আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের এই দিনে বজ্রকণ্ঠে এই উচ্চারণ করেছিলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণে। সেদিনই এ দেশের মানুষ বুঝে গিয়েছিল পাকিস্তানের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সময় এসেছে। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটিই বাঙালির পরাধীনতা মুক্তির সনদ।
এই ভাষণের মাধ্যমে মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ই মার্চের সেই ভাষণেরই সফল পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার এই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। কালজয়ী এই ভাষণ বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত ও মুক্তিকামী মানুষকে সব সময় প্রেরণা জুগিয়ে যাবে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ আর বহু ত্যাগের বিনিময়ে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ছিনিয়ে আনি মহান স্বাধীনতা, বাঙালি জাতি পায় মুক্তির কাঙ্ক্ষিত স্বাদ। প্রতিষ্ঠা পায় স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ৫০ বছরেও সেই ভাষণের আবেদন এতটুকু কমেনি। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ অনেক ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। গবেষণা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকেও ঠাঁই পেয়েছে। এ ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো।
ঐতিহাসিক মহাকাব্যিক ভাষণে তিনি বলেছিলেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। তাঁর ভাষণের মূল কথাটি ছিল মুক্তি। এ মুক্তি শব্দটির ব্যঞ্জনা ও ব্যাপকতা ছিল বহুমাত্রিক। এই শব্দে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, তিনি যে রাষ্ট্রচিন্তা করতেন তার মূলে ছিল সাধারণ মানুষ ও তাদের কল্যাণ। তাঁর মতো করে তিনি তাই বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার কথা বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে যুক্ত করেছিলেন। গণমানুষের সেই অর্থনৈতিক মুক্তিতে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা অবিস্মরণীয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের সংবিধানের এই চার মূলনীতি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথাই বলেছেন। তিনি বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির কথা বলেছেন। তাঁর বক্তৃতায় বাঙালি জাতির ওপর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতনের করুণ বর্ণনা দিয়েছেন। একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বাঙালি জাতির গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি তুলেছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে শোষণমুক্ত সমাজতন্ত্রের প্রতিফলনও আমরা দেখতে পাই। তিনি তাঁর বক্তব্যে একদিকে যেমন বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি জানিয়েছেন, তেমনি অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমজীবী গরিব মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন।
আসলে বঙ্গবন্ধু ছিলেন দীর্ঘমেয়াদি অর্থনীতি মুক্তির প্রবর্তক। পরনির্ভরশীলতা ত্যাগ করে নিজস্ব সম্পদের ওপরে দেশকে শক্ত করে দাঁড় করানো ছিলো বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক মূল আদর্শ ও লক্ষ্য। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে বঙ্গবন্ধুর সামনে ছিলো ভগ্ন দশায় থাকা অবকাঠামো, বিধ্বস্ত অর্থনীতি ও কঠিন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। সব জটিল চ্যালেঞ্জ সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেন বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুনিপুুণভাবে। এ সময় তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের সব নীতি ছিল দেশের মানুষের স্বার্থকে ঘিরে। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে প্রশাসনকে পরিচালিত করতে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করার নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরে নানা চক্রান্ত তাঁকে বিচলিত করার চেষ্টা চলছিলো। পরাক্রমশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে আসছিল। তবু তিনি উন্নত মস্তিষ্কে সব বাধা অতিক্রম করছিলেন। আত্মমর্যাদাশীল নেতা ও বাঙালির শ্রেষ্ঠতম প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ছিলেন উন্নতশির। আন্তর্জাতিক সহায়তার নামে করুণাকে তিনি উপেক্ষা করেছেন সবিনয়ে। ১৯৭৩ সালে বিশ্ব ব্যাংকের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট পিটার কারগিল এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘দাতাদের কাছ থেকে সহায়তা না নিলে বাংলাদেশের জনগণ কী খাবে’। বঙ্গবন্ধু তখন তাঁকে বাড়ির জানালার কাছে গিয়ে বাইরে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘আপনি বাইরে কী দেখতে পাচ্ছেন?’ করগিল বলেছিলেন- ‘সবুজ ঘাসের একটি সুন্দর উঠোন’। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘যদি আপনারা কোনো ধরনের সহায়তা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তবে আমার জনগণ এগুলো খাবে’। এমনি আত্মমর্যাদাশীল এক নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ যুগে যুগে বাঙালি জাতিকে শক্তি ও সাহস যোগাবে। আমাদের মহান নেতার এই ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালি জাতির ইতিহাসে চিরন্তন ও সর্বজনীন হয়ে থাকবে।