গত ১০ মার্চ ছিল জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়েছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘মুজিব বর্ষের সফলতা, দুর্যোগ প্রস্তুতিতে গতিশীলতা’। এটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সময়োপযোগী। কেননা, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৭০ কোটি মানুষ দুর্যোগের ঝুঁকিতে এবং উপকূলীয় বদ্বীপ অঞ্চল হওয়ায় একক দেশ হিসেবে আমাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আমাদের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে একটি দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই আরেকটি দুর্যোগ হানা দেয়। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, ভূমিধস ও হিমবাহ ধসের মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা দুর্যোগের শিকার দক্ষিণ এশিয়া। বৈশ্বিক তাপমাত্রা আর মাত্র ১ দশমিক ৫ পয়েন্ট বাড়লে আমাদের এ অঞ্চলের বিপদ বেড়ে যাবে বহুগুণ।
দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর দেশের বিপুলসংখ্যক জীবন ও সম্পদের ক্ষতি হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ নির্মূলের কোনো পদ্ধতি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি থাকলে ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা সম্ভব বলে মত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ কথা আজ অস্বীকার করা যাবে না যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বিভিন্ন দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
পরিবেশবিদদের অভিযোগ, অতি লোভী ও অপরিণামদর্শী মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে পরিবেশগত বিপর্যয় বেড়েই চলেছে। কাজেই সবাই দায়িত্বশীল না হলে দুর্যোগের সংখ্যা ও মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। নিয়ম মেনে সবাইকে অবকাঠামো ও জীবন গড়ার চেষ্টা করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে জীবন ও সম্পদ সবকিছুই অতিমাত্রায় ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। ব্যাপক প্রস্তুতি ও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ না নিলে যে কোনো মাত্রার দুর্যোগেই মানুষের দিশেহারা হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
অধ্যাপক হাফিজ আশরাফুল হক সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ রোল মডেল, এটি একটি রাজনৈতিক বক্তব্য। তবে এ দেশের মানুষ দুর্যোগকে যেভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করে, বরং সেটাকে রোল মডেল বলা যেতে পারে। দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশে এ পর্যন্ত একটি কাঠামো ও একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগকে প্রতিকার করা যায় না; ঝুঁকি হ্রাসে প্রস্তুতি ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়। আর মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের ক্ষেত্রে আমরা মানুষ খুবই ব্যতিক্রমী প্রাণী। কারণ, যে কাজগুলো করলে আমাদের দুর্যোগ ঝুঁকি বেড়ে যাবে, আমরা সেই কাজগুলো করি। আমরা জেনে-বুঝেই পরিবেশের ক্ষতি করে যাচ্ছি। পৃথিবীতে একমাত্র জাপান ছাড়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে অন্য কোনো দেশ টেকসই উন্নয়নের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ পুরোপুরি নিয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমি নিশ্চিত নই যে পুরো বিশ্ব একদিন এ বিষয়ে সফল হবে কি না। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলায় পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের বিরাট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশেষ করে বিশেষজ্ঞদের মতামত ও তাঁদের সৃষ্ট নতুন নতুন জ্ঞানের আলোকে পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দুর্যোগঝুঁকি কমানোর আগাম সতর্কতা ও পূর্বাভাস প্রদান ব্যবস্থা এবং দুর্যোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে যথাযথ নজর দিতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সঠিক সময়ে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা গেলে দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস করে জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। বর্তমানে সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় পূর্ব প্রস্তুতিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কার্যকর কৌশল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছরই বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে থাকে। সঠিক সময়ে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা গেলে এসব দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস করে জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। নিজেদের স্বার্থেই জলবায়ু মোকাবেলায় আরও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে এবং উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে তাদের কার্বন নিঃসরণের দায়ে আমাদের ক্ষতিপূরণ তথা জলবায়ু তহবিলের প্রতিশ্রুত অনুদানের অর্থ আদায়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।