অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সেক্টরে পণ্য পরিবহনের আড়ালে কোটি কোটি টাকার পণ্য গায়েব করে দেয়া হচ্ছে। সংঘবদ্ধ একটি চক্র বিভিন্ন কৌশলে লাইটারেজ জাহাজ থেকে লুটের মালামাল ক্রয় করে। চাল, ডাল, তেলের পাশাপাশি স্ক্র্যাপ লোহার মতো পণ্যও লুট করার এক ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এমভি কফিল-১ নামের একটি জাহাজের গোপন খোপ থেকে গতকাল বিএসআরএম-এর আমদানিকৃত প্রায় ৪ লাখ টাকা দামের ৬ টন স্ক্র্যাপ উদ্ধার করা হয়েছে। জাহাজে কর্মরত শ্রমিকদের একটি অংশ পণ্য লুটের সাথে জড়িত।
অভিযোগে জানা গেছে, এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে ইউনিয়নের তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে। জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয়ার হুমকির মুখে একের পর এক পণ্য লুটের ঘটনা ঘটলেও আমদানিকারক এবং জাহাজ মালিকেরা অসহায় হয়ে উঠছে। পণ্য পরিবহনের আড়ালে পণ্য লুটের ঘটনায় ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের মাঝে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
পণ্য পরিবহনে লাইটার জাহাজের অনেকগুলোর বিরুদ্ধে পণ্য পরিবহনের আড়ালে পণ্য লুটের অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। জাহাজের হ্যাজের ভিতরে গোপন খোপ তৈরি করে তাতে পণ্য লুকিয়ে রাখা এবং পরবর্তীতে তা চোরাই মাল কেনাবেচার সাথে জড়িতদের নিকট বিক্রি করে দেয়া হয়। চোরাই পণ্য কেনাবেচার বেশ বড়সড় একটি চক্রও চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছে।
চট্টগ্রাম থেকে চলাচলকারী লাইটারেজ জাহাজগুলো একেকটি ১ থেকে ৪ হাজার টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করতে পারে। একটি জাহাজে দুই থেকে তিনটি হ্যাজ থাকে। এ সব হ্যাজে খোলা পণ্য বোঝাই করা হয়। কিন্তু পণ্য লুটে জড়িত জাহাজগুলোতে এই দুই বা তিনটি হ্যাজের বাইরেও গোপন খোপ তৈরি করা হয়। হ্যাজের পণ্য বোঝাইয়ের পর চক্রের সদস্যরা কৌশলে হ্যাজ থেকে পাশের খোপে নিজেদের ইচ্ছে মতো পণ্য সরিয়ে রাখে। গন্তব্যে গিয়ে পণ্য খালাস করা হলেও গোপন খোপের পণ্য জাহাজেই থেকে যায়। পরে সময়মতো তা বিক্রি করে দেয়া হয়। পতেঙ্গা এলাকায় জাহাজ থেকে নৌকার মাধ্যমে চোরাই মালামাল উপরে তোলা হয়। সার, গম, চাল, ডাল জাতীয় বিভিন্ন পণ্য লুটের ঘটনা বিভিন্ন সময় ধরা পড়েছে। কিন্তু গত বেশ কিছুদিন ধরে স্ক্র্যাপ লোহা লুটের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের স্ক্র্যাপের মূল্যবৃদ্ধির পর থেকে জাহাজে স্ক্র্যাপ লোহা চুরি আশংকাজনক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে।
এমভি কফিল-১ নামের জাহাজটিতে বিএসআরএম এর স্ক্র্যাপ পরিবহন করা হচ্ছিল। বিদেশ থেকে আনা স্ক্র্যাপগুলো বহির্নোঙরে মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারিং করে এমভি কফিল-১ এর মাধ্যমে নেভাল জেটিতে খালাস করা হচ্ছিল। বিএসআরএম এর পক্ষে এ এন জে ট্রেডিং পণ্য পরিবহনের ব্যাপারটি দেখভাল করছিল। জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের পর এএনজে ট্রেডিংয়ের মালিক শেখ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর গোপন সূত্রে খবর পান যে, বিপুল পরিমাণ স্ক্র্যাপ জাহাজটির গোপন খোপে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে জাহাজের খোপ থেকে অন্তত ছয় টন স্ক্র্যাপ বের করা হয়। জাহাজের মাস্টার বিষয়টির জন্য শ্রমিকদের দায়ী করে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না মর্মে লিখিতভাবে অঙ্গীকার করেন।
অভিযোগ করা হয়েছে, শুধু স্ক্র্যাপ লোহাই নয়, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের লুট করা পণ্য জাহাজের গোপন খোপে লুকিয়ে রাখার ঘটনা ঘটছে। দিনকয়েক আগে গম লুটের একটি ঘটনায় নোয়াপাড়ায় তুলকালাম হয়। প্রায় এক মাস একটি জাহাজ অলস বসিয়ে রাখার ঘটনা ঘটে। এর আগেও বিভিন্ন সময় পণ্য লুটের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। কোনো মামলা করা যায় না। শুধু লিখিত অঙ্গীকার নিয়ে ছেড়ে দিতে হয়। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে গেলেই শ্রমিকনেতাদের তোপের মুখে পড়তে হয়। জাহাজ জেটিতে ভিড়তে না দেয়া, ভিড়লেও কাজ বন্ধ করে রাখাসহ নানাভাবে জিম্মি করার ঘটনা ঘটে।
পরিবহনের আড়ালে কোটি কোটি টাকার পণ্য লুট করা হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে কার্গো এজেন্টস এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি শেখ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেছেন, ‘আমদানিকারকদের বিপুল পরিমাণ মালামাল চুরি করা হচ্ছে।
বিভিন্ন জাহাজে গোপন খোপ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের দাপটে আমদানিকারকেরা অসহায় হয়ে উঠছে। আমরা জিম্মি হয়ে আছি। দিনের পর দিন এ সব ঘটনা ঘটছে। অথচ চোরদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।’
বিষয়টি নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাদাত হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পণ্য পরিবহনের আড়ালে পণ্য চুরির ঘটনা সারা পৃথিবীতেই কমবেশি হয়। এটি শুধু নৌ সেক্টরেও নয়। সড়ক পথে আরো বেশি হয়। তিনি লাইটারেজ জাহাজে পণ্য চুরি হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, এগুলোর জন্য শুধু লাইটারেজ শ্রমিকেরা দায়ী নয়। আমদানিকারকেরা পাহারা দেয়ার জন্য স্কট দেন। স্কটের লোকেরাই পণ্য বিক্রির জন্য শ্রমিকদের প্ররোচিত করে। পণ্য বিক্রি করে স্কট পালিয়ে গেছে এমন বহু ঘটনাও ঘটেছে বলেও তিনি জানান। তিনি ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলে বিষয়টি নিয়ে অনেক শালিস বিচার করতে হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন। অপর একজন নেতা বলেন, এগুলো বিচ্ছিন্ন- বিক্ষিপ্ত ঘটনা। কোটি কোটি টন পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। দুচার টন পণ্য এদিক ওদিক হতে পারে। এ গুলো নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখির কী আছে! তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তেলের ট্যাংকারগুলো থেকে তো প্রতিদিন শত শত টন তেল চুরি হয়, নৌকা করে পাচার হয়, প্রকাশ্যে। ওসব নিয়েতো কোনো হৈ চৈ নেই। সামান্য স্ক্র্যাপ নিয়ে এত কথা বলার কি আছে বলেও তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেন।