নাপা সিরাপের একটি ব্যাচ পরীক্ষার নির্দেশ

| সোমবার , ১৪ মার্চ, ২০২২ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে প্যারাসিটামল সিরাপ নাপা সেবনে দুই শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ আসার পর সারা দেশের পাইকারি ও খুচরা দোকান পরিদর্শন করে একটি ব্যাচের ওষুধ পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। শনিবার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ স্বাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়, ওষুধটি পরীক্ষা করে ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে প্রতিবেদন পাঠাতে হবে। গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, বেঙ্মিকো ফার্মাসিউটিক্যালসের প্যারাসিটামল ১২০ মিলি গ্রাম ও ৫ মিলি গ্রাম সিরাপের (ব্যাচ নং ৩২১১৩১২১, উৎপাদন তারিখ ১২/২০২১, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ১১/২০২৩) ওষুধ সেবন করে একই পরিবারের দুই শিশু মারা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সারা দেশে বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়ে কর্মরত সকল কর্মকর্তাকে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় অবস্থিত পাইকারি ও খুচরা ফার্মেসি পরিদর্শন করে ওই ব্যাচের নমুনা পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হল। খবর বিডিনিউজের।
বৃহস্পতিবার রাতে আশুগঞ্জের দুর্গাপুর গ্রামে ‘প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়ার পর’ ইয়াসিন খান (৭) ও মোরসালিন খান (৫) নামে দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ করে তাদের পরিবার। শিশু দুটি ওই গ্রামের ইটভাটার শ্রমিক সুজন খানের ছেলে।
ঘটনার বর্ণনায় শিশুদের মা বলেন, দুই ছেলের জ্বর হওয়ায় বৃহস্পতিবার বিকালে বাড়ির পাশের একটি ফার্মেসি থেকে তারা নাপা সিরাপ এনে খাওয়ান। তারপর দুই ছেলেরই বমি শুরু হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাদের প্রথমে আশুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে, এরপর জেলা সদর হাসাপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে আনার পথে বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে ইয়াসিনের মৃত্যু হয়। আর বাড়িতে নিয়ে আসার পর রাত সাড়ে ১০টায় মারা যায় মোরসালিন।
ওই ঘটনায় আশুগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে পুলিশ। শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জেলান সিভিল সার্জন ডা. মুহাম্মদ একরাম উল্লাহ। দুটি তদন্ত কমিটি করে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন গতকাল বলেন, অধিদপ্তরের বিভিন্ন আঞ্চলিক কার্যালয় নাপা সিরাপের ওই ব্যাচের ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করছে। তবে ওই ব্যাচের ওষুধ বিক্রি বন্ধ রাখার কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।
এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে প্যারাসিটামল সিরাপ ‘নাপা’ সেবনে দুই শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠার পর ওষুধ বিক্রেতাদের ওই নির্দিষ্ট ব্যাচের সিরাপ বিক্রি না করতে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতি। দেশের ওষুধ বিক্রেতাদের এ সংগঠনের সহসভাপতি দ্বীন আলী গতকাল বলেন, তারা মৌখিকভাবে সমিতির সকল সদস্যকে ওই নির্দিষ্ট ব্যাচের (ব্যাচ নং ৩২১১৩১২১) নাপা সিরাপ বিক্রি বন্ধ রাখতে বলেছেন। সেন্ট্রালি আমাদেরকে ডিসি অফিস থেকে কোনো চিঠি দেয় নাই বিধায় আমরাও সদস্যদের জন্য কেন্দ্র থেকে কোনো চিঠি দিতে পারছি না, সার্কুলারটা ইস্যু করছি না। কিন্তু আমরা ভারবালি বলছি সকলকে। আমরা অলরেডি ব্রাঞ্চগুলোকে বলেছি যাতে এই ওষুধগুলো বিক্রি না হয়। যে জেলাগুলোতে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সুপাররা আমাদের জানিয়েছেন, সেখানেই আমাদের সদস্যরা পদক্ষেপ নিয়েছেন। যেখানে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও নির্দিষ্ট ব্যাচের নাপা সিরাপ বিক্রি বন্ধ রেখেছেন ওষুধ বিক্রেতারা।
