পর্দা নেমেছে অমর একুশে বইমেলার। বর্ধিত দুদিনসহ ২১ দিনের এ মেলায় বিক্রি হয়েছে পাঁচ কোটি ১৩ লাখ ৭২৫ টাকার বই। এর মধ্যে শেষ দিনে গতকাল শনিবার বিক্রি হয়েছে ১৩ লাখ টাকার বই। এবার মোট বিক্রির পরিমাণ ২০২০ সালের চেয়ে প্রায় ১৩ কোটি টাকা কম। করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০২১ সালে নগরে বইমেলা হয়নি। মেলা উপলক্ষে চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এবার ৪৮৩টি বই প্রকাশ করে।
এবার বিক্রি কম হওয়ায় কিছুটা হতাশ প্রকাশকরা। মেলায় অংশ নেয়া বেশিরভাগ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মীরা বলেছেন, প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অবশ্য সন্তষ্টির কথাও জানিয়েছে। বিশেষ করে শিশু-কিশোর উপযোগী গ্রন্থ দিয়ে সাজানো স্টলে বিক্রি ছিল বেশি। এরপর উপন্যাস ও গল্পের বই বেশি বিক্রি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে মেলা শুরু নিয়ে অনিশ্চয়তা, মেলার শুরুতেই ইসলামী বই বিক্রি হচ্ছে না এমন গুজব এবং প্রচারণার ঘাটতির কারণে মেলায় লোক সমাগম পূর্বের চেয়ে কিছুটা কমেছে। যার কারণে কমেছে বিক্রিও। নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে এবার বইমেলা শুরু হয় গত ২০ ফেব্রুয়ারি। মেলার আয়োজক চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। শুরুতে মেলার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯ দিন। ওই হিসেবে মেলা শেষ হওয়ার কথা ছিল ১০ মার্চ। তবে লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের পক্ষে মেলা সাতদিন বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয় সিটি মেয়রকে। এর প্রেক্ষিতে দুদিন বাড়ানো হয়। বর্ধিত দুদিনসহ ২১ দিনের এ মেলা শেষ হয় গতকাল। গতকাল সকাল ৯টা থেকে রাত রাত ১০টা পর্যন্ত বিকিকিনি চলে। অবশ্য গত ১০ মার্চ মেলা মঞ্চে সমাপনী অনুষ্ঠান করা হয়েছিল।
চসিক আয়োজন করলেও চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য শিল্প-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরাই সম্মিলিতভাবে এ মেলা বাস্তবায়ন করে। মেলায় ৯৫ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ১২০টি স্টল ছিল।
মেলা পরিচালনা কমিটির দপ্তরের দায়িত্ব থাকা আইউব সৈয়দ দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রতিদিন মেলা শেষে আমরা স্টলগুলো থেকে হিসাব নিয়েছি। ২১ দিনে পাঁচ কোটি ১৩ লাখ ৭২৫ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। প্রতিদিন মেলায় লোক সমাগম কেমন ছিল জানতে চাইলে বলেন, ছুটির দিনগুলোতে গড়ে ৫০ হাজারের বেশি লোক এসেছে। বাকি দিনগুলোতে গড়ে ১০ হাজার মতো হবে।
এদিকে জিমনেশিয়াম মাঠে হওয়া অতীতের দুটি বইমেলা শেষে আয়োজকরা যে তথ্য জানিয়েছিল সে আলোকে এবার বিক্রি কম হয়েছে। বিগত বছরগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বর্ধিত দুদিনসহ ২১ দিনে সাড়ে ১৩ কোটি টাকা এবং ২০২০ সালে বিশদিনব্যাপী মেলায় ১৮ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। ২০২১ সালে করোনার ‘অজুহাতে’ বইমলো আয়োজন করেনি চসিক।
