বর্ণিল আয়োজনে একুশে পদকে ভূষিত দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সমাজবিজ্ঞানী, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন বলেছেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং প্রতিষ্ঠার দুইটি অবিচ্ছেদ্য দিনের সাথেই দৈনিক আজাদী জড়িত। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এই দুইটি দিন কোনো দিনই বিস্মৃত হবে না। তাই দৈনিক আজাদী বাঙালির ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। এর একটি একুশে এবং অপরটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতা। তিনি বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ মুদ্রণের ব্যবস্থা করে কোহিনুর ইলেক্ট্রিক প্রেস এবং বাংলাদেশ স্বাধীনের খবর প্রথম প্রকাশের সঙ্গে আজাদী জড়িত। তিনি গতকাল সোমবার চিটাগং ক্লাবের সম্মেলন কক্ষে দেশের সেবা সংগঠনগুলোর মাঝে প্রথমবারের মতো একুশে পদকে ভূষিত হওয়া সাবেক ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর লায়ন এম এ মালেকের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন। লায়ন জেলা ৩১৫বি৪ এই সংবর্ধনার আয়োজন করে। বর্ণাঢ্য এ অনুষ্ঠানের শুরু হয় এম এ মালেকের ঘাটফরহাদবেগস্থ বাসভবন থেকে। ড. অনুপম সেন লায়ন্স সদস্যদের সেবা কার্যক্রমের প্রশংসা করে বলেন, সেবাই মানুষের প্রকৃত ধর্ম। সেবার হাত প্রসারিত করার মধ্যে যে আনন্দ তা আর কিছুতেই নেই। লায়ন্স সদস্যরা সেই আনন্দের সন্ধান পেয়েছেন বলেই সেবা করতে পারেন, অসহায় দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন। তিনি বিশ্বের বেশির ভাগ সম্পদ গুটিকয়েক মানুষের হাতে কুক্ষিগত হওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমেরিকার মতো দেশে ব্যাংকে একশ’ ডলার জমা নেই এমন মানুষের সংখ্যা ৩৪ শতাংশ। একমাত্র সেবার মানসিকতায় বিশ্বকে বাসযোগ্য রাখতে পারে।
তিনি বলেন, করুণা অনেক জীবের মধ্যে আছে। কিন্তু বিধাতা একটি গুণ শুধু মানুষকে দিয়েছেন, সেটি হচ্ছে মানুষ প্রকৃতিকে পরিবর্তন করতে পারে। মাটির নিচের লোহা তুলে তা পুড়ে ইস্পাত তৈরি করে মানুষ। ওই লোহা দিয়ে কত যন্ত্রপাতি তৈরি হয়, তৈরি হয় কত আনন্দ উপকরণ। আমরা এ ক্ষেত্রে স্রষ্টা। এই স্রষ্টার আনন্দ থেকেই মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। আরো বড় কিছু করতে হবে।
লায়ন এবং লিও সদস্যরা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে সাবেক গভর্নর এম এ মালেক এবং সাবেক গভর্নর কামরুন মালেককে চিটাগাং ক্লাবের অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যায়। চিটাগাং ক্লাবের হল রুম, লবি, চলার পথসহ বিস্তৃত এলাকা এম এ মালেকের ছবি, ফুল, ব্যানার, ফেস্টুন দিয়ে জমকালো সাজে সাজানো হয়। সংবর্ধিত অতিথি এম এ মালেকের জীবন ও কর্মের ওপর চমৎকার কথামালা, তথ্যচিত্র প্রদর্শন, কেক কাটা, ক্রেস্টসহ উপহার প্রদান, সংগীতানুষ্ঠানসহ নানা পর্বে জমজমাট ছিল পুরো আয়োজন।
সংবর্ধনার জবাবে এম এ মালেক বলেছেন, আপনাদের ভালোবাসার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। একুশ আমার অহংকার। একুশ মানে মাথা নত না করা। আমরা সবাই এ পৃথিবীর পথিক। কয়েকজন পথিকৃৎ। ড. অনুপম সেন পথিকৃৎ। ৫৭ সালে লায়নিজমে এসেছিলাম। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি লায়ন এম আর সিদ্দিকীকে।
রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, প্রশংসা শুনে আমি লজ্জিত হই। কিন্তু সেই প্রশংসার জন্য গোপনে অপেক্ষা করি। তিনি বলেন, দয়া এমন একটি বিষয় যা অন্ধও দেখতে পারে, বধির শুনতে পান। চার্লি চ্যাপলিন বলেছেন, আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু আয়না। কারণ আমি যখন হাসি, সে তখন কাঁদে না। আবার আমি যখন কাঁদি সে তখন হাসে না।
লায়ন সদস্যদের উদ্দেশে এম এ মালেক বলেন, একুশে পদক পেয়েছি আপনাদের জন্য। আমি বলি, কিছু করতে হলে লেগে থাকতে হবে। তাহলে সাফল্য আসবে। মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নেই। প্রতিটা মুহূর্ত আনন্দময় করুন, উপভোগ করুন। তিনি বলেন, জীবনটা একটি নোটবুকের মতো। এটির প্রথম এবং শেষ পৃষ্ঠা লিখা হয়ে গেছে। মাঝের পাতাগুলো খালি। এখানে ভালো কিছু করলে ভালো তা পরবর্তীতে কল্যাণ নিয়ে আসবে। খারাপ করলে তার ফলও ভোগ করতে হবে।
১৯৬০ সাল থেকে সংবাদপত্রের সাথে জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার মতো এত দীর্ঘ সময় আর কেউ সংবাদপত্রে জড়িত নেই। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি, চট্টগ্রামের সাংবাদিক দিয়ে আজাদী পরিচালনার। কারণ চট্টগ্রামের মানুষ এখানকার সমস্যা সম্ভাবনা ভালোভাবে তুলে ধরতে পারবে। দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের স্বাধীনতা পদক পাওয়ার কথা স্মরণ করে এম এ মালেক বলেন, দৈনিক আজাদীই একমাত্র পত্রিকা যেটির দুজন সম্পাদকই স্বাধীনতা এবং একুশে পদক পেয়েছেন।
তিনি বলেন, বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আমি নিজের স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলার কথা বলেছিলাম। আসলে আমার চাওয়া পাওয়ার আর কিছু বাকি নেই। আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছি, এটা আমার অনেক বড় পাওনা।
তিনি বলেন, ঘুরতে ভালোবাসি। রাশিয়া ছাড়া এমন কোনো দেশ নেই যেখানে আমি যাইনি। পৃথিবীকে বার কয়েক প্রদক্ষিণ করার সুযোগ হয়েছে আমার। সেবা সংগঠন হিসেবে লায়নিজমের মর্যাদা অনেক উঁচুতে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমাজের অসহায় এবং বিত্তহীন মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে হবে। আমাদের ধারে কাছে যারা আছে তাদের মুখে হাসি ফুটাতে হবে। বিশ্বের ২৩০ কোটি মানুষ অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মুখে হাসি ফুটানো গেলে এই পৃথিবী আরো বেশি বাসযোগ্য হবে।
লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫ বি ৪ এর গভর্নর লায়ন আল সাদাত দোভাষের সভাপতিত্বে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন, সংবর্ধনা কমিটির চেয়ারম্যান সাবেক গভর্নর লায়ন মনজুর আলম মনজু। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন, সাবেক গভর্নর লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া, সাবেক গভর্নর লায়ন আলহাজ্ব রফিক আহমেদ, সাবেক গভর্নর লায়ন মোস্তাক হোসাইন, সিএলএফ চেয়ারম্যান লায়ন নাসিরউদ্দিন চৌধুরী, সিএলএফ ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক গভর্নর লায়ন কামরুন মালেক, সাবেক গভর্নর লায়ন ডা. সুকান্ত ভট্টাচার্য, সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, সেকেন্ড ভাইস গভর্নর লায়ন এমডিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। পরিবারের পক্ষ থেকে দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক বক্তব্য রাখেন। ধন্যবাদ বক্তব্য দেন লায়ন আশীষ কুমার উকিল।
