সেদিন সুদূর নয়-
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!
জাতীয় কবি কাজী নজরুলের দৃষ্টিতে নারীর মূল্যায়ন কত সুন্দরভাবে প্রতিভাত হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নারীর অসীম ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা নিজেই তার মাঝে অঙ্কুরিত করেছেন। তাই যে কোনো নব সৃষ্টির মাঝে নারীর উপস্থিতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুপ্ত রয়েছে। যদিও আমাদের বিদ্বান নরগোষ্ঠী নিজেদের কর্ম প্রতিভা নিয়ে দম্ভ করেন, তবুও বলতে হয়, প্রত্যেক সফল মানুষের পেছনে একজন নারীর অনুপ্রেরণা অবশ্যই থাকে। তিনি হয়তো জননী, না হয় জায়া, না হয় কন্যা, না হয় পরম বন্ধু। কিন্তু নারী আজ তার স্নেহময়ী রূপের বাইরেও যে তার আরো একটি রূপ আছে তাকে চিনতে শিখেছে, আর তা হলো তার স্বকীয় সত্তা। নারী আজ তার স্বকীয় সত্তায় প্রতিষ্ঠিত হতে চায়, চায় নারী পুরুষের সমান মর্যাদা। কেননা নারীকে পুরুষ শাসিত সমাজ মর্যাদা দিতে বড়ই কৃপণ। নারী যেন শুধু অন্দরমহলের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। তথাকথিত কুসংস্কারের গণ্ডী পেরিয়ে নারীর বিকাশ আজ সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে যাচ্ছে। তাই নারীর বিচরণ আজ শুধু পিতৃ গৃহ বা পতি গৃহেই সীমাবদ্ধ নয়। নারী আজ তার ঐকান্তিক পরিচয় খুঁজে পেতে চলেছে। আর তার একমাত্র পরিচয় সে শুধু নারী নয়, রক্তে মাংসে গড়া সৃষ্টিকর্তার এক অনবদ্য সৃষ্টি।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কোথায় নেই তার বিচরণ। প্রতিটি উন্নয়নমূলক কাজে তার হাতের ছোঁয়া থাকবেই, থাকবে। নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের আহ্বানে সেই যে নারীর ভেতরের সুপ্ত বাসনাটুকু জেগে উঠল তার আর পরিসমাপ্তি হয়নি। বরং দিনের পর দিন তা নব নব রূপে জনমনে ধরা দিয়েছে। আজ আমরা গর্ব করে বলতে পারি একটি দেশ, যদিও বিশ্বের মানচিত্রে এখনও উন্নত দেশের মর্যাদা পায়নি তবুও একটি দেশে এত ক্ষমতা ধর নারী আর কোন দেশে আছে কিনা তা বিবেচ্য বিষয়।
দেশের অর্থনীতিকে বৈশ্বিক রূপে পরিচিত করতে অগ্রদূত হয়ে কাজ করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশকে ক্ষুধা মুক্ত, দারিদ্র্য মুক্ত সোনার বাংলা গড়ায় তাঁর লক্ষ্য। ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন, আর সেই সাথে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নত দেশ।
সমগ্র বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে পৌঁছে দিতে চাইছেন ইন্টারনেট সুবিধা। তাই নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে পুঁজি করে একটি দেশ যে কতটুকু অগ্রগামী হতে পারে তা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেখেই শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। আজ উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর পদমর্যাদা লক্ষণীয়। তাই নারীকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়।
আজ বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানীকারক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশে পোশাক শিল্প খাতে ৪ মিলিয়ন শ্রমিক কাজ করে যার ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ ২.৬ মিলিয়ন হচ্ছে নারী আর ৩৫ শতাংশ বা ১.৪ মিলিয়ন হচ্ছে পুরুষ। এই যে বিপুল সংখ্যক নারীর ক্ষমতা যার ৯৮ শতাংশ এর মধ্য দিয়ে তাদের স্বাবলম্বিতা প্রকাশ করেছে এবং ৯৩ শতাংশ পরিবারে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নিজের অবস্থান ও মর্যাদা বৃদ্ধির বহিঃপ্রকাশ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আজ নারীরা তাদের নিজেদের সন্তানদের লেখাপড়ার বিষয়ে, স্বাস্থ্য এবং বিবাহ পর্যায়ে, চাকুরি, পোশাক নির্বাচন, প্রসাধনী, পরিবার পরিকল্পনা ও স্বামীর চাকুরি নির্বাচন এবং মতামত গ্রহণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এখনো ৩৯ শতাংশ নারীর পশ্চাদগামীতা রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য এই ৩৯ শতাংশ নারীকেও সচেতন করে তুলতে হবে। প্রায় ১৩ শতাংশ জি ডি পি পোশাক খাত হতে আসে। তাছাড়া ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ পোশাক খাতে ৫০ বিলিয়ন ইউ এস ডলার রপ্তানি আয় অর্জনের রূপকল্প গ্রহণ করেছিল। যা মহামারী কোভিড ১৯ এর কারণে সম্ভবপর হয়নি। ২০১৯ সালে পোশাক খাতে রপ্তানি আয় ছিল ৩৪.১৩ বিলিয়ন ইউ এস ডলার, কিন্তু ২০২০ তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২৭.