স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আবৃত্তির বিকাশ বিস্ময়কর। আবৃত্তি শিল্পীরা শুধুমাত্র শিল্পচর্চার মধ্যে তাদের কর্মসূচি সীমাবদ্ধ না রেখে দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সকল আন্দোলন-সংগ্রাম ও বাঁক-পরিক্রমায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে চলেছে। আবৃত্তি এখন স্বতন্ত্র একটি শিল্পকলা; সুসংগঠিত শিল্পমাধ্যম। আশির দশকে ঘোর কৃষ্ণকালে স্বৈরাচারের বুটের আঘাতে আক্রান্ত মুক্তবুদ্ধি, মানবতা। বিক্ষুব্ধ সেই কালের গর্ভে তারুণ্যের স্পর্ধা নিয়ে রচিত হয় প্রমার পরিকল্পনা।
১৯৯০ সালের ২৯ নভেম্বর প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের আবির্ভাব। চিন্তা ও চর্চার মাঝে জড়িয়ে আছে প্রমার পরিচয়। প্রেমে-শ্রমে-ঘামে, দ্রোহে ও সংগ্রামে প্রতি মুহূর্তে প্রমা আছে মানুষের পাশাপাশি। মানুষের অধিকার আদায়ে আবৃত্তি সৈনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে-এই উপলব্ধি থেকেই আবৃত্তি শিল্পী রাশেদ হাসানের নেতৃত্বে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ নিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রমা আবৃত্তি সংগঠন। বাংলাদেশে আবৃত্তি শিল্পের বিকাশ পর্বে প্রতিটি অধ্যায়ের সাথে গত প্রায় তিন যুগ ধরে নিবিড়ভাবে যুক্ত রয়েছে প্রমা। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অপরিহার্য একটি নাম প্রমা আবৃত্তি সংগঠন। সংগঠনটি নিজেদের শুধুমাত্র মঞ্চে সীমাবদ্ধ রাখেনি, দেশের যেকোনো ক্রান্তিকালে শোষণ, নিপীড়ন, অবিচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সবসময় সামনের সারিতে থেকেছে রাজপথে। মঞ্চে ও রাজপথে প্রমা কাজ করেছে দায়বদ্ধতা, সততা, শুদ্ধতা, যোগ্যতা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা নিয়ে।
শিল্পের মান নিয়ে কখনো আপোষ করেনি প্রমা। চর্চাকেই সামনে এগিয়ে যাওয়ার মূল মন্ত্র হিসেবে নিয়ে কাজ করে গেছে তারা। প্রমিত উচ্চারণে বাংলা ভাষা সুন্দর করে বলার মানসিকতা ও দক্ষতা তৈরির কাজটি নিরলসভাবে বছরের পর বছর করে যাচ্ছে। জন্মলগ্ন থেকেই প্রমার পরিবেশনা বহুমাত্রিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। মার্চ মাসে আয়োজন করছে স্বাধীনতা উৎসব। উৎসবে প্রতি বছর দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে প্রদান করে সম্মাননা। বুদ্ধিজীবী হত্যার কালরাতে প্রমার কর্মীরা শহীদ মিনারে সমবেত হন ‘মৃত্যুঞ্জয়ী রাতের শপথ’ নিয়ে।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যু দিন স্মরণে আয়োজিত হয় ‘শহীদ জননীর মৃত্যু নাই, মুক্তিযুদ্ধের শেষ নাই’ শিরোনামে শ্রদ্ধানুষ্ঠান। কবি শামসুর রাহমানের মৃত্যু দিনে অনুষ্ঠিত হয় ‘তুমি নিশ্বাস তুমিই হৃদস্পন্দন’ শীর্ষক আয়োজন। প্রথাবিরোধী সাহিত্যিক ও ভাষাবিদ হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে থাকে ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ শিরোনামে স্মরণ অনুষ্ঠান। এছাড়া শ্রাবণের প্রথম দিবসে ‘শ্রাবণে কবিতার আড্ডা’ এবং বসন্তের প্রথম দিন বসন্ত উৎসব আয়োজন করে প্রমা। প্রতি মঙ্গলবার ‘প্রাণের সাধন’ নামে প্রমার কবিতা পাঠের আসর অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ‘শ্রবণ কথন সমীক্ষণ’ নামে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করে প্রমা।
প্রমার নিজস্ব শিল্পীদের চর্চা ও প্রস্তুতির জন্য রয়েছে দুটি প্ল্যাটফরম। নবীন শিল্পীদের অভিষেক মঞ্চ হলো ‘হৃদয়ে শুনি কবিতার ধ্বনি’। উদীয়মান শিল্পীদের জন্য রয়েছে প্রমার নিয়মিত আবৃত্তি আয়োজন ‘কালের পথে কাব্যরথ’।
প্রমার পূর্ণাঙ্গ আবৃত্তি প্রযোজনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আনিসুল হকের উপন্যাস অবলম্বনে ‘মা’, সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা অবলম্বনে ‘পরাণের গহীন ভিতর’, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা অবলম্বনে ‘স্মৃতি একাত্তর’, গ্রন্থিত প্রযোজনা জননী বাংলা, মানুষ জাগবে ফের, চিরকালের প্রমিথিউস, জসীম উদ্দীনের কাব্য অবলম্বনে সোজন বাদিয়ার ঘাট, ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে কাব্যপালা মহুয়ার পালা, শিশুদের অংশগ্রহণে শিশুতোষ অনুষ্ঠান স্বপ্নে হারাই অচিনপুর, ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, ভাবি যাহা মনে এবং রাম রাবণের ছড়া। স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীতে প্রমা মঞ্চে এনেছে নতুন প্রযোজনা ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’।
প্রমা আবৃত্তি উৎসবে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ কলকাতার শীর্ষস্থানীয় আবৃত্তি শিল্পী ও সংগঠন অংশগ্রহণ করে। নিজস্ব উৎসব আয়োজনের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক আবৃত্তি উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে তাদের প্রযোজনা পরিবেশন করে। উল্লেখযোগ্য উৎসবগুলো হলো বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ আয়োজিত জাতীয় আবৃত্তি উৎসব। ১৯৯২ সাল থেকে জাতীয় এই মোর্চাটির সদস্য প্রমা। এছাড়া দেশের প্রায় প্রতিটি বিভাগীয় শহর ও অনেক জেলা শহরে প্রমা একক ও দলীয় পরিবেশনা উপস্থাপন করেছে। একই সাথে দেশের বাইরে ভারতের কলকাতা ও ত্রিপুরায় একাধিকবার মঞ্চে আবৃত্তি প্রযোজনা উপস্থাপন করেছে প্রমা। মঞ্চের পাশাপাশি বেতার, টেলিভিশনে রয়েছে প্রমার সক্রিয় অংশগ্রহণ।
বাচিক শিল্পের প্রসারের লক্ষ্যে প্রমা পরিচালনা করে চার মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। এই কর্মসূচির আওতায় পাঁচ হাজারের অধিক প্রশিক্ষণার্থী আবৃত্তির প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেছে।
বর্তমানে কর্মশালার ৫২তম আবর্তন চলছে। আবৃত্তির জন্য আছে নির্বাচিত কবিতা সংকলন বই।
প্রমা ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার আবৃত্তি সংগঠন কবিতালোক ধারাবাহিকভাবে ২০১৫ সাল থেকে নিয়মিত ‘অভিন্ন হৃদয়ে কবিতার ধ্বনি’ নামে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছে, যা চট্টগ্রাম ও আগরতলা দুই শহরে পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হয়।