে আলট্রাসনোগ্রাফির ব্যবস্থা। প্রয়োজনে রক্ত ও প্রস্রাবও পরীক্ষা করা হয়। এই সেবা চলে সন্তান জন্মদানের পর আরও চল্লিশ দিন। যেখানে আমাদের দেশে প্রতিবছর ৭৩০০ মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় বলে এক জরীপে বলা হয়েছে, সেখানে এমন একটি উদ্যোগ সত্যি প্রশংসনীয়। ঈদের আগে একদিন প্রকল্পটি সরেজমিনে দেখতে গেলাম। দক্ষিণ খুলশীর দুই নম্বর রোডের নির্ধারিত ঠিকানায় গিয়ে তাঁদের কার্যক্রম দেখে সত্যি অভিভূত হলাম। একটি বহুতল ভবনের নিচতলায় বিশাল একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে মিনি হাসপাতালের মতো করে সমস্ত কার্যক্রমটি পরিচালনা করা হচ্ছে।

রমজানের দিন,তবুও তীব্র গরমকে উপেক্ষা করে দরিদ্র শ্রেণির নারীরা এসেছে সেবা নিতে। এত রোগী,অথচ কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। সারি সারি চেয়ারে একটা রুমে বসে আছে অপেক্ষমাণ রোগীরা। নাম ধরে ডাক দেওয়ার সাথে সাথে সে এগিয়ে যাচ্ছে নির্ধারিত কক্ষে। ডা. দেবেলা মল্লিক রায় এবং আরও দুজন চিকিৎসক তাদের পরীক্ষা করে প্রয়োজনবোধে পাঠিয়ে দিচ্ছেন আলট্রাসনোগ্রাফি করার রুমে। কাউকে হয়তো বা হিমোগ্লোবিন চেক করিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্র লিখে দিচ্ছেন। স্বেচ্ছাকর্মীরা আছেন,তারা হয়তো রোগীকে নিজেদের ভাষায় আরও একটু বেশি করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাদের কী কী করতে হবে। সব বুঝে নিয়ে রোগী যখন বেরিয়ে যাচ্ছে তখন তাদের চোখেমুখে পরিতৃপ্তির ছাপ। আর আমরা সবাই জানি মানসিক প্রশান্তি একজন মাকে সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে অনেক বেশি সহায়তা করে। ‘মাতৃমঙ্গল’ এর ডাক্তার থেকে শুরু করে প্রত্যেক সেবাকর্মী অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে হাসিমুখে সমাজের অবহেলিত নারীদের প্রতি এই সেবা দিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যক্ষদৃষ্টিতে যা দেখলাম,তাতে এই বিষয়ে নিশ্চিত যে এখানে যারা সেবাগ্রহণ করছে, তারা কেউ স্বাভাবিকভাবে প্রবল দারিদ্র্যের কারণে গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারতো না। তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো মৃত্যুমুখে পতিত হতো কিংবা অপুষ্ট বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিতো। কিন্তু ‘মাতৃমঙ্গল’ এর আওতায় আসাতে তারা সঠিক পরিচর্যায় একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে পারছে। যাতে উপকৃত হচ্ছে জাতি বা রাষ্ট্র।

২০০৫ সাল থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২২ সাল পর্যন্ত “মাতৃমঙ্গল” ২৭,২১৭ জন মাকে সেবা দিয়ে এসেছে। এ দুমাসে তার সংখ্যা আরও বেড়েছে। সমাজের নিপীড়িত দুঃস্থ মায়েদের বড় আশ্রয়স্থল ‘মাতৃমঙ্গল’। চট্টগ্রাম ছাড়াও রাজশাহী,খুলনা এবং ময়মনসিংহেও ‘মাতৃমঙ্গল’ তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা সবসময় দুঃখ করি আমাদের সমাজে মনুষ্যত্ববোধ দিন দিন লোপ পাচ্ছে বলে, কিন্তু “মাতৃমঙ্গল” এ সরেজমিনে গিয়ে এ দুঃখ অনেকটা লাঘব হয়েছে। অনেক মানুষ বিনা প্রচারণায় নিভৃতে দান করে যাচ্ছে এ কার্যক্রমে। জানতে পারলাম এ ফ্ল্যাটের ভাড়া থেকে যাবতীয় সরঞ্জামাদি ক্রয়,কর্মচারীদের বেতন, মায়েদের পুষ্টি, ওষুধ সব খরচ নির্বিঘ্নে সমাধা করা হয় মানুষের দানের টাকায়। এমন একটি মহৎ কার্যক্রমের যতটুকু প্রচার হওয়া দরকার, আমার ধারণা ততটুকু প্রচার হয়নি। আমি নিজেও এতদিন এ প্রকল্পটি সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলাম। এতদিন পর যখন এ কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারলাম,ভাবলাম এ মহৎ উদ্যোগটি চট্টগ্রামের জনপ্রিয় পত্রিকা “দৈনিক আজাদী”র মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিই।

আমরা যে ক্রমেই অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি না, ভেতরে ভেতরে যে অনেক মহান মানুষ, মহৎ প্রতিষ্ঠান মানবতার জন্য,জাতির জন্য,রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে যাচ্ছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ‘মাতৃমঙ্গল’ তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ কার্যক্রমটি যেন আরও বৃহৎ পরিসরে কাজ করতে পারে তার জন্য আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। যার যার সীমিত সাধ্য নিয়ে আমরা যদি অন্তত একজন দুঃস্থ মায়ের পাশেও দাঁড়াই,তবে হয়তো জীবনে একটি মহৎ কর্ম করার সুযোগ ঘটবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক; অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসময়ের প্রয়োজনে নারী পুরুষ কখনো ভেদ হয় না
পরবর্তী নিবন্ধঅপরাধপ্রবণতায় নতুন মাত্রা ‘কিশোর গ্যাং’