স্বাধীনতার ৫০ বছরে নিঃসন্দেহে দেশ অনেক এগিয়েছে। তবে সমাজিক সংকটে জীবন নিয়ে সংশয়, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, হতাশা, শূন্যতা এবং বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। তা দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যেভাবে নেওয়ার কথা তা না হওয়ায় বিষণ্নতায় আত্মহননের প্রবণতা বাড়ছে। মানুষ আত্মহননের আগে অনুধাবনই করতে পারে না তার অস্বাভাবিক চলে যাওয়ার পর তার পরিবার বা সহকর্মীরা কি দুর্বিষহ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকে।
একাকীত্বে নিজেকে যখন কেউ অপ্রয়োজনীয় মনে করেন, জীবন অর্থহীন মনে হয় তখনই বিষণ্নতায় পড়েন। বিশেষজ্ঞদের মতে মানসিক স্বাস্থ্য শারীরিক স্বাস্থ্যের মতই গুরুত্বপূর্ণ তা অনেকেই বুঝতে পারে না। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে দারিদ্র্য, সম্মানহানি, বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, পারিবারিক কলহ, প্রেম, বিয়ে বিচ্ছেদ, একাকিত্ব, আর্থিক, সামাজিক ও পেশায় বৈষম্য মানুষকে হতাশাগ্রস্ত করে, এই হতাশা থেকেই বিষণ্নতা অতঃপর আত্মহননের প্রবণতা। পৃথিবীর সব দেশে শহরেই এর প্রবণতা বেশি। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। ২০২১ সালের জুনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে জানায়, সারা বিশ্বে বছরে অন্তত সাত লাখ তিন হাজার মানুষ আত্মহনন করে। তার মধ্য, সবচেয়ে বেশি আত্মহনন হয় নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে। সংস্থাটির মতে বাংলাদেশ মিয়ানমার, চীন, মরক্কো ও লেসোথা বিশ্বের মাত্র এই পাঁচটি দেশে নারীরাই বেশি আত্মহনন করে।
দক্ষিণ কোরিয়া একটি ধনী দেশ, ২০১৯ সালের উপাত্ত অনুযায়ী, আত্মহননের হার সেখানে পৃথিবীর চতুর্থ। সম্পদের পাশাপাশি বৈষম্য সেখানে প্রকট, যা মানুষকে নিঃসঙ্গ করছে। উত্তর কোরিয়া একটি দরিদ্র দেশ, জীবন-যাপনে প্রাচুর্য নেই, নেই ধনী-গরীবের তেমন ব্যবধান। আত্মহননের হারও দক্ষিণ কোরিয়ার এক-তৃতীয়াংশ। এক প্রতিবেদনে জানা যায়, উত্তর কোরিয়া থেকে যারা পালিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া আসে, তার একটা বড় অংশ আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। বৈষম্যহীন জীবনে অভ্যস্ত তরুণ-তরুণীরা দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছে। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় তারা জীবনের কাছে হেরে যাচ্ছে। বিনোদন জগতের বিখ্যাত শিল্পী, প্রাচুর্য্যে থাকা বিখ্যাতরাও আত্মহনন করছে। দারিদ্রতা-প্রাচুর্যতা দুইটাতেই নিঃসঙ্গতা-নৈরাশ্য বিদ্যমান।
নিঃসঙ্গতা এবং আত্মহনন পুঁজিবাদীর অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় কেউ এগিয়ে যাবে, কেউ পিছিয়ে পড়বে। এতে তৈরি হয় বিষণ্নতা। এগিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা উঁচু শ্রেণিতে উঠে নিচের দিকে ফিরে তাকায় না। যারা নিচে পড়ে থাকে, তাদের সঙ্গে মেলামেশা হয় না। উঁচুতে ওঠার পরও প্রতিযোগিতা থামে না; বেড়ে যায় ব্যবধান সৃষ্টি হয় নিঃসঙ্গতা। ক্ষুধা, প্রতারণা, সম্পদে বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেতে উগ্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণ প্রয়োজন। কারণ বৈষম্যই মানুষের মধ্যে অভিমানের জন্ম দেয়। আর অভিমান থেকেও নিঃসঙ্গতা-বিষণ্নতা তৈরি হয়।
আত্মহননের প্রবণতা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেই বেশি। বাংলাদেশ আত্মহনন প্রবণ একটি দেশ। আত্মহনন সর্বোৎকৃষ্ট কারণগুলোর বাইরে বাংলাদেশে নতুন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মানবিক এবং সামাজিক সম্পর্কের নতুন ধারা আমাদের সমাজে প্রবেশ করছে। অন্য সমাজে যা স্বাভাবিক আমাদের এখানে তা স্বাভাবিক নয়। ফলে এক ধরণের মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। সামাজিক সংহতি যদি নষ্ট হয় তখন ব্যক্তি বিচ্ছিন্নতায় ভোগে। তাইতো শেয়ার বাজারে পুঁজি হারিয়ে অনেকে আত্মহননের পথ বেচে নেয়। বিশ্বায়নের এই যুগে সম্পর্কের নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। আকাশ সংস্কৃতির কারণে মূল্যবোধে বিচ্ছিন্নতার উপাদান সংযোজিত হয়েছে এবং মনোজগতে কিছু মতাদর্শ অন্তর্ভুক্তি হওয়া আত্মহননের অন্যতম কারণ। বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, প্রযুক্তি মানুষকে সচেতন করছে তেমনি মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি একাকিত্ব আত্মকেন্দ্রিক। যারা দিনে ৩-৭ ঘণ্টা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের ৮৮ ভাগই নানাবিধ কারণে বিষণ্নতায় আক্রান্ত।
এছাড়া ক্রয় ক্ষমতা জীবন-যাত্রার মান বাড়ায় পুষ্টিকর খাদ্যের পরিবর্তে ফাস্টফুড, ভেজাল খাদ্য, বিভিন্ন ধরনের নেশা, দেরিতে ঘুমানো, দেরীতে ঘুম থেকে উঠা, যথাসময়ে আহার না করা এবং সঠিক খাদ্য অভ্যাসের অভাবে শারীরিক-মানসিক পরিবর্তন হয়। ফলে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক একাকিত্বে ভুগে। তাছাড়া ১৩/১৪ বছর বয়সে ছেলে-মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তন আসে। এই বয়সটা অত্যন্ত ঝুঁকির্পূণ। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার সাথে শারীরিক পরিবর্তন এই বয়সীদের জন্য খুবই কঠিন। তারা অনেক কিছুই করতে চায় আবার বিবিধ কারণে কিছুই করতে পারে না। তখন তারা মানসিক চাপে থাকে। একা থাকতে চাই। এই সময় অনেক পিতা-মাতা অবচেতন মনে সন্তানদের থেকে দূরে থাকেন বা পেশামুখি হওয়ার কারণে সন্তানদের সময় দিতে পারেন না। একাকিত্বে বিষণ্নতাই তাদের সঙ্গী হয়ে উঠে।
তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন-এর জরিপ থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহনন করেছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের হার বেশি। পরিবারগুলোর আর্থিক চাপের প্রভাব তরুণদের ওপর পড়ে। একাকিত্বে নেশা, প্রযুক্তির অপব্যবহারে চরম হতাশার মধ্যে থাকে, যার নির্মম পরিণতি বিষণ্নতা।
আমাদের সমাজের একটা সংস্কৃতি হচ্ছে-কম প্রশংসা করা এবং দোষ খোঁজা, অবজ্ঞা, হেয় করে কথা বলা। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তা প্রচলন। তিরষ্কারের পরিবর্তে গঠনমূলক আত্মবিশ্বাসী করে তুলি না। সবার সামনে ধমক তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের কারণে সন্তানরা বিষণ্নতায় ভুগে যা আমরা অনেকেই জানিনা। আামাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো সেকেলে, পরীক্ষার খাতায় নম্বর র্নিভর। প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা সর্বস্তরে শিক্ষকদের মানসিক পরির্তন আাসেনি।
