চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) বিভাগে নতুন ৮টি শয্যা যুক্ত করা হয় ২০২০ সালের শেষ দিকে। এর মাধ্যমে বিভাগের মোট শয্যা সংখ্যা ২০টিতে উন্নীত হওয়ার কথা জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ২১ নভেম্বর (২০২০ সালের) নতুন এই ৮ শয্যার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। মুমূর্ষু রোগীদের জন্য এর আগে ১২টি আইসিইউ শয্যা ছিল বিভাগে। এর সাথে নতুন ৮টি যুক্ত হলে মোট শয্যা সংখ্যা ২০টিতে দাঁড়ায়। আইসিইউ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০ আইসিইউ শয্যার বিপরীতে বিভাগে ২৯টি ভেন্টিলেটর (কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসদানের যন্ত্র) রয়েছে। তবে এসব ভেন্টিলেটরের অর্ধেকই দীর্ঘদিন ধরে অকেজো (চিকিৎসকদের ভাষ্য মতে নন ফাংশনিং) হয়ে পড়ে আছে। অন্তত ৫/৬ মাস ধরে এসব ভেন্টিলেটর অকেজো বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। আর ভেন্টিলেটর অকেজো থাকায় অন্তত ৯টি আইসিইউ শয্যায় ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে এই ৯ আইসিইউ শয্যা অনেকটা থেকেও নেই। এছাড়াও রয়েছে প্রশিক্ষিত কর্মচারী সংকট। সবমিলিয়ে হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগ নিজেই যেন মুমূর্ষু।
বর্তমানে ১১টি আইসিইউ শয্যা চালু থাকার তথ্য নিশ্চিত করে বিভাগের দায়িত্বে থাকা সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রনয় কুমার দত্ত আজাদীকে বলেন, ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দিতে না পারায় বাকি আইসিইউ শয্যাগুলোতে সংকটাপন্ন রোগীদের সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, আমাদের ২৯টি ভেন্টিলেটর আছে। এর মধ্যে ১১টি ফাংশনিং (সচল)। আর চারটি আংশিক সচল। বাকিগুলো (১৪টি) নন ফাংশনিং।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আংশিক সচল বলা চারটি ভেন্টিলেটরও ব্যবহার উপযোগী নয়। কারণ রোগীকে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দেয়া হলেও এসব ভেন্টিলেটর হঠাৎ অচল হয়ে পড়ে। ফলে এই চারটি ভেন্টিলেটর ব্যবহারের ঝুঁকি নিতে চান না চিকিৎসকরা। সে হিসেবে ২৯টি ভেন্টিলেটরের মধ্যে ১৮টি-ই নন ফাংশনিং বা অকেজো বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়দিন আগেও আইসিইউ বিভাগে মাত্র ৯টি ভেন্টিলেটর সচল ছিল। তবে নতুন করে দুটি ভেন্টিলেটর যুক্ত করায় এখন সচল ভেন্টিলেটরের সংখ্যা ১১টিতে দাঁড়িয়েছে। ভেন্টিলেটর অকেজো থাকার বিষয়টি অবগত হয়েছেন জানিয়ে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলছেন, বিষয়টি কয়েকদিন আগেই অবগত হয়েছি। এরপর আমি নিজে আইসিইউ বিভাগে গিয়ে ভেন্টিলেটরগুলো দেখেছি। এর মাঝে ঢাকায় কথাও বলেছি। সার্ভিসিংয়ের জন্য বৃহস্পতিবার (আজ) লোক আসবে বলেও জানান হাসপাতাল পরিচালক।
হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি আইসিইউ শয্যায় একটি করে ভেন্টিলেটর থাকে। এই ভেন্টিলেটর ছাড়া মূলত আইসিইউ সেবা অকার্যকর। কিন্তু প্রায় সময়ই এসব ভেন্টিলেটর অকেজো হয়ে পড়ে। আর ভেন্টিলেটর অকেজো হলে ওই সব শয্যায় আইসিইউ সেবাও বন্ধ থাকে। এতে করে গরীব-অসহায় রোগীরা এই আইসিইউ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে নগরীর প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে আইসিইউ সেবা নিতে হলে দৈনিক ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা ফি গুনতে হয় রোগীর পরিবারকে। যা গরীব-অসহায় পরিবারের পক্ষে বহন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ফলে মুমূর্ষু আইসিইউর মতো ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয় এসব অসহায় রোগীদের।
প্রসঙ্গত, মুমূর্ষু রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য আইসিইউ কেবল ভরসাস্থলই নয়, অপরিহার্যও। কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মুমূর্ষূ রোগীদের এখানে বাঁচিয়ে রাখা হয়, বাঁচিয়ে তোলা হয়। কিন্তু বৃহত্তর চট্টগ্রামের চিকিৎসা সেবায় গরীবের একমাত্র ভরসাস্থল হিসেবে পরিচিত চমেক হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগে শয্যা সংখ্যা ১২টি থেকে বাড়িয়ে ২০টিতে উন্নীত করা হলেও ভেন্টিলেটর অকেজো থাকায় এর শতভাগ সেবা/সুবিধা পাচ্ছে না রোগীরা। প্রায় অর্ধেক ভেন্টিলেটর প্রায়সময়ই অকেজো হয়ে পড়ে। অর্থাৎ মুমূর্ষু রোগীর ভরসাস্থল আইসিইউ বিভাগটি নিজেই মুমূর্ষূ হয়ে পড়ে প্রায় সময়। অথচ, হাসপাতালে দৈনিক কম হলেও একশ মুমূর্ষু রোগীর জন্য আইসিইউ শয্যার আবেদন-অনুরোধ আসে। আর সাধারণ আবেদনকারীর পাশাপাশি অনুরোধকারীর কাতারে থাকেন মন্ত্রী-এমপি এবং সচিবরাও। কিন্তু শয্যা সংকট তো আছেই, পাশাপাশি ভেন্টিলেটরসহ বিভিন্ন সংকটে যে কয়টি আছে তাতেও ঠিকমতো সেবা দিতে অপারগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। শয্যা বাড়ালেও প্রয়োজনীয় ও প্রশিক্ষিত কর্মচারী সংকটের কথা জানিয়েছেন বিভাগের দায়িত্বে থাকা আইসিইউ ও অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রনয় কুমার দত্ত। তিনি বলেন, আমাদের চিকিৎসক ও নার্স সংকট ততটা নেই। তবে কর্মচারী পর্যায়ে আমাদের যথেষ্ট সংকট রয়েছে। বিভাগে একজন সিকিউরিটিও নেই। সিকিউরিটি না থাকায় আইসিইউর মতো সংবেদনশীল ওয়ার্ডে হুট করে যে কেউ ঢুকে পড়ছে। যা রোগীর জন্য মঙ্গলজনক নয়।
আইসিইউ শয্যার অন্তত দ্বিগুন ভেন্টিলেটর প্রয়োজন বলে মনে করেন আইসিইউ ও অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ। ২০টি আইসিইউ শয্যার বিপরীতে অন্তত ৪০টি ভেন্টিলেটর অপরিহার্য জানিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, ভেন্টিলেটরগুলো হঠাৎ করে অচল হয়ে পড়ে। এরকম প্রায় সময়ই ঘটে। আর ভেন্টিলেটর অচল হলে সেটি সার্ভিসিংয়ের জন্য হাসপাতালের নিজস্ব কোনো বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারও নেই। যার কারণে সামান্য ক্রটি দেখা দিলেও এর সার্ভিসিং সময়সাপেক্ষ। এ বিষয়টাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া উচিত। আর যেহেতু ব্যাকআপ জরুরি, সেহেতু একটি আইসিইউ শয্যার বিপরীতে অন্তত ২টি ভেন্টিলেটর রাখা অপরিহার্য। সে হিসেবে বিভাগের ২০ আইসিইউ শয্যার জন্য ৪০টি ভেন্টিলেটর প্রয়োজন বলে জানান অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ।
অবশ্য, এরইমধ্যে ঢাকায় কথা বলেছেন জানিয়ে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান গতকাল আজাদীকে বলেন, সংকটের কথা জানিয়ে আমরা আরো ২৫টি ভেন্টিলেটর চেয়েছি। আশা করছি পেয়ে যাব।












