শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন, ‘কবিগুরু, তোমার প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই’। হাজার বছরের পরাধীন জাতির জন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বিনির্মাণে যে ত্যাগ আর ভালোবাসার উপমা স্থাপন করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা এক সীমাহীন বিস্ময়। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে মহান নেতার ঘোষণায় যে স্বাধীন দেশ পেলাম তা বাঙালি জাতির জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। রক্ত কমলে গাঁথা মালা তাঁদের তরে যারা বলীদান হয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে। তাঁরা নেই কিন্তু তাঁরা শক্তি ও সাহস হয়ে বারবার ফিরে আসেন যখন বাংলাদেশ হোঁচট খায়। যখন বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতার মুখোমুখী হয় তখন। যখন বাংলাদেশে সহিংসতার বিষবাষ্প ছড়ানো হয়, তখন।
সকল মুক্তির পেছনে রয়েছে ত্যাগের ইতিহাস। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনেও রয়েছে রক্ত ও পোড়ামাটির ইতিহাস। রয়েছে ৩০ লক্ষ শহীদ, ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি আর কোটি মানুষের শরণার্থী জীবন-যাপনের ইতিহাস। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। পাকিস্তানি সেনা যারা এ নারকীয় গণহত্যা চালিয়েছিল আমরা এখনো তাদের বিচার করতে পারিনি। মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিং-এর ‘দি লিবারেশন অভ বাংলাদেশ’ গ্রন্থের তথ্যানুযায়ী ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর ৯১,৫৪৯ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধবন্দীর মধ্যে ১৯৫ জনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। আমরা এদের বিচারের জন্য কী উদ্যোগ নিয়েছি? আমরা আমাদের বক্তব্য এখনো বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি।
১৯৭২ সালে ওরিয়ানা ফালাচিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশে সংঘটিত হওয়া গণহত্যা নিয়ে মিথ্যাচার করেন। ‘ইন্টারভিউ উইথ হিস্ট্রি’ নামে এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। সাক্ষাৎকারটি হাসান ফেরদৌস তাঁর ‘১৯৭১: বন্ধুর মুখ শত্রুর ছায়া’ বইতে তুলে ধরেন। ভুট্টো ওরিয়ানা ফালাচিকে বলেন- ‘শুনুন ভারতীয় সাংবাদিকদের মতে, সে রাতে ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষ মারা যায়। কোনো মিশনারির মতে, এ সংখ্যা হাজার তিরিশেক। আমি নিজে যা জানতে পেরেছি তা হলো, হাজার পঞ্চাশেক।’ ভুট্টো ২৫ মার্চ গণহত্যা সংঘটিত হয়নি বলে উল্লেখ করে বলেন, হাজার পঞ্চাশেক লোক মারা গেছে যা জাস্টিফায়েড বা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। পুরো সাক্ষাৎকার জুড়েই ভুট্টো দম্ভভরে মিথ্যাচার করেন। শরণার্থীর সংখ্যা ২ মিলিয়নের স্থলে ১০ মিলিয়ন বলেছেন বলে ইন্দিরা গান্ধিকে মিথ্যুক বলেন। মুজিব সম্পর্কে বিষোদগার করেছেন। মিথ্যার অপঘাতে সত্য আজ ক্ষীয়মাণ।
ভুট্টোর মতো মিথ্যাচারিতা কি এখনো বাংলাদেশে হচ্ছে না? ভুট্টোদের প্রেতাত্মা কি এতো বছর পরেও ফিরে ফিরে আসছে না? ধর্মের দোহাই দিয়ে যে রাষ্ট্রের পত্তন করা হয়েছিল মহামূর্খের মতো তার সাফাই গেয়ে ভুট্টো বলেন, ‘রাষ্ট্র তো কেবল ভৌগোলিক সীমানা নির্ভর ধারণা নয়। যখন জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত ও ধর্ম অভিন্ন, তখন দূরত্ব কোনো সমস্যা নয়’। ১৯৭২ সালের ঐ সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, আগামী ১০-১৫ বছরে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ একটি ফেডারেশন হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হবে’। ৭৫ পরবর্তী সময়ে সে রোগের লক্ষণ আমার দেখেছি। লেখক ও সাংবাদিক হাসান ফেরদৌস ভুট্টো সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কনজেনিটাল লায়ার কথার বাংলা কী? জন্মমিথ্যুক? নাকি পাঁড় মিথ্যাবাদী? যেভাবেই বলি না কেন, জুলফিকার আলী ভুট্টো কনজেনিটাল লায়ার ছাড়া আর কিছু নন’।
