জমিদারি প্রথা-আভিজাত্য থেকে অভিশাপে

বাসুদেব খাস্তগীর | সোমবার , ১১ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ

এতদঞ্চলে জমিদারি প্রথা ছিলো বহল আলোচিত একটি ব্যবস্থা। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় একসময় জমিদারি প্রথা ছিলো অনিবার্য একটি বিষয়। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও ইতিহাসের বিবর্তনে জমিদারি প্রথা বাঁকে বাঁকে নানা ধরনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। একসময় সমাজ ব্যবস্থায় জমিদারি প্রথাই ছিলো সমাজ ব্যবস্থার প্রধান নিয়ামক শক্তি। সমাজ বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় সেই জমিদারি বিলুপ্ত হলেও তাদের ঐতিহ্যমণ্ডিত সেই বাড়িঘরের এখনও নিদর্শন মেলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সেই জমিদারদের অনেকের জীবন-কাহিনি এখনও লোকে মুখে ফেরে রূপকথার কাহিনির মত। অনেকের কাছে ‘জমিদার’ শব্দটি অত্যাচারের সমার্থক। সহজ ভাষায় বলতে গেলে উচ্ছৃঙ্খল, স্বেচ্ছাচারী ও নিষ্ঠুর এগুলোই যেন জমিদারদের বিশেষণ। ধারণা করা হয় জমিদার ফারসি ‘যামিন’ (জমি) ও ‘দাস্তান’ (ধারণ বা মালিকানা)-এর বাংলা অপভ্রংশের সঙ্গে ‘দার’ সংযোগে ‘জমিদার’ শব্দের উৎপত্তি। মধ্যযুগীয় বাংলার অভিজাত শ্রেণির ভূমি অধিকারীদের পরিচয়ের জন্য নাম হিসেবে শব্দটি ঐতিহাসিক পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়। মোগল আমলে জমিদার বলতে প্রকৃত চাষির ঊর্ধ্বে সকল খাজনা গ্রাহককে বোঝানো হতো। বদরুদ্দীন উমর তার ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক’ গ্রন্থে প্রথম পরিচ্ছেদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পর্বে ‘মোগল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা’ সম্পর্কে আলোচনায় লিখেছেন ‘জমির ওপর রাষ্ট্র অথবা জমিদার জাতীয় কোন শ্রেণির দখলী স্বত্ব মোগল আমলে ছিল না। জমির সত্যিকার মালিক তখন ছিল তারই যারা নিজেরা গ্রামে কৃষি কার্যের দ্বারা ফসল উৎপাদন করতো। সে সময় যাদেরকে জমিদার বলা হতো তারা ছিল সরকারের রাজস্ব আদায়ের এজেন্ট মাত্র, ভূস্বামী বা জমির মালিক নয়।’ সুতরাং দেখা যায় মোঘলদের সময় বা তার পূর্ববর্তী শাসনামলেও বাংলায় প্রচলিত অর্থে কোনো জমিদার ছিল না। এ ধারণায় জমিদারগণ রাজস্বের চাষি ছিল মাত্র, তারা জমির মালিক ছিল না। জমির মালিক ছিল কৃষক। সে সময় জমির মালিকদের বলা হতো রায়ত বা চাষি। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রবর্তিত এক প্রকার ভূমি ব্যবস্থা নামই হচ্ছে জমিদারি প্রথা। এই জমিদারি প্রথার অধীনে একটি অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গাকে জমিদারিতে ভাগ করে বছরে খাজনা প্রদানকারী এক ধরনের ভূস্বামীদের হাতে ছেড়ে দেয়া হতো। এসব ভূস্বামীরাই সমাজ ব্যবস্থায় ‘জমিদার’ নামে পরিচিত ছিল। জমিদারেরা তাদের প্রজাদের কাছ থেকে ইচ্ছা মত কর আদায় করতে পারতো। এই সুযোগ ব্যবহার করে তৎকালীন জমিদারেরা শোষণ নিপীড়নের প্রতীক হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী শ্রেণির লোক ছিলো বিধায় তাদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার সাহস কারোরই ছিলো না। অনেক সাধারণ প্রজা জমিদার শ্রেণির রোষানলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে এলাকা ছাড়া হয়েছে এরকম উদাহরণ প্রচুর। জমিদার শ্রেণির মানুষেরা তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি এবং অর্থ বিত্তের জোরে অনেক ভালো কাজ সমাজের জন্য করেছেন সত্যি, কিন্তু অনেক জমিদার তাদের শোষণ নিপীড়নের জন্য সমাজের ঘৃণার পাত্র হিসাবে বিবেচিত হয়ে পুরো জমিদার শ্রেণির লোককেই প্রশ্নের মুখোমুখি করে তুলেছিলেন। সে শোষণের বাস্তবতা নিয়ে আমাদের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে নানা কালজয়ী নাটক গল্প উপন্যাস ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। বর্তমান সমাজের বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই সে কাহিনিকে রূপকথার কল্পকাহিনি মনে করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে, সেই শোষণের ইতিহাস নির্মম হলেও তা ছিলো বাস্তবতারই একটি চিত্র। সত্য যে ইতিহাসের এই জমিদার শ্রেণি থেকে সমাজ নানা উপকৃত হয়েছে। তাদের দ্বারা এখানে শিক্ষার বিস্তার হয়েছে ব্যাপক এবং তারা নানা ধর্মীয় কর্মকাণ্ডেরও বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। এ অঞ্চলের অনেক পুরানো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তাদের হাতেই গড়া। কৃষি ব্যবস্থা ও উৎপাদন ব্যবস্থাও জমিদার শ্রেণির ভূমিকা অগ্রগন্য। জমিদারি প্রথার প্রবর্তনের ইতিহাস থেকে জানা যায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর বাংলার মসনদে মূলত ইংরেজদের মদদপুষ্ট শাসকরা ক্ষমতায় বসে। তাদের অদূরদর্শী শাসনের ফলে বাংলায় সরাসরি ইংরেজ প্রতিনিধিরা আসতে শুরু করে গভর্নর জেনারেল রূপে। এরূপ দ্বৈত শাসনে বাংলার অর্থনীতি দ্রুতগতিতে ভেঙে পড়তে থাকে। সারা দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৭৭০ সালে সারা দেশ জুড়ে ভয়াবহ মন্বন্তর শুরু হয় যা ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) নামে পরিচিত। এরপর এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পাঁচশালা বন্দোবস্তের প্রবর্তন করে ওয়ারেন হেস্টিং। হেস্টিং প্রবর্তনকৃত এই বন্দোবস্ত ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হবার ফলে খাজনা দিতে না পেরে রায়তরা জমি ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। এরপর নিয়ে আসা হয় একশালা বন্দোবস্ত। এ সময় মূলত জমির দখল পেতো হিন্দু ব্রিটিশপ্রিয় পরিবারগুলো, তারা শিক্ষা দীক্ষায় তৎকালীন সমাজে অগগ্রসরমান জনগোষ্ঠী ছিলো। অপরদিকে শোষিত হতে শুরু করে সাধারণ অনগ্রসর কৃষকরা। পাঁচশালা ও একশালা বন্দোবস্ত ব্যর্থ হওয়ার পর গভর্নর জেনারেল হিসেবে এদেশে আসেন লর্ড কর্নওয়ালিশ, তিনি ইংল্যান্ডের জমিদার পরিবার থেকে এসেছিলেন। তিনি অনুভব করেন রাজস্ব আদায় ঠিক রেখে ব্রিটিশ অনুগত সমপ্রদায় তৈরির জন্য জমিদার প্রথা এদেশে আনতে হবে। ১৭৯০ সালে তিনি দশশালা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন যা ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিবর্তিত হয়। জমির মালিকানা চলে যায় ইংরেজদের অনুগত গোষ্ঠীর হাতে, যারা ‘জমিদার’ বলে সম্বোধিত হতো। এভাবে ইংরেজরা তাদের এদেশীয় দোসর তৈরি করে যারা উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে খুব বড় ভূমিকা রেখেছিলো। জমিদারি প্রথার ফলে বাংলায় বুর্জোয়া গোষ্ঠী তৈরি হয়। এক শ্রেণি থেকে অন্য শ্রেণি প্রভূতে রূপান্তরিত হয়। জমিদাররা কৃষকের থেকে খাজনা আদায় করত, এ সময় কৃষকরা যারা এক সময় জমির মালিক ছিলেন তারা দুঃখজনক ভাবে ভূমিদাসে পরিণত হন। খাজনা আদায়ের দায়িত্ব জমিদারের নায়েব-গোমস্তার হাতে ন্যস্ত হবার ফলে জবাদিহিতা ও অভিভাবকত্বের অভাবে সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। নায়েব-গোমস্তারা ইচ্ছামত অত্যাচার চালাতো কৃষকের ওপর। সে সময় দেশজুড়ে বিদ্রোহ-আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ১৮৫৯-৬১ সালে নীল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ঐ সময় সাধারণ মানুষের জীবন কতটা ভয়ানক ছিল তার কিছুটা জানা যায় মীর মোশাররফ হোসেনের বিয়োগান্তক নাটক ‘জমিদার দর্পণ’ ও দীনবন্ধু মিত্রের নাটক ‘নীলদর্পণ’ থেকে। এ কারণে এই নাটকগুলো তৎকালীন জমিদারদের ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালুর মাধ্যমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে তাদের করে দেয়া হলো জমির মালিক অথচ এই জমিদারেরাই একসময় ছিল খাজনা আদায়ের এজেন্ট মাত্র। এই জমিদারেরা খাজনার একটি নির্দিষ্ট অংশ ইংরেজদের কাছে পৌঁছে দিত। এর ফলে বাংলার কৃষক ও গরিব শ্রেণির ওপর নেমে আসে দেড়শত বছরের দুর্গতি। বাংলার কৃষকদের ওপর জমিদারদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের যে চিত্র তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় বিদ্যমান ছিলো তা জানলে গা শিউরে ওঠে। খাজনা দিতে না পারলে চর্মপাদুকা প্রহার,বংশকাষ্ঠাদি দ্বারা বক্ষঃস্থল দলন, খাপরা দিয়ে কর্ণ ও নাসিকা মর্দন, ভূমিতে নাসিকা ঘর্ষণ, পিঠে দু’হাত মোড়া দিয়ে বেঁধে মোচড়া দেওয়া, গায়ে বিছুটি দেওয়া, হাত পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা, কান ধরে দৌড় করানো, কাঁটা দিয়ে হাত দলন, গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড রোদে ইটের উপর পা ফাঁক করে দু’হাত ইট দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, প্রবল শীতের সময় জলে চুবানো, কারারুদ্ধ করে উপবাসী রাখা, ঘরের মধ্যে বন্ধ করে লঙ্কা মরিচের ধোঁয়া দেওয়াসহ বিভৎস ও বিকৃত এসব শাস্তি জমিদারি প্রথাকে অভিশপ্তে টেনে নিয়েছিলো।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের পতনের পর ১৯৪৮ সালের ৩১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের পার্লামেন্টে প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ নামে বিল পেশ করা হয়। ১৯৫১ সালের ১৬ই মে এই বিল পাস হয়, যার মাধ্যমে সুদীর্ঘ দেড়শ বছরের কালো জমিদারি প্রথার অবসান ঘটে। জমিদারদের তৎকালীন মানব কল্যাণের অনেকগুলো কাজ তাদের অত্যাচারের কারণে ম্লান হয়ে যায়। জমিদাররা হয়ে উঠেছিলো অত্যাচারের প্রতীক। শোষণ শাসন নিপীড়ন যেন জমিদার শব্দের সাথে সমার্থক কতগুলো শব্দ। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে জমিদারদের সে অত্যাচারের চিত্র ভুলে গিয়ে বর্তমানে অনেকের কাছে জমিদার শব্দটা এক ধরনের আভিজাত্য শব্দ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিছু জমিদারের ভালো কাজ এখনও সমাজে উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে আছে। কিন্তু অধিকাংশ জমিদারদের অতিরিক্ত নির্যাতন নিপীড়ন যেন ইতিহাস হয়ে কথা বলে এবং সাধারণ মানুষের অভিশাপেই যেন বিলীন হয়ে যায় এক সময়ের সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী সেই জমিদার শ্রেণি। যাদের অনেকেরই পরবর্তী প্রজন্মের জীবনধারা বড়ই করুণ। অনেকেরই বংশ পরম্পরায় কোন অস্তিত্বই নেই। এটাই ইতিহাসের বড় শিক্ষা। শোষণ নিপীড়ন সত্যিকারের শাসন ব্যবস্থার হাতিয়ার হতে পারে না এবং সেটা কখনও দীর্ঘ স্থায়ী হয় না। জমিদারি প্রথায় ইতিহাসের পরিক্রমায় দেখা যায় কালের বিবর্তনে সভ্যতার অনেক কিছুই এখনও ঠিকে আছে কিন্তু জমিদারি প্রথাটা যেন এক ধরনের অভিশপ্তের ছোঁয়া নিয়ে ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বিএম সি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপবিত্র রমযান মাসে দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধভার্চুয়াল লাইব্রেরি : শিক্ষার ক্ষেত্রে বয়ে আনবে নবযুগের সূচনা