বিস্তার চট্টগ্রামের আয়োজনে চট্টগ্রামে মার্চের ১৪, ১৫, ১৬ এই তিন দিনে মঞ্চায়িত হলো ‘স্পর্ধা ইন্ডিপেন্ডেন্ট থিয়েটার কালেকটিভ’ এর নতুন নাটক ‘বিস্ময়কর সবকিছু’। প্রসঙ্গত- ডানকান ম্যাকমিলান এর ‘এভরি ব্রিলিয়ান্ট থিং’ সামপ্রতিককালের আলোচিত একটি ব্রিটিশ নাটক যা ইন্টিমেট থিয়েটার ফর্মে ইউরোপের বিভিন্ন মঞ্চে গত ১০ বছর ধরে নিয়মিত মঞ্চায়িত হচ্ছে। প্রযোজনাটির আঙ্গিকগত কোনো পরিবর্তন না করেই বাংলাদেশের দর্শকদের সামনে ‘বিস্ময়কর সবকিছু’ নামে উপস্থাপন করেছেন অধ্যাপক ডক্টর সৈয়দ জামিল আহমেদ। গত দশকের শেষভাগে রিজওয়ান নাটক নিয়ে দুই যুগ পর জনসম্মুখে ফিরে আসা নাট্যকলার এই মেধাবী অধ্যাপক বেশ কয়েকটি ভিন্নমাত্রার প্রযোজনা উপহার দিয়েছেন যার সর্বশেষ সংযোজন ‘বিস্ময়কর সবকিছু’।
নাটকটি দেখার আগেই একটি কথা বারবার শুনে আসছিলাম। যারা দেখেছেন তারা বলছিলেন একটি নতুন নাট্য-আঙ্গিক এর কথা, ড্রয়িং রুম থিয়েটার। অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে হলঘরে এলাম। নাটক শুরুর পরপরই বুঝতে পারলাম এটি ইন্টিমেট থিয়েটার। প্রথম থেকেই দলটি স্বল্প দর্শক নিয়ে বিভিন্ন ড্রইংরুমে প্রদর্শনীর আয়োজন করে আসছিল- যার উদ্দেশ্য ছিল হয়তো হল নির্ভরতা বা হল নিয়ন্ত্রণ এর রাজনীতি থেকে বের হয়ে প্রদর্শনীর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় কাজটি করা হয়েছে তাতে ইন্টিমেট থিয়েটার এর সাথে অপরিচিত দর্শক সাধারণের মাঝে ধরণটি ড্রইংরুম থিয়েটার নামেই প্রচার লাভ করেছে।
চট্টগ্রামে শেষদিন ১৬ মার্চ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় শিল্পকলা একাডেমীর গ্যালারি হলে ৬০ থেকে ৬৫ জন দর্শকের উপস্থিতিতে। এর আগের দুইদিন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় এই শহরেরই দুই ড্রইংরুমে। প্রদর্শনীর শুরুতে অভিনেত্রী মোহসিনা জানান এটি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দর্শক নিয়ে আয়োজন। নির্দেশনা ছিল প্রদর্শনী শুরুর আধা ঘণ্টা আগেই আসন গ্রহণ করতে হবে এবং ১৫ মিনিট পূর্বে হল ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। সেইমতো আসন গ্রহণের সাথে সাথেই অভিনেত্রী দর্শকদের হাতে একটি করে কার্ড ধরিয়ে দিলেন যার সবগুলিতে একটি নাম্বার আর একটি বিস্ময়কর কিছু লেখা ছিল। একটি ১০ থেকে ১৫ ফুট কার্পেটের চারপাশে বসে দর্শক তার নির্দেশনা অনুসরণ করেছিলেন। নিশ্চিত হওয়া গেল ওই অংশটুকুই অভিনয়ের স্থান এবং মাঝখানের বঙটি একমাত্র সেট প্রপস।
অভিনয় শুরুর পরই স্পষ্ট হলো শুধু মোহসিনা নন চারপাশের দর্শকেরাও নাটকের অংশ এবং কেউ কেউ অভিনেতাও। মোহসিনা তার গল্প বলে চলেছেন আর গল্পের প্রয়োজনে দর্শক সারি থেকে বেছে নিচ্ছেন সামঞ্জস্যপূর্ণ অভিনেতা এবং তাৎক্ষনিক অভিনেতারাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা কাটিয়ে তার সাথে সাবলীল হয়ে উঠছেন দ্রুতই- দৃঢ় হচ্ছে গল্প। গল্পটি একটি মেয়ের যে তার সাত বছর বয়সে প্রথম প্রত্যক্ষ করে মায়ের আত্মহননের প্রবণতা- যা চলতে থাকে। মাকে জীবনের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে মেয়েটি সাত বছর বয়েসেই তালিকা তৈরি করতে শুরু করে জীবনের বিস্ময়কর সবকিছুর। তার আকাঙ্ক্ষা ছিল এগুলো তার মাকে জীবনের প্রতি আগ্রহী করে তুলবে। মেয়েটি বড় হয় প্রেমে পড়ে বিয়ে করে- আবার তার জীবনেও বিচ্ছেদ ঘটে। এর মাঝেই মায়ের করুণ পরিণতি ঘটে আত্মহননের মধ্য দিয়ে। কিন্তু মেয়েটি জীবনের কঠোর বিষাদের ভেতর দিয়ে যাত্রার পরও জীবনের প্রতি আগ্রহ হারায় না- বরং ঘুরে দাঁড়ায় বারবার। বিস্ময়কর পৃথিবীর বিস্ময়কর সবকিছুর তালিকা তৈরি করা চলমান থাকে। যা মানুষকে বাঁচতে শেখায় প্রত্যয়ী হতে শেখায়।
