রেললাইনের উপর সেতুর উচ্চতা নিয়ে দেশব্যাপী সংকট তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের সেতুর উচ্চতা নির্ধারণ নিয়ে দুই বছর পরপর নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নেয়ায় সারা দেশে সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। উচ্চতার বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রামে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন একাধিক সেতুর কাজ আটকে আছে। অদূরদর্শী পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তহীনতার অভিযোগ এসেছে। এ কারণে সরকারের শত শত কোটি টাকার অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজও হুমকির মুখে পড়ছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের দেশব্যাপী প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার রেললাইন রয়েছে। যমুনা নদীকে মধ্যে রেখে সারা দেশের রেললাইন দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে যমুনার পশ্চিম পাশকে পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্ব পাশকে পুর্বাঞ্চল হিসেবে নামকরণ করা হয়। পশ্চিমা অঞ্চলে ১৪২৭ কিলোমিটার এবং পূর্বাঞ্চলে ১২৭৪ কিলোমিটার রেললাইন রয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় সবই সাড়ে পাঁচ ফুট বা ১৬৭৬ মিমি চওড়া ব্রডগেজ এবং পূর্বাঞ্চলে ১০০০ মিমি চওড়া মিটারগেট (সাড়ে তিন ফুটের কিছু কম) লাইন রয়েছে। এক সময় ন্যারো গেজের ৭৪৬ মিমি (২.৬ ফুট) লাইন থাকলেও এখন তা আর ব্যবহৃত হয় না। রেললাইনের উপর সারা দেশে শত শত সেতু রয়েছে। এর মধ্যে অনেক এলাকায় রেললাইনের উপর দিয়ে সড়ক-মহাসড়ক পার হয়েছে। এসব সেতুর উচ্চতা রেলওয়ে নির্ধারণ করে দেয়। বর্তমানে সেতুর উচ্চতা নির্ধারণ নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে।
সূত্র বলেছে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত
দেশে রেললাইনের উপর সেতু নির্মাণকালে উচ্চতা নির্দিষ্ট করা ছিল ৬.৫ মিটার। ওই সময় বিভিন্ন সেতু নির্মাণকালে এই উচ্চতা নিশ্চিত করা হয়। দুই বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সেতুর উচ্চতা নির্ধারণ করে ৭.৫ মিটার। ওই সময় দুই বছর আগে গৃহীত প্রকল্পের আওতাধীন সেতুগুলো নিয়ে সংকট তৈরি হয়। দুই বছরের ব্যবধানে ২০২০ সালে এসে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সেতুর উচ্চতা নির্দিষ্ট করে ৮.৫ মিটার। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক সেতু এই উচ্চতার গ্যাঁড়াকলে পড়ে আটকা পড়ে।
২০২২ সালে এসে রেলওয়ে নতুন করে সেতুর উচ্চতা ৯.৫ নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করে। অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন স্থানে রেললাইনের উপর এখন থেকে যেসব সেতু নির্মিত হবে সেগুলো রেললাইন থেকে ৯.৫ মিটার বা ৩১.১৬ ফুট উঁচু করে নির্মাণ করতে হবে। রেললাইন থেকেই এই উচ্চতা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে যেসব সেতু নির্মিত হয়ে গেছে সেগুলোকেও ক্রমান্বয়ে উপরোক্ত উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবে। এতে করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসংখ্য ব্রিজ ভাঙতে হবে।
কন্টেনারবাহী ট্রেনে ‘টু হাই কন্টেনার (একটির উপর একটি কন্টেনার) পরিবহন এবং ডাবল ডেকার (দোতলা) যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনার জন্যই কার্যত রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সেতুর উচ্চতা ৩১ ফুটের বেশি উঁচুতে নির্ধারণ করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিষয়টি শুরুতেই নির্দিষ্ট করে দেয়া হলে এত বড় সংকট তৈরি হতো না। এখন শত শত সেতু ও ওভারব্রিজ নিয়ে সংকট তৈরি হবে।
