দুই চাকায় বাদাবনের সমীপে

বাবর আলী | সোমবার , ৭ মার্চ, ২০২২ at ৭:৫৫ পূর্বাহ্ণ

(পর্ব-৬)

বৃষ্টি খানিকটা কমতেই যাত্রা শুরু। গন্তব্য কাটকাটা বাজার। সুন্দরবনের কিছু অঞ্চলে আদি অধিবাসীদের কেউ কেউ ‘কাঠিকাটা’ বলে থাকেন। সেখান থেকেই এই নামের উৎপত্তি কিনা কে জানে! পরিকল্পনা ছিল বনের পাশের রাস্তা ঘেঁষেই গন্তব্যে পৌঁছানোর। মাটির সেই রাস্তায় বৃষ্টির পরপর সাইকেল চালাতে যাওয়া আত্মহত্যার নামান্তর! সাইকেলে যত না চড়ব, সাইকেল তার চেয়ে বেশি আমাদের কাঁধে চড়বে! অতএব, ওই পরিকল্পনা বাদ। কয়রা অভিমুখী রাস্তাটা খানিকটা ভালো। ইটের সলিনের রাস্তা প্রথম অংশে। মাঝে একটা অংশে বন্যায় রাস্তা ধুয়ে-মুছে গিয়ে পাশের বিলের অংশ হয়ে গিয়েছে। উরু পানি ঠেঙিয়ে সাইকেল কাঁধে সে জায়গাটা পার হলাম। পরের অংশটুকুতে পিচের রাস্তা। পুরোদিনে যেসব রাস্তায় চালিয়েছি, তার তুলনায় স্বর্গীয় রাস্তা! মাঝে পেলাম দেউলিয়া বাজার। এ নামের মাহাত্ম্য কি কে জানে! খানিক বাদের কয়রা বাজার পেরিয়ে একেবারে থামলাম বেদকাশী বাজারে। এই বাজারে খালের উপরের সেতুটা তলিয়ে গেছে গত বর্ষায়। এখন আবার নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে। এটা অবশ্য এই অঞ্চলের নৈমিত্তিক ব্যাপার। কয়রা এমনিতেই এই দেশের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। এক দুর্যোগের ধাক্কা সামলিয়ে উঠতে না উঠতেই এখানে এসে হাজির হয় আরেকটা ঝড়/বন্যা।
বেদকাশী বাজারে চা-পেঁয়াজুর ছোট্ট একটা বিরতি নিয়ে সোজা কাঠকাটা বাজারে। পথচলতি রাস্তার পাশেই দুই-তিনটা দিঘি অতিক্রম করলাম। অবশ্য কোনটা দিঘি, কোনটা মাছের ঘের সেটা ঠাহর করতেই বেগ পেতে হয়। শাকবাড়িয়া নদীতীরের এই জনপদের ঠিক ওপারেই সুন্দরবন। বাজারের একদম শেষ ফেরির পন্টুন লাগোয়া চায়ের দোকানে চা নিয়ে বসে রাতে থাকার জায়গা নিয়ে আলোচনায় বসলাম। প্রাথমিকভাবে আগের রাতের মতো আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার ব্যাপারে মনস্থির করেছিলাম। আশ্রয়কেন্দ্র কিছুটা দূরে হওয়ায় বাজার থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠটাকেও তালিকায় রাখলাম। দারোয়ানের সাথে কথা বলার জন্য সানি আর আমি একবার স্কুল প্রাঙ্গণ ঘুরে এসেও তার দেখা পাইনি। অবশ্য নদী লাগোয়া মসজিদকেও বিবেচনায় রাখলাম আমরা। স্থানীয় এক লোকের সাথে কথার ফাঁকে জানতে পারলাম, নদীর তীরে নোঙর করে রাখা নৌকাগুলো এখানেই থাকবে। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, রাতটা নৌকাতেই কাটাব। নৌকাগুলো বিশালাকার। একটা অংশে ছইয়ের মতো আছে। সহজেই রাত কাটানো যায়। এই বাজারের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো ‘রপ্তানির জন্য প্রস্তুত’ সাইজের অসংখ্য মশা। খোলা জায়গায় বেশিক্ষণ বসাই দায় এদের যন্ত্রণায়। বাজারের দোকান-পাট বন্ধ হয়ে যাবার আগে কয়েল কিনে রাখতে ভুল করলাম না। চায়ের দোকান থেকে চেয়ার নিয়ে নদীর পাড়ে বসে এইসব নিয়ে আলোচনার ফাঁকেই খেয়াল করলাম, আমাদের তিনজনকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে বৃত্তাকার ভিড়। এশার নামাজ ফেরত মুসল্লীরা আমাদের কথা-বার্তা নিবিড় মনোযোগের সাথে শুনছে। কয়েকজন আগ্রহী নিয়ে এটা-সেটা জানতে চাচ্ছেন। এই ধরনের ছোটোখাটো বাজারে হওয়া এইসব আলাপগুলোকে আমি নিজে খুবই উপভোগ করি।