জামিল আহমেদের নাটক মানেই বিশাল ব্যয়বহুল সেট, পোশাক, আলো আর চমকের সমন্বয়- প্রচলিত এই ধারণার বিপরীতে প্রযোজনাটি এক দারুণ প্রত্যুত্তর। শুধুমাত্র ফ্লাডলাইটের মধ্য দিয়ে একটি ছোট বঙ ব্যবহার করে দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে এবং দর্শকদের সম্পৃক্ত করে প্রায় দু’ঘণ্টা দর্শককে আবদ্ধ রাখলেন তিনি পূর্ণ মনোযোগে। এখানে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল মোহসিনার স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়, তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনের সক্ষমতা, দর্শককে সম্পৃক্ত করে নিয়ন্ত্রণে রেখে গল্পের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার বুদ্ধিমত্তা এবং শারীরিক সামর্থ্য। মেয়েটির সাবলীল অভিনয় দক্ষতা চট্টগ্রামের দর্শক মনে রাখবে সুনিশ্চিত। সামপ্রতিক সময়ে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মঞ্চে যে সমস্ত একক অভিনয় সমৃদ্ধ নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে তার কোনটির ব্যাপ্তি এত লম্বা সময় নয়। প্রারম্ভিক পর্ব থেকে বিবেচনা করলে মোহসিনা দুই ঘণ্টার বেশী সময় সম্পৃক্ত ছিলেন। তদুপরি বাড়তি চ্যালেঞ্জ ছিল দর্শকসারি থেকে অভিনেতা বেছে নেয়া এবং তাদেরকে গল্পের ধারাবাহিকতায় সমন্বিত রাখা। এর বাইরেও তিনি দর্শকের সাথে প্রত্যক্ষ কথা বলে যোগাযোগ ধরে রেখেছেন। একসাথে সবগুলি ইন্দ্রিয় সজাগ রেখেই তাকে তা চালিয়ে নিতে হয়েছে। নাটকটির সফলতা প্রদর্শনী শুরু হবার পর শুধু তার সফলতার উপরেই নির্ভর করে।
খুব ছোট পরিসরে ছোট আয়োজনে অভিনয় এবং আঙ্গিকগত দক্ষতায় সফল প্রযোজনার একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন প্রফেসর ডক্টর জামিল আহমেদ এবং মোহসিনা। জামিল আহমেদ মূল গল্পের এবং অভিনয়রীতির বড় পরিবর্তন না করলেও তিনি উপমহাদেশীয় সংগীতের দারুন মিথষ্ক্রিয়া ঘটিয়েছেন উপস্থাপনে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত আর সোলস দারুণভাবে মিশে গেছে পাশ্চাত্যের গল্পের সাথে। দর্শকও মিশে গেছে উপমহাদেশীয় আর পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মিথষ্ক্রিয়ায়। নাটকের অংশ হিসেবে সাবলীলতায় দর্শক একসাথে গেয়ে উঠেছেন- হান্ড্রেড মাইলস। এই নাট্যকর্মের মধ্য দিয়ে আয়োজন আঙ্গিক, অভিনয় ধরণ এবং উপস্থাপন রীতির একটি নতুন ধারণার সাথে জামিল আহমেদ পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের থিয়েটার নির্মাতাদের এবং দর্শকদের। যা থিয়েটারকে আরো বেশি নিয়ে যাবে সাধারণ মানুষের কাছে। করে তুলবে দর্শকবান্ধব এবং সহজ উপস্থাপনযোগ্য।
জামিল আহমেদের নাটক মানেই বিশাল ব্যয়বহুল সেট, পোশাক, আলো আর চমকের সমন্বয়- প্রচলিত এই ধারণার বিপরীতে প্রযোজনাটি এক দারুণ প্রত্যুত্তর। শুধুমাত্র ফ্লাডলাইটের মধ্য দিয়ে একটি ছোট বঙ ব্যবহার করে দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে এবং দর্শকদের সম্পৃক্ত করে প্রায় দু’ঘণ্টা দর্শককে আবদ্ধ রাখলেন তিনি পূর্ণ মনোযোগে। এখানে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল মোহসিনার স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়, তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনের সক্ষমতা, দর্শককে সম্পৃক্ত করে নিয়ন্ত্রণে রেখে গল্পের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার বুদ্ধিমত্তা এবং শারীরিক সামর্থ্য।