বিনা টিকেটে ট্রেনে চাপার পর আবার রেলের টিটিই’র বরখাস্তের ঘটনার কারণ হওয়া রেলপথমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আক্তার মনির স্বজনরা এখন দুষছেন সাংবাদিকদের।
ট্রেন টিকেট পরীক্ষক (টিটিই) শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী মনির ভাগ্নে ইমরুল কায়েস প্রান্ত রোববার এই ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের উপর ক্ষোভ ঝাড়েন।
তিনি বলেন, গত কয়েকদিন ধরে সংবাদকর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নে আমরা ‘বিরক্ত ও বিব্রত’।
তিনি বলেন, “আমরা সামগ্রিক বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছিলাম, অথচ সাংবাদিকরা সামান্য একটি বিষয়কে অহেতুক টানা-হেঁচড়া করেছেন।”
উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে এই যুবক বলেন, “আপনারা এই এ বিষয়টি নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করছেন, যেটা না করলেও পারতেন। আমি যা বলার, তদন্ত কমিটিকে বলেছি। আপনাদের সাথে আমার কোনো কথা নেই।”
পাবনার ঈশ্বরদীতে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় কার্যালয়ে তদন্ত কমিটির সামনে বক্তব্য দিতে এসেছিলেন প্রান্ত। টিটিই শফিকুলসহ প্রত্যক্ষ্যদর্শী কয়েকজনও বক্তব্য দেন তদন্ত কমিটির কাছে।
আলোচিত এই ঘটনার পর প্রান্তর বাড়ি ঈশ্বরদী পৌরসভার নূর মহল্লায় সংবাদকর্মীরা সংবাদ সংগ্রহে গেলে তাদেরও গালাগালি করেন ওই বাড়ির লোকজন।
বাংলাভিশনের সংবাদকর্মী জিয়াউল হক রিপন বলেন, “ওই মহল্লায় পৌঁছানোর পর পরই আমাদের দেখে তেড়ে আসে কয়েকজন যুবকসহ এক নারী। তাদের গালিগালাজের মুখে আমরা বাড়ির লোকজনের কথা না শুনেই ফিরে আসতে বাধ্য হই।”
ঈশ্বরদীর ওই বাড়ি প্রান্তের নানা বাড়ি। তার বাবা প্রবাসে থাকেন। মা ইয়াসমিন আক্তার নিপা সন্তানসহ নূর মহল্লায় বাবার বাড়িতে থাকেন।
নিপার ফুপাত বোন হচ্ছেন শাম্মী আক্তার মনি যার সঙ্গে গত বছর রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের বিয়ে হয়।
গত ৪ মে রাতে খুলনা থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেস’ ট্রেনে ঈশ্বরদী থেকে বিনা টিকেটে এসি কেবিনে ভ্রমণ করছিলেন প্রান্ত এবং তার দুই মামা হাসান ও ওমর। হাসান ও ওমর প্রান্তের মা নিপার চাচাত ভাই। সেই সূত্রে তারাও রেলমন্ত্রীর স্ত্রী মনির আত্মীয়।
টিটিই শফিকুলের ভাষ্য, সেদিন তিনি টিকেট চাইলে প্রান্তরা নিজেদের রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেন। তখন পাকশী বিভাগীয় রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শ অনুযায়ী তাদের জরিমানাসহ সুলভ শ্রেণির নন এসি কোচে সাধারণ আসনের টিকিট করে দেন।
তবে প্রান্ত টিটিই শফিকুলের বিরুদ্ধে অসদারণের অভিযোগ করার পর তাকে ফোন করে তাৎক্ষণিক বরখাস্তের আদেশ দেন পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিন।
বিনা টিকেটের যাত্রীদের ধরে টিটিই বরখাস্তের খবর ছড়িয়ে পড়লে রেলমন্ত্রী প্রথমে তার স্বজন থাকার কথা অস্বীকার করেন।
ব্যাপক আলোচনার মধ্যে রোববার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি স্বীকার করেন যে বিনা টিকেটে ভ্রমণকারী ওই তিনজন তার স্ত্রীর স্বজন যা তিনি আগে জানতেন না।
তার স্ত্রীর চাপে টিটিই শফিকুলকে বরখাস্ত করা হয়েছিল কি না, সেই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর রেলমন্ত্রী না দিলেও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, মন্ত্রী সুজনের স্ত্রীর কথায় টিটিইকে বরখাস্ত করা রেল কর্তৃপক্ষের সমীচীন হয়নি।
টিটিই শফিকুলকে বরখাস্তের আদেশ বাতিল করা হয়েছে জানিয়ে রেলমন্ত্রী বলেন, পুরো ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পাশাপাশি তড়িঘড়ি বরখাস্তের আদেশ দেওয়ায় রেলের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (পাকশীর ডিসিও) নাসির উদ্দিনকে নোটিস দিয়ে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।
রেলের পাকশী বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা (এটিও) সাজেদুল ইসলাম বাবুর নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটিকে পাঁচ দিন সময় দেওয়া হয়েছে।
সাজেদুল রোববার সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা অভিযোগকারী এবং অভিযুক্তের বক্তব্য গ্রহণ করেছি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য জানারও চেষ্টা করা হচ্ছে। অসদাচরণের ঘটনা ঘটেছে কি না, সেটি নিশ্চিত হতে সকল বিষয় গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
তদন্ত কমিটির উপরে কোনো ধরনের চাপ নেই বলেও দাবি করেন সাজেদুল।
এদিকে, তদন্ত কমিটিতে সাক্ষ্য দিয়ে টিটিই শফিকুল ইসলাম বলেন, “বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করায় আমি খুশি, শুকরিয়া আল্লাহর।”
তাকে বরখাস্ত করার কারণ হিসেবে ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ ও ‘মাদকাসক্ত’ হওয়াকে কারণ দেখিয়েছিলেন পাকশীর ডিসিও নাসির।
সে বিষয়ে শফিকুল বলেন, “ডিসিও স্যার কেন আমাকে মাদকাসক্ত ও মানসিক বিকারগ্রস্ত বললেন, আমি তা বুঝতে পারছি না। যেদিন আমি ওই রাতে গাড়িতে দায়িত্ব পালন করেছি, সেদিন আপ অ্যান্ড ডাউনে ৭৮ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় করে জমা দিয়েছি। বিকারগ্রস্ত ব্যাক্তির পক্ষে কি এমন কাজ করা সম্ভব?”