সাবেক জেলা গভর্নর রূপম কিশোর বড়ুয়া বলেন, মৃত্যুর পর সবাই বলেন, লোকটা খুব ভালো ছিল। কিন্তু এটা বেঁচে থাকতে বলা উচিত। আমার বড় ভাই মালেক সাহেব জীবদ্দশায় একুশে পদক পেয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই। আমি ৪৭ বছর আগে লায়নিজমে যুক্ত হই। তখন থেকে মালেক ভাইকে দেখছি। তিনি গভর্নর হওয়ার ৩০ বছর পর কামরুন মালেক গভর্নর হন। মালেক ভাই কখনো কান্না করেন না, রাগেন না। তিনি শুধু হাসেন, মানুষের মুখে হাসি ফোটান। তাঁর জন্মদিনে আনন্দাশ্রু দেখেছিলাম।
সাবেক জেলা গভর্নর রফিক আহমেদ বলেন, সাধারণের মধ্যে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এম এ মালেক। তিনি আসলে চুম্বক। তার কাছে এসে মনে হয়েছে মানুষকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে পারেন। সরকারের পক্ষ থেকে একুশে পদক দেওয়া হয়েছে। এটি শুধু তিনি মালেক পাননি, চট্টগ্রামবাসী পেয়েছেন। তাঁর সম্মানে তাঁর সংস্পর্শে থাকা মানুষ গৌরবান্বিত মনে করে। তিনি মানুষকে ভালোবেসেছেন। চট্টগ্রামের মানুষের ভালোবাসা তাঁর বড় প্রাপ্তি।
সাবেক লায়ন জেলা গভর্নর নাসিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমরা উচ্ছ্বসিত একুশের চেতনায় উজ্জীবিত একটি পদক লায়ন পরিবারে পেয়েছি। এম এ মালেক বিনয়ী মানুষ। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মুখে হাসি ফোটান তিনি।
সাবেক লায়ন জেলা গভর্নর মোস্তাক আহমদ বলেন, প্রকৃত লিডারশিপের প্রতিচ্ছবি লায়ন এম এ মালেক। তাঁর হাসি, কথা, নেতৃত্ব মানুষকে কাছে টানে। এমন পজেটিভ মানুষ আমি দেখিনি। চট্টগ্রামের মানুষের আস্থা তাঁর ওপর। লায়ন্স পরিবারের আর কেউ এত বড় পদক পাননি। তিনি তাঁর স্বপ্নকে অতিক্রম করেছেন। তাঁর সামনে এগিয়ে চলার প্রেরণা সাবেক লায়ন গভর্নর কামরুন মালেক।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সাবেক লায়ন গভর্নর কামরুন মালেক লায়নিজমকে ভালোবাসার কথা উল্লেখ করে বলেন, কিছুদিন আগে পায়ের ব্যথা নিয়ে মালেক সাহেবসহ চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলাম। চিকিৎসক বললেন, অ্যাক্টিভিটিজ কমাতে হবে। তখন মালেক সাহেব বলেন, শুধু লায়নিজমের প্রোগ্রামে যাবে আর কি। আমরা সংবর্ধনা চাই না, ভালোবাসা চাই। সবাই আমাদের পরিবারের জন্য দোয়া করবেন।
সদ্য বিদায়ী জেলা গভর্নর লায়ন ডা. সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেন, এম এ মালেকের ‘লেগে থাক’ কথাটা আমাকে উজ্জীবিত করে। তিনি সমাজের কুসংস্কার তুলে ধরেন বক্তব্যে। তিনি চট্টগ্রামের অরাজনৈতিক অভিভাবক। উনি এগিয়ে এসেছেন ক্যান্সার হাসপাতাল গড়তে। ২৫ কোটি টাকা তুলেছেন এ হাসপাতালের জন্য। আশা করি সমাজসেবায় তিনি স্বাধীনতা পুরস্কারে সম্মানিত হবেন।
দ্বিতীয় ভাইস জেলা গভর্নর এমডিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, এম এ মালেক লায়নিজম, সাংবাদিকতা, সমাজসেবাসহ সব ক্ষেত্রে সফল। তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি। লায়ন অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম এবং আবৃত্তিশিল্পী লায়ন আয়েশা হক শিমুর সঞ্চালনায় আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়।