আরেকটা ব্যাপারেও খানিকটা অসুবিধায় পড়লাম আমরা। বাজারটা মোটামুটি জমজমাট হলেও এখানে রাতের খাবারের ব্যবস্থা নেই। আমরা অবশ্য ফল-মূল, ডিম-বিস্কুট খেয়েই রাত কাটিয়ে দেবার পরিকল্পনা ততক্ষণে করে নিয়েছি। তানভীর ভাই এইসব ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্যোগী। বাজারের শেষ মাথার চায়ের দোকানটার মালিককে পটিয়ে ডিম সেদ্ধ করে নিয়েছেন। এই দোকানটা মূলত একটা নির্মীয়মাণ পাঠাগারের অংশ। এলাকার শিক্ষিত ক’জন তরুণ লঞ্চঘাটে অপেক্ষার সময়টুকু যাতে লোকের ভালো কাটে, সেজন্য এখানে একটা পাঠাগার নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। দোকানের পাশের বাঁশের বেঞ্চিখানা বানানো হয়েছে পাঠকদের জন্যই। সেখানে আছে পাঠকদের প্রতি উদাত্ত আহবান- ‘দয়া করে এখানে বসে একটি বই পড়ুন।’
আজ আমাদের আরো একজন সঙ্গী বাড়ার কথা। খুলনা থেকে মোটরসাইকেলে রওনা দিয়ে এখানেই যোগ দেয়ার কথা রাবাত ভাইয়ের। বিকাল পাঁচটায় রওনা দিলেও রাত নয়টা পর্যন্ত তার দেখা নেই। দশটার কিছু আগে ভাঙা রাস্তায় শ’খানেক কিলোমিটার মোটরসাইকেল চালানোর ধকল চেহারায় নিয়ে রাবাত ভাই এলেন। সাথে নিয়ে এসেছেন খুলনায় আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার জবেদ হোটেলের গরুর মাংস। আগেই ফোন করে জেনে নিয়েছিলেন এই বাজারে ভাত পাওয়া যায় কিনা সেই খবর। আমাদের দিক থেকে নেতিবাচক উত্তর শুনে কয়রার কাছাকাছি এক বাজার থেকে নিয়ে এসেছেন খিচুড়িও। এমনকি ওই দোকান থেকে ধার নিয়ে এসেছেন খাবারের প্লেটও! জন্মদিনে জবেদের হোটেলের গরুর মাংস ছিল আমার জন্য বিশাল সারপ্রাইজ। এতেও শেষ নয়, জন্মদিনের গিফট হিসেবে রাবাত ভাই নিয়ে এসেছেন সুদৃশ্য একখানা লাইটও।
ভরপেট খেয়ে আবার বসলাম নদীর পাড়ে। ক্লান্ত সাঁতারুর মতো বয়ে চলেছে শাকবাড়িয়া নদী। এই জায়গায় দারুণ বাতাস। জোৎস্নার আলো সামনের নদীর পানিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। অদূরের গাছগুলো এই অপার্থিব আলোতে কেমন মোহনীয় রূপ ধারণ করেছে। চোখ দুটো ভরে উঠেছে প্রাপ্তির আনন্দে। সুন্দর এই দৃশ্য অনাহুত অতিথির মতো হানা দিল ভটভট শব্দ। শব্দ শুনে আমি আর তানভীর ভাই একমত হলাম, এটা সম্ভবত খুলনাগামী লঞ্চটার শব্দ। রাত দশটা নাগাদ সেটা এই ঘাটে ভিড়ার কথা। সানির অবশ্য ভিন্নমত। তার ধারণা, এটা সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলারের শব্দ। যাত্রীবাহী লঞ্চ নাকি এত শব্দ করে না। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অরগানাইজেশনের নীতিমালা অনুযায়ী, যাত্রীবাহী লঞ্চের শব্দ একটা নির্দিষ্ট ডেসিবেলের মধ্যে থাকতে হয়। নেভাল আরকিটেকচার এন্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র নৌযানের ব্যাপারে কিছু বললে সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়। আমরা শুনলাম এবং মেনেও নিলাম। তবে নৌযানটা নিকটে আসার পর আবিষ্কার করলাম, এটা মাছ ধরার ট্রলার নয়, যাত্রীবাহী লঞ্চ। তানভীর ভাই সানির দিকে ঘুরে বললো, ‘কই সুতারখালীর লঞ্চ আর কই ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অরগানাইজেশন!’

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধঅস্পৃশ্য তুলসী গাছ ও শেফালী