ইউক্রেনে গিয়ে যুদ্ধের মধ্যে আটকা পড়া এমভি বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের ২৮ নাবিক ও প্রকৌশলী দুই সপ্তাহ পর দেশে পৌঁছেছেন আতঙ্ক জাগানো স্মৃতি আর সহকর্মীকে হারানোর শোক বুকে নিয়ে। গতকাল বুধবার দুপুর সোয়া ১২টায় তারা ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে এসে পৌঁছান বলে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের উপ-মহাব্যবস্থাপক (চার্টারিং ও পরিকল্পনা) মো. মুজিবুর রহমান জানান।
তিনি বলেন, তুর্কি এয়ারলাইন্সের টিকে৭২২ ফ্লাইটে তারা দেশে ফিরেছেন। ইউক্রেনের ওলভিয়া বন্দরের চ্যানেলে আটকা থাকা জাহাজটি থেকে উদ্ধার পাওয়ার তিনদিন পর মালদোভা সীমান্ত পার হয়ে রোববার দুপুরে রোমানিয়ায় পৌঁছেছিলেন বাংলার সমৃদ্ধির নাবিক ও প্রকৌশলীরা। সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাসের ব্যবস্থাপনায় বুখারেস্টে একটি হোটেলে তাদের রাখা হয়েছিল। মঙ্গলবার রাতে বুখারেস্ট থেকে তারা দেশে ফেরার বিমানে চড়ে বসেন। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের মালিকানাধীন জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধি গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে পৌঁছায়। সেখান থেকে পণ্য নিয়ে জাহাজটির ইতালি যাওয়ার কথা ছিল। খবর বিডিনিউজের।
যুদ্ধের গোলায় সহকর্মীর মৃত্যু দেখা বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের মাস্টার জি এম নূর ই আলম বাকি নাবিক ও প্রকৌশলীদের নিয়ে দেশে ফিরতে পেরে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন; তবে এত দ্রুত সুস্থভাবে সবাই ফেরা সম্ভব হবে, সেটা তিনি ভাবতেও পারেননি। দ্রুততম সময়ে সবাইকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করায় সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দেশে সুস্থভাবে ফিরতে পেরে অনেক আনন্দিত। প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনায় সংশ্লিষ্ট সবার তৎপরতায় নিরাপদে এবং দ্রুততম সময়ে দেশে ফিরতে পেরেছি, আমাদের পরিবার অপেক্ষায় ছিলেন, সবার চেষ্টায় ফিরতে পেরেছি এত অল্প সময়ের মধ্যে।
ইউক্রেনে গিয়ে যুদ্ধের মধ্যে আটকে পড়া জাহাজটি গত ২ মার্চ রকেট হামলার শিকার হয়। তাতে মারা যান থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান। জাহাজের ব্রিজও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরদিন বিকেলে জাহাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় এবং বাকি ২৮ জনকে সরিয়ে নেওয়া হয় সেখান থেকে। মলদোভা হয়ে তারা রোববার পৌঁছান রোমানিয়া, সেখান থেকে ফিরলেন দেশে। নূর ই আলম বলেন, আমরা আতঙ্কিত ছিলাম। আমাদের সরকার যথেষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা এখানে সুস্থভাবে আসতে পেরেছি, এটাই বড় কথা। তবে আমরা জার্নি করায় খুব ক্লান্ত।
জাহাজ আক্রান্ত হওয়ার পর বিএসসি, নৌ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সবসময় যোগাযোগ রাখা হয়েছিল জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন নূর ই আলম। তাদের বের করে আনার জন্য পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া এবং রোমানিয়ায় বাংলাদেশের দূতাবাস কর্মীরা যে পরিশ্রম করেছেন, সেজন্য ধন্যবাদ জানান। সাধারণত আমার সঙ্গে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কারও কথা হয় না, কিন্তু হামলার পর বিভিন্ন সময়ে আমাদের সার্বিক অবস্থা জানতে, আমরা কে কেমন আছি এসব জানতে… আমার সঙ্গে সরকারের কর্মকর্তারা কথা বলেছেন, সাহস দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় সব কাজ হয়েছে, সবার প্রতি আমি আসলেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, এভাবে ফিরতে পারব ভাবি নাই।
নিজেরা ফিরতে পারলেও সহকর্মী হাদিসুর রহমানের লাশ ইউক্রেনেই রেখে আসতে হয়েছে নূর ই আলমদের। সেজন্য কষ্ট প্রকাশ পেল তার কণ্ঠে। তিনি বললেন, আমি গভীরভাবে মর্মাহত, নিহত হাদিসুরের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। সরকার ও করপোরেশনকে অনুরোধ করব, তার পরিবারকে যেন উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
সেদিন আসলে কী ঘটেছিল, সে বিষয়ে কিছু বলতে বার বার অনুরোধ করছিলেন সাংবাদিকরা। জবাবে জাহাজের মাস্টার বলেন, সেদিন আমাদের রুটিন ব্রিফিং ছিল। বিকেল বেলায় হামলা (অ্যাটাক) হয়। তখন আমাদের ব্রিজে আগুন লেগে গেছিল। আগুন নেভানোর জন্য আমরা ব্যস্ত ছিলাম। আগুন নেভানো হয়। এরপর টেলিভিশনে আপনারা বাকিটা দেখেছেন। যুদ্ধ পরিস্থিতি আঁচ করে ইউক্রেন থেকে আগেই জাহাজ ফিরিয়ে আনা সম্ভব ছিল কী না- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরুর পর বন্দরের ১৯টি চ্যানেল বন্ধ হয়ে যায়, কোনো চ্যানেল ব্যবহার করে দেশে ফেরার সুযোগ ছিল না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব ইউরোপ উইংয়ের মহাপরিচালক সিকদার বদিরুজ্জমান বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের ২৮ জন যে ক্রু মেম্বার, তাদেরকে আমরা আমাদের বুকে নিতে পেরেছি। এটা আমাদের কাছে সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। তারা তাদের পরিবারের কাছে যাবে, তারা এখন সেইফ। বাকি একজন হাদিসুর রহমান, তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি আমরা আবারও সহমর্মিতা জানাচ্ছি। এবং তার দেহাবশেষ আমরা অতিসত্বর দেশে আনতে পারব। তবে সেটা কবে সম্ভব হবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা দিতে পারেননি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এটা টাইম ফিঙড করা দুরূহ একটা ব্যাপার। আপনারা সেটা ভিজুয়ালাইজ করতে পারছেন। একটা যুদ্ধ, সেখানে মানুষ ঢুকতে পারছে না, আসতে পারছে না। সব দিক বিবেচনা করে আপাতত ইউক্রেনেই সংরক্ষণ করা হচ্ছে হাদিসুরের মরদেহ।