আত্মহননের প্রবণতা পরিবার বুঝতে পারলেও সঠিক মনোনিবেশের অভাব থাকে। নীতি-নৈতিকতার অধঃপতনে চিরাচরিত পারিবারিক মূল্যবোধে চরম অবক্ষয় চলছে। পরিবারের সদস্যরাই পারে তাদের মানসিক শক্তি যোগাতে অবহেলা না করে জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করা। পরস্পরে সুসম্পর্ক রাখা। আমাদের পারিবারিক সংস্কৃতি পশ্চিমা বিশ্বের মতো নয়। উন্নত বিশ্বে পারিবারিক সংস্কৃতি হুমকির মুখে।
ধর্মীয় এবং সামাজিকভাবে আত্মহনন অত্যন্ত ঘৃনীত এবং মহাপাপ। আত্মহনন প্ররোচনা দণ্ডনীয় অপরাধ। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ’ আল কুরআনে “আর তোমরা নিজেদের হত্যা করোনা। নিশ্চই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু এবং যে কেউ জুলুম করে অন্যায়ভাবে আত্মহত্যা করবে, অবশ্যই আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করবো, আল্লাহর পক্ষে উহা সহজসাধ্য”। (নিসা:২৯-৩০)
হিন্দু ধর্মে,ঈশ উপনিষদে আত্মহত্যার তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। সাবধান করে বলা হয়েছে যে আত্মহত্যাকারী মৃত্যুর পর আনন্দহীন লোকে গমন করে। অন্ধকরা অন্ধকারে আবৃত একটি লোক আছে। তার নাম অনন্দলোক। যারা আত্মহত্যা করে তারা মৃত্যুর পর সেই লোকে যায়।
গৌতম বুদ্ধের মতবাদের প্রথম লাইনেই বলা হয়েছে জীব হত্যা মহাপাপ তাই বৌদ্ধ ধর্মেও আত্মহত্যাকে পাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
খ্রিষ্টান ধর্ম আত্মহত্যা সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলেনা তবে এটা বলে যে আত্মহত্যা করল সে শুধু নিজের যাত্রা নরকের দিকে তরান্বিত করা ছাড়া আর কিছুই করলনা। বাইবেল অনুযায়ী আত্মহনন হচ্ছে ্ঈশ্বরের বিরুদ্ধে করা ভয়ানক পাপ।
বড় কিছু হওয়ার স্বপ্নের পাশাপশি পরিবার থেকেই পারিবারিক ও সামাজিক নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। মূল্যবোধ হচ্ছে রীতিনীতি ও আদর্শের মাপকাঠি; যা সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। মূল্যবোধের অবক্ষয়ে ভিত্তি যদি নড়বড়ে হয়ে যায়, তাহলে সে সমাজ বা রাষ্ট্রের অনেক কিছুই ভারসাম্যহীনতায় পড়ে। আগামী প্রজন্মকে আত্মবিশ্বাসী ইতিবাচক ও গঠনমূলক শিক্ষায় উজ্জিবীত করে তুললে সে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে মানবীয় গুণাবলি অজর্ন করতে পারবে। আমাদের এখনই সুখী হওয়ার সূচকের উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। অল্প সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলিং বা মেন্টরিং-এর ব্যবস্থা নেই। অথচ প্রতিটি স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্থা রাখা খুবই গুরুত্বপূণ। কাউন্সিলিং করার ক্ষেত্রে তার নেতিবাচক আচরণে সে যেন বিব্রত না হয় এবং বিষণ্নতার কারণগুলো চিহ্নিত করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া। সঠিক কাউন্সিলিংই পারে সমাজ থেকে আত্মহননের প্রবণতা দূর করতে।
লেখক : উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি ও টেকসই উন্নয়নকর্মী