৯৫ বিলিয়ন ইউ এস ডলার। মহামারী ছাড়াও এই অর্জনের পরিপন্থী হল দক্ষতার অভাব। বিশেষ করে নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে এস ই আই পি (দি স্কিল ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম) হাতে নেয়া হচ্ছে যা বি জি এম ই এ (বাংলাদেশ গার্মেন্টস মেনুফেকচারারস এন্ড এঙপোর্টারস এসোসিয়েশান) এবং বাংলাদেশ অর্থ মন্ত্রণালয় যৌথ ভাবে বাস্তবায়ন করবে। এস ই আই পি কর্মসূচীতে ব্যয়িত হবে ১৩৮ মিলিয়ন ইউ এস ডলার যার একমাত্র লক্ষ্য দক্ষ শ্রমিক গঠন এবং যার ২৫ মিলিয়ন অর্থ সাহায্য দেবে বাংলাদেশ সরকার, ১০০ মিলিয়ন দেবে এ ডি বি ( এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক), ১০ মিলিয়ন দেবে এস ডি সি( দি সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট এন্ড কোপারেশান) এবং ৩.৫০ মিলিয়ন দেবে ইন্ডাস্ট্রি এসোসিয়েশান।
বি জি এম ই এ এপ্রিল ২০১৫ সালে এস ই আই পি এর সাথে একটি স্মারক চুক্তি সম্পন্ন করেছে, এবং জুলাই ২০১৫ তে যা উন্মোচিত হয়েছে এই উদ্যোগে যে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রায় ৪৩,৮০০ দক্ষ শ্রমিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হবে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বেসিক অপারেটর এর ৯০ শতাংশ প্রশিক্ষণার্থী হলেন নারী।
২০২১ সালের জি জি জি (গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ) অনুসারে ১৫৬ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৫তম। নারী বেকারত্বের হার ৬.৮ শতাংশ যা পুরুষের দ্বিগুণ (৩.৫ শতাংশ)। বেশির পক্ষে ৯৭ শতাংশ নারী ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করে যা বেকারত্বের ধারাকে অব্যাহত রেখেছে। গবেষণা করে দেখা গেছে যদি কর্মক্ষেত্রে নারী অংশগ্রহণের হার ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ করে বৃদ্ধি পায়। এই হার যত বাড়বে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে শিক্ষার হার ও বাড়াতে হবে। প্রাইমারি ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাশাপাশি তৃতীয় পর্যায়ের শিক্ষা ( টারশিয়ারি এডুকেশান) ও বাড়াতে হবে বিশেষ করে প্রযুক্তি ও এস টি ই এম (সাইয়েন্স, টেকনলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেথ) ক্ষেত্রে নারীর কর্ম করার সুযোগ ও ক্ষেত্র বাড়াতে হবে।
গবেষণারয় জানা গেছে, ২০১৮ সালে দেশে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণের হার ১৩.১০ শতাংশ থেকে কমে ৫.০৭ শতাংশ হয়েছে যা ২০১৩ সালে ৫.৫১ শতাংশ ছিল। সর্বোপরি নারী শ্রমিকের হার কমে ২০১৮ সালে ২৮.৫ শতাংশ হয়েছে যা ২০১৩ সালে ৩২.৮ শতাংশ ছিল। এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট এর সামপ্রতিক জরিপ অনুযায়ী তৈরি পোশাক শিল্প কারখানায় নারী শ্রমিকের অনুপাতের হার ৫৯.২ শতাংশ এবং পুরুষের ৬৫ শতাংশ। সর্বমোট ৪.২০ মিলিয়ন শ্রমিক গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করে। তার মধ্যে ২.৪৯ মিলিয়ন নারী এবং ১.৮২ মিলিয়ন পুরুষ। ৫ বছর আগেও সর্বমোট ৪.১ মিলিয়ন শ্রমিক কাজ করতো যেখানে নারী শ্রমিক ছিল ২.৫৯ মিলিয়ন আর পুরুষ ১.৪ মিলিয়ন। ২,১৯,০০০ শ্রমিক এই ৫ বছরে গার্মেন্টস সেক্টরে যোগদান করেছে। অর্থাৎ গড়ে ১.৮ শতাংশ প্রতি বছর যুক্ত হয়েছে। তার মধ্যে পুরুষের সংযুক্তি হয়েছে ৪.০ শতাংশ এবং নারীর অবসংযুক্তি হয়েছে ০.৬ শতাংশ। বিভিন্ন কারণে এই অধোগতি তার মধ্যে রয়েছে-
১। গার্মেন্টসে সাব কন্ট্রাক্টিং ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া;
২। বিভিন্ন কারণে নারীদের পার্ট টাইম চাকরি বন্ধ হয়ে যাওয়া;
৩। পুরুষের তুলনায় নারীদের কম যোগ্যতা সম্পন্ন ভাবা;
৪। ইন্ডাস্ট্রি ৪ এর প্রভাব;
৫। ফ্যাক্টরি গুলো নতুন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া।
নারীকে বাদ দিয়ে কখনো কোনো দেশের অর্থনীতির বিকাশ হতে পারে না। তাই অর্থনীতিতে যেমন নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি জাতীয় জীবনেও নারীর প্রতি সম্মান সূচক দৃষ্টি রাখতে হবে। নারীর আত্মসম্মান যাতে ক্ষুণ্ন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মহামারীর আঘাতের চাইতেও নারীর অসম্মানের আঘাত অনেক তীব্র। তাই দেশের উন্নয়নে আমি, আপনি সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। তবেই দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব নচেৎ নয়।
লেখক : পি এইচ ডি গবেষক, অর্থনীতি বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়