এই উচ্চতা নিশ্চিত করতে হলে চট্টগ্রামেও রেললাইনের উপরের অনেকগুলো সেতু ভেঙে নতুন করে করতে হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে যেসব সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে সেগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বেকায়দায় পড়েছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং রেলওয়ের অনেকগুলো ফুট ওভারব্রিজও উচ্চতার গ্যাঁড়াকলে পড়তে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের দুটি বড় প্রকল্প সেতুর উচ্চতার গ্যাঁড়াকলে পড়ে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে। এখন নতুন উচ্চতা নিশ্চিত করতে হলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্মাণাধীন সেতুগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। আবার একই সাথে প্রকল্পের কাজ শেষ হতেও দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। সব কাজ শেষ করেও ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোড এবং আউটার রিং রোডের ফিডার রোড সেতুর উচ্চতার গ্যাঁড়াকলে পড়ে ঝুলে রয়েছে।
সূত্র বলেছে, ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোডের ফৌজদারহাট অংশে বড় একটি ওভারব্রিজ রয়েছে। ২০১৮ সালে যখন এটি নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হয় তখন রেলওয়ের সেতুর উচ্চতা নির্দিষ্ট ছিল ৭.৫ মিটার। তখন এটি নির্মাণে ৭.৬ মিটার উচ্চতা নিশ্চিত করে প্রকল্প গ্রহণ এবং কাজ শুরু করা হয়। এখন নির্মাণের শেষ পর্যায়ে এসে রেলওয়ে ৮.৫ মিটার উচ্চতা নিশ্চিত করতে বলছে। এতে করে সেতুটির নির্মাণ কাজ ঝুলে গেছে। ঝুলে গেছে পুরো প্রকল্পের কাজ। প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ করেও সেতুটির কাজ শেষ না হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি চালু করা যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) পক্ষ থেকে সেতুটি ৭.৬ মিটার উচ্চতা রেখে নির্মাণ শেষ করার অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়েছে, আপাতত হলেও সেতুটি চালু করার অনুমোদন দেয়া হোক। ১০ বছর পর ভেঙে নতুন উচ্চতায় সেতু নির্মাণ করে দেয়া হবে। কিন্তু মাসের পর মাস গত হলেও সেতুটির অনুমোদন মেলেনি। এতে করে প্রকল্পটি কবে পুরোদমে চালু হবে তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
অপরদিকে পতেঙ্গা-ফৌজদারহাট আউটার রিং রোডের গুরুত্বপূর্ণ ফিডার রোডে সাগরিকা স্টেডিয়ামের পাশে রেললাইনের উপর একটি ওভারব্রিজ রয়েছে। পণ্যবাহী রেলগাড়ি চলাচল করা উক্ত রেললাইনের উপরও সেতুটি নির্মাণে উচ্চতা নিশ্চিত করতে গিয়ে সিডিএ বেকায়দায় পড়েছে। এতে করে ওভারব্রিজ নির্মাণসহ ফিডার রোড প্রকল্পটিও ঝুলে গেছে।
সিডিএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামস বলেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নতুন করে যে উচ্চতা নিশ্চিত করতে বলছে তা পুরনো প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করতে গিয়ে সংকট তৈরি করেছে। অনেক ব্রিজ আগেই নির্মিত হয়েছে। আবার কতগুলো ব্রিজের বেশিরভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এখন শুধু রেললাইনের উপরের অংশের গার্ডার বসাতে গিয়ে পুরো প্রকল্পটি ঝুলে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি।
এ ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আবুল কালাম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, রেললাইনের উপরে এবং স্টেশন এলাকায় ফুট ওভারব্রিজসহ যেসব ব্রিজ রয়েছে যেগুলোর উচ্চতা ৯ দশমিক ৫ মিটার করা হবে। ভবিষ্যতে কন্টেনারবাহী ট্রেনে ডাবল কন্টেনার পরিবহন করা হবে। এজন্য উচ্চতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগের যেগুলো ৮ দশমিক ৫ মিটার বা ৭ দশমিক ৫ মিটার ব্রিজ রয়েছে সেগুলোর উচ্চতাও বাড়ানো হবে।