এমন কনজেনিটাল লায়ার এখনো বর্তমান। যারা আমাদের মাঝেই ঘুরে বেড়ায়। তাদের অনেকেই অধিষ্ঠিত, প্রতিষ্ঠিত ও বিশিষ্ট। ৫০ বছর আগে জুলফিকার আলী ভুট্টো যে কনফেডারেশনের কথা বলেছেন এরা এখনো সে স্বপ্নে বিভোর। ভুট্টোর লেখা বই ‘দ্য গ্রেট ট্রাজেডি’তে আছে, ইয়াহিয়ার প্রধান উপদেষ্টা জেনারেল পীরজাদা আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে ভুট্টো বলেন, ‘সিসেশন’। বিচ্ছেদ। অথচ বালুচ জাতীয়তাবাদী নেতা শেরবাজ খান মাজারির আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘এ জার্নি টু ডিজইল্যুশনমেন্ট (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচি, ১৯৯৯)-এ আছে, ‘সমালোচকেরা যেমন দাবি করে থাকেন, আওয়ামী লীগ দেশ ভেঙে আলাদা একটা দেশ গড়তে যাচ্ছিল। সে অধিকারও তাদের ছিল। সে চেষ্টাকে ‘সিসেশন’ বলা যায় না, কারণ সিসেশন বা দেশ বিভক্তি হলো যখন দেশের বৃহত্তম অংশ থেকে (ক্ষুদ্র কোনো অংশ) বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাঙালিরা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল (পৃ.১৯৯)।’
সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও আমরা দমন-পীড়ন ও গণহত্যার শিকার হয়েছি। এ গণহত্যা এখন ভুলে যাওয়া গণহত্যায় পরিণত হয়েছে। আমাদের চেতনা লোপ পেয়েছে। আমরাও কি গণহত্যাকে জাস্টিফায়েড বা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলে ধরে নিয়েছি? এজন্যই কি বিচারের দাবি উত্থাপন করছি না? হুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহি নাটকে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, একজন মানুষকে হত্যা করলে তার ফাঁসি হবার একটা সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করলে তার কিছুই হয় না, বিচার তো দূরের কথা। পর্ব-০৭। নব্বইয়ের দশকের বৈরি পরিবেশেও বিচারের দাবি উত্থাপন করা গেলে এখন কেন নয়?
বর্তমানে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা নিজের পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন। দেশ মাতৃকার জন্য আত্মত্যাগকারী শহীদের সন্তান-সন্ততি নিজেকে লুকিয়ে রাখেন ‘কোটারি’ অভিধায় অভিহিত হওয়ার অপমানে। যারা বুলেটবিদ্ধ হয়ে বেঁচে আছেন, পাক হানাদারদের পোড়ামাটি নীতির শিকার হয়ে ঝলসে যাওয়া দেহ নিয়েও দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠের পানে তাকিয়ে কৃষকের মুখে হাসি দেখে, পাতা-ফুল-ফলে শোভিত বৃক্ষে পাখির কলরব শুনে, স্কুল অভিমুখে শিশুদের যাওয়া দেখে বুক ভরে শ্বাস নেন আর পরম শান্তি অনুভব করেন; তারা কি রাজাকারের প্রতিষ্ঠা আর জাতীয়বীরদের অপমানে দুঃসহ কষ্টে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন না? যাদের আত্মত্যাগে আজ আমরা নিজেদের ভাগ্যবান জাতি হিসেবে স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ডে অবাধে বিচরণ করছি তারাই আমাদের স্মৃতিতে নেই। কেউ কেউ তাদের স্মরণ করছেন হাসি-তামাশায়।
লে. জেনারেল জে এফ আর জেকবের সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অভ এ নেশন (১৯৯৯) বইয়ের বর্ণনায় পাই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমাতে নির্মিত ওয়ার মেমোরিয়ালের প্রস্তরে খোদাই করা আছে, ‘হোয়েন ইউ গো হোম, টেল দেম অভ আস এন্ড সে, ফর ইউর টুমরো, উই গেইভ আওয়ার টুডে।’ (তোমাদের প্রিয়জনদের কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে আমাদের [এই] কথা বলো যে, ‘তোমাদের ভবিষ্যতের জন্য আমরা আমাদের বর্তমান বিসর্জন দিয়েছি’।) আমাদের শহীদদের প্রস্তর ফলকের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা, ‘হিসেবের খাতা যখন নিয়েছি হাতে, দেখেছি জমা রক্ত খরচ তাতে’। অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এ দেশ। এ রক্তের ঋণ আমাদেরই শোধ করতে হবে।
লেখক: পাবলিসিটি অফিসার, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)