এ ঘটনায় গঠিত ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির সদস্যরা গতকাল দুর্গাপুর গ্রামে গিয়ে দুই শিশুর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে তদন্ত কমিটির প্রধান ডা. আকিব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ওষুধটিতে কী এমন উপাদান ছিল, যেটি খাওয়ার ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে রিঅ্যাকশন করল। এটি আসলে রহস্যজনক বিষয়। এই রহস্য উদঘাটনে সময় লাগবে।
ওই ব্যাচের কী পরিমাণ নাপা সিরাপ বাজারে আছে, সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে বেঙ্মিকো ফারমাসিউটক্যালসের বক্তব্য জানতে কোম্পানির চিফ অপারেটিং অফিসার রাব্বুর রেজাকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। এসএমএস পাঠালেও সাড়া দেননি।
তবে ওষুধ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একই রাসায়নিক দিয়ে একসঙ্গে তৈরি হওয়া পণ্যকে একটি ব্যাচ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাধারণত বাজারে ‘চালু’ ট্যাবলেটের ক্ষেত্রে একটি ব্যাচে ১০ লাখ পর্যন্ত ওষুধ তৈরি হতে পারে। তবে সিরাপের ক্ষেত্রে মিঙিংয়ের জন্য একটি বড় কন্টেইনারের প্রয়োজন হয়। এ কারণে বেশিরভাগ কোম্পানিই একটি ব্যাচে ৫০-৬০ হাজারের বেশি সিরাপ তৈরি করতে পারে না।
আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে প্যারাসিটামল সিরাপ নাপা সেবনে দুই শিশুর মৃত্যুর যে অভিযোগ উঠেছে, তাতে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল রাজধানীতে বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এ বিষয়ে কথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, ওই ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে; যে ফার্মেসি থেকে ওষুধ নেওয়া হয়েছিল, সেটি বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া সিরাপগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। আমাদের তদন্ত কমিটি কাজ করছে। অপেক্ষা করছি রিপোর্ট কী আসে। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাপার ওই ব্যাচের ওষুধ বাজার থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে কিনা, এমন প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেননি স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
জরুরি বিভাগের রেজিস্ট্রারে নেই ২ শিশুর নাম
নাপা খেয়ে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য জেলা সদর হাসপাতালে যাওয়া দুই শিশুর নাম জরুরি বিভাগের রেজিস্ট্রারে পাওয়া যায়নি। ঘটনার তিন দিনের মাথায় এই তথ্য পাওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে, শিশু দুটি চিকিৎসা পেয়েছিল কিনা?
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, তারা দুইটা টিকেট কিনেছে। টিকেটের রেজিস্ট্রার খাতায় নাম আছে। কিন্তু জরুরি বিভাগে চিকিৎসকদের কাছে যে রেজিস্ট্রার খাতা আছে, সেটিতে দুই শিশুর নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। এতে বোঝা যাচ্ছে, চিকিৎসকের সঙ্গে রোগীর যোগাযোগ হয়নি। রোগীকে চিকিৎসক সেবা দিতে পারেনি অথবা এমনও হতে পারে, স্টমাক ওয়াশের ভয়ে রোগী চলে যেতে পারে। অথবা চিকিৎসকসহ হাসপাতালে যারা ছিল, তাদের কোনো গাফিলতি থাকতে পারে।
পুরো ঘটনা তদন্তে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক।
দুই শিশুর মা লিমা বেগম অভিযোগ করেন, ভালো করে না দেখেই শারীরিক অবস্থা ভালো আছে জানিয়ে বাড়িতে নিয়ে বেশি করে পানি ও টক খাওয়ানোর কথা বলেন চিকিৎসক। তিনি বলেন, সদর হাসপাতালে যদি সঠিক চিকিৎসা পেত, তাহলে হয়তো আমার দুই ছেলে এভাবে মারা যেত না। স্টমাক ওয়াশের কথা বললেও চিকিৎসক কথা শুনেননি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকত্রিশ বছর পর আমেরিকার বন্দরে বাংলাদেশের জাহাজ
পরবর্তী নিবন্ধঅসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্‌বান বঙ্গবন্ধুর