আয়োজক কমিটির দপ্তরে সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী, শুরুর প্রথম তিন দিনে নতুন প্রকাশিত ১৬৫ টি বই এসেছে মেলায়। মেলায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে গত ৪ মার্চ শুক্রবার। ওইদিন ৪৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা বই বিক্রি হয়েছে। এছাড়া গত ১১ মার্চ ৩২ লাখ ৫০ হাজার ৭২২ টাকা, ২৫ ফেব্রুয়ারি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ২২ লাখ ৪০ হাজার টাকার বই বিক্রি হয়েছে।
এদিকে গত ২১ দিন সরেজমিন মেলায় উপস্থিত হয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন পাঠক-লেখকের পদচারণায় মুখর ছিল মেলাপ্রাঙ্গণ। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেই লোক সমাগম বেশি ছিল। এছাড়া ২১ ফেব্রুয়ারি তীব্র ভিড় দেখা গেছে। বাকি দিনগুলোতে কিছুটা কম ছিল। তবে ছুটির দিন ছাড়া অন্য দিনগুলোতে সন্ধ্যার পর লোক সমাগম বাড়তো।
মেলার সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সভাপতি শাহ আলম নিপু দৈনিক আজাদীকে বলেন, অন্যান্য বারের চেয়ে এবার অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও ঝামেলামুক্তভাবে মেলা সম্পন্ন হয়েছে। ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। বিক্রিও ভালো ছিল। করোনার কারণে বিক্রি নিয়ে যে ভয় ছিল তার চেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছি। সফল বলা যাবে। করোনার ভেতরও সকলের মাঝে উচ্ছ্বাস ছিল।
এদিকে বিক্রি নিয়ে অসন্তুষ্টির কথা বলেছেন প্রকাশকরা। আপন আলো প্রকাশনার শামসুদ্দিন শিশির আজাদীকে বলেন, বিক্রি হতাশাজনক। ২১ দিনের মেলায় মাঝখানে বিক্রি হয়নি এমন দিনও গেছে। বলতে গেলে গত দুবারের চেয়ে এবারের বিক্রি কিছুই না।
পাঞ্জেরি পাবলিকেশন লি. এর বিক্রয়কর্মী মো. তানিম আজাদীকে বলেন, ছোটদের বই বেশি চলছে। বিশেষ করে কমিকসের বই। বিক্রি মোটামুটি। তবে গতবারের চেয়ে কম। মেলার প্রথমদিকে ছুটির দিনে যে সাড়া ছিল শেষের দিকে তা একেবারে কমে গেছে।
কথাপ্রকাশের ইসমাইল হোসেন দুলাল আজাদীকে বলেন, বাচ্চাদের সায়েন্স ফিকশন, গোয়েন্দা কাহিনী বেশি বিক্রি হয়েছে। উপন্যাস ও গল্পের বইয়েরও চাহিদা ছিল। প্রবন্ধের বই কম চলেছে। সবমিলিয়ে বিক্রি গতবারের চেয়ে কম। কার বই বেশি বিক্রি হয়েছে জানতে চাইলে বলেন, বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘শাহজাদীর শয্যা’ এবং হরিশংকর জলদাসের ‘বর্ণবৈষম্যের শেকড়বাকড়’ ও ‘দুর্যোধন’ বেশি চলছে।
শিশুপ্রকাশের আরিফ রায়হান বলেন, বেচাবিক্রি সন্তোষজনক। তবে গত দুবারের চেয়ে কম। বিগত সময়ে ডাকঢোল বেশি ছিল। প্রচারণা বেশি করা হয়। এবার তো মেলা শুরু নিয়েও অনিশ্চয়তা ছিল। নির্দিষ্ট তারিখে শুরু হলে সবার জন্য ভালো।
উল্লেখ্য, অতীতে নগরে ফেব্রুয়ারি মাসে একাধিক বইমলো হতো। এসব মেলা হতো ডিসি হিল ও মুসলিম ইনস্টিটিউট হলের মাঠে। কিন্তু সেগুলো প্রকৃত মেলা হয়ে ওঠতো না। সেখানে থাকতো নানা দৈন্যতার ছাপ। ২০১৯ সালে তৎকালীন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের উদ্যোগে জিমনেশিয়াম মাঠে অভিন্ন বইমলো শুরু হয়। অর্র্থাৎ একাধিক মেলার পরিবর্তে সবার অংশ গ্রহণে একটি মেলা শুরু হয়। ২০১৯ সালে স্টল ছিল ১১০টি। ২০২০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২০৫ এ উত্তীর্ণ হয়। এবার পূর্বের চেয়ে বেশি স্টল অর্থাৎ মেলার পরিধি বাড়বে এমন প্রত্যাশা ছিল সকলের। অথচ গতবারে চেয়ে এবার কমেছে। এছাড়া বিগত সময়ে একাধিকবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ও মাইকিং করে প্রচারণা চালানো হতো। এবার করা হয়নি।












