স্মরণ: মৌলভী হাফিজুর রহমান বিএবিটি

আবদুল্লাহ আনছারী | বৃহস্পতিবার , ৭ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ

আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মৌলভী হাফিজুর রহমান বিএবিটি স্যারের দীর্ঘ কর্মজীবনে নানুপুরের প্রতিবেশী বলতে আমরাই ছিলাম। আমার ছেলেবেলা, কিশোর বেলা স্যারের বাড়িতেই কেটেছে। উঠোনের প্রতিটি দূর্বার গায়ে আমার চপল বিচরণ এখনো মধ্যরাতে দূর আকাশের চাঁদের মতোই উজ্জ্বল।
মনে পড়ে আমার টাইফয়েড হয়েছিল। প্রচণ্ড জ্বরের কারণে স্কুল যাওয়া হয়নি কয়েকদিন। একদিন রাতে হঠাৎ দেখি খালাম্মাকে নিয়ে স্যার আমাদের বাড়ি এসে গেলেন। বাবার সাথে আলাপ না সেরেই চলে এলেন আমার বিছানায়। আমি জ্বরের ঘোরেও স্যারকে দেখে দাঁড়াতে চাইলাম। তিনি ইশারায় শুয়ে থাকতে বললেন, সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। গায়ে হাত দিয়েই কেমন করে যেন জেনে গেলেন কতটা জ্বর হয়েছে। ঔষধ পথ্যের খবর নিলেন, দেখলেন। নিজে কমলার খোসা ছড়িয়ে আমাকে খাইয়ে দিলেন। স্যারের চোখ ভিজে এলো। এই প্রথম আমি দেখলাম একজন কঠোর নিয়ম শৃৃঙ্খলা মানা দেবদূতের অন্তরও কত সহজে বিচলিত হয়! আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। তখন অতটা না বুঝলেও এখন মনে হয় মানুষ খুব সহজেই বাচ্চা বয়স থেকেই ভালোবাসা আর আদরের ঘ্রাণ নিতে পারে! ঘৃণা আর ভালোবাসা চিহ্নিত করার এক অলিখিত অনুভূতি মানুষের সহজাত অভ্যাস।
পূর্ণিমার রাতে জোনাক পোকা হেথা সেথা উড়ে যেমন স্বপ্নীল পরিবেশ সৃষ্টি করে স্যারকে দেখলেই আমার ঠিক তেমনি মনে হতো, দেবদূত মনে হতো। দেবদূতকে দেখলেই আমার সকল অন্ধকার সরে যেতো! নারকেল পাতা ছুঁয়ে যেমন চাঁদের আলো লুটিয়ে পরে দুর্বার বুকে আমার মনেও জোৎস্না গলে পরতো। সে আলোক বন্যায় জোনাক উড়তো, হাসনাহেনা সুবাস ছড়াতো। আমার জগত উদ্ভাসিত হতো এক স্বর্গীয় প্রভায়!
তিনি আজীবন আলো ছড়িয়েছেন, বিলিয়েছেন। সার্টিফিকেট অর্জনের চেয়েও চরিত্র গঠনের প্রতি, জ্ঞানার্জনের প্রতি বিশেষ তাগিদ দিতেন। প্রায়ই বলতেন ‘ বড়কে বড় জানিয়া শ্রদ্ধা করিয়া, ছোটকে ছোট জানিয়া স্নেহ করিয়া, মানুষ হও’।
মনে আছে একদিন জনবহুল রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছিলাম, তখনো সাইকেল চালানো সম্পূর্ণ শেখা হয়নি। হঠাৎ কোথা থেকে যেন স্যার এসে পড়লেন। তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে সাইকেল সহ পড়ে গিয়েছিলাম। তিনি পাশ কেটে যেতে যেতে আঞ্চলিক ভাষায় বললেন ‘শিং ভাঙ্গ গোই’। অনেক পরে বুঝেছি তার অর্থ, এখনো পোষ মানানো হয়নি। পোষ মানিয়ে তারপর রাস্তায় চালানোর আদেশ দিলেন। আমি জানিনা কিভাবে গল্প কিংবা স্মৃতি কথা লিখতে হয়। এইসব কেবল গল্প নয়, জীবন থেকে সযত্নে তুলে আনা এক-একটি আলো কণা। এই সব আলোর মিছিলে আমি স্যারকে দেখি। তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন আমাকে, নিজের লেখা বাংলা উর্দু কবিতার পাণ্ডুলিপি দিয়েছিলেন। বেশ কিছু আধ্যাত্মিক কবিতা কিংবা গজলও ছিল তাতে। পরিতাপের বিষয় আমি তার যথাযত মর্যাদা করতে পারিনি।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর পারিবারিকভাবে শহরে চলে এলেও মাঝে মাঝে গ্রামে গেলেই স্যারকে দেখতে যেতাম। বাজারে দেখা হলে তিনি বাড়িতে পাঠাতেন, আজ বুঝতে পারি দায়িত্ব ও কর্তব্য শিক্ষা দেয়ার জন্যই তিনি তা করতেন।
সকল মানুষের জীবনেই কেউ একজন থাকে, শেখার জন্য, অনুসরণের জন্য, দেখার জন্য, স্বপ্নের জন্য। সেই কেউ একজনকে অবলম্বন করেই মানুষ বেড়ে উঠে। এই ছায়ামানব যার যেমন তার চরিত্রের প্রকাশও তেমনই হয়। এমনই মনে হয় আমার। আমার জাগতিক সেই ছায়ামানব বা দেবদূত যাই বলি তা আমার স্যার মৌলভী হাফিজুর রহমান বিএ,বিটি।
একাকী দিনগুলোতে আমি আমার ছায়ামানবের দোয়া, স্নেহ, ভালোবাসা পেয়েছি। এখনো মাঝে মাঝে দেখি আলোর আকাশ থেকে উজ্জ্বল আলোক কণাটি আমার হাত ধরে খুব আদরে কাছে ডেকে নিচ্ছেন। গ্রামে পুকুর হতে হাত জাল দিয়ে মাছ তুলে আনার পর জাল থেকে মাছ বাছার মতো আমার সুখপ্রহর গুলো একটা একটা করে সযতনে বুকের পাঁজরে পুঁতে দিচ্ছেন। যেন বৃক্ষ হয়ে বিস্তার লাভ করে। লোভের পুকুরে ডুবে যাওয়া আমাকে হাত ধরে পরম স্নেহে মানবিকতার কূলে তুলে নিচ্ছেন। আমি জোনাকী পোকার মতো সে আলো অন্ধকারে ছড়াতে ছড়াতে উড়ে উড়ে বেড়ায় শহরময়।
উড়ছি আমার সুখবন্যা নিয়ে আর আমার ছায়ামানব অনেক উপর থেকে দেখে মিষ্টি মিষ্টি হাসছেন…..এ হাসির অর্থ ভালোবাসা বলেই জানি আমি। ভালোবাসি স্যার। খুব ভালোবাসি আপনাকে!
লেখক : মৌলভী হাফিজুর রহমান বিএবিটি’র প্রাক্তন ছাত্র

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাজের পরিধি বাড়লে জীবনের গতি বাড়বেই
পরবর্তী নিবন্ধকর্ণফুলী বাঁচাতে ও জলাবদ্ধতা রোধে নগরপিতার বিশেষ উদ্যোগ