গত ২০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ‘জয় বাংলা’ হবে জাতীয় স্লোগান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন সময় জয় বাংলা ব্যবহার করা হতো। এই বেতার কেন্দ্রের স্বাক্ষরসঙ্গীত ছিল জয় বাংলা, বাংলার জয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহ্মদের প্রথম বেতার ভাষণটি শেষ হয়েছিল ‘জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’ শ্লোগান দিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশে যে সংবাদপত্রটি প্রথম প্রকাশিত হয় সেটি হলো দৈনিক আজাদী। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল-‘জয় বাংলা, বাংলার জয়।’ ঐ সময়েও সম্পাদক ছিলেন বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেক। যিনি এবার একুশে পদকে ভূষিত হন। দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। একই পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক রাশেদ রউফ লাভ করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এক পত্রিকায় এতজন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা লাভ অনেক গর্বের।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণাদায়ক ও উদ্দীপনামূলক একটি স্লোগান ছিল জয় বাংলা। যা এখনো বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করে। আর স্বাধীন বাংলা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়-‘জয় বাংলা বাংলার জয়/ হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়/ কোটি প্রাণ এক সাথে জেগেছে অন্ধ রাতে/ নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়…।’ এই গানের মধ্য দিয়ে মুক্তির সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে বাংলার আমজনতা। গানটি বাংলার মুক্তিপিপাসু মানুষের চেতনায় আগুন ধরায়। যার কারণে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটিকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রণসংগীত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে এই গানকে আরাধ্য করে মুক্তির পথে এগিয়ে যায় বাঙালি। এই গান স্বাধীন বাংলা বেতারের সূচনা সংগীত, জাতীয় স্লোগানও বটে। মহান মুক্তিযুদ্ধে কালজয়ী ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি সারা জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে, সেই গানের সুরস্রষ্টা আনোয়ার পারভেজ। লিখেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। বাঙালির জাতীয় জীবনের সাথে এই শব্দদ্বয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দুটি শব্দের একটি স্লোগান কীভাবে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে, কী করে একটি জাতিকে স্বাধিকারের পথে উদ্বুদ্ধ করে নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করে, কী করে দল-মত-ধর্ম ও বিশ্বাস নির্বিশেষে কোটি কোটি মানুষকে একটি স্লোগানের নিচে নিয়ে আসতে পারে জয় বাংলা শুধু তার একটি বড় নিদর্শনই নয়, বরং বিশ্বের রাজনৈতিক ও স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে এটি দর্শনও বটে। এর আগে বাঙালি কখনো এত তীব্র, সংহত ও তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান দেয়নি, যাতে একটি পদেই প্রকাশ পেয়েছে রাজনীতি, সংস্কৃতি, দেশ, ভাষার সৌন্দর্য ও জাতীয় আবেগ। সফল অপারেশন শেষে বা যুদ্ধ জয়ের পর অবধারিতভাবে মুক্তিযোদ্ধারা চিৎকার করে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বিজয় উদযাপন করত।
কিন্তু ৭৫’এর পট পরিবর্তনের পর জয় বাংলা স্লোগান একরকম বন্ধ ছিল। অনেকে সাহস করে মুখেও উচ্চারিত করতো না। আবার অনেকে বিজাতীয় সংস্কৃতির গন্ধ খুঁজে নানা তত্ত্ব জাহির করতে পিছপা হয়নি। তবে ঐ সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্র পাকিস্তান ভাবধারার দিকে ধাবিত হতে থাকে। কখনো সামরিক সরকার, আবার কখনো বেসামরিক লেবাসে সামরিক সরকার দেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে সক্রিয় ছিল। ৭১’এ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সমর্থনকারীকে করা হয় প্রধানমন্ত্রী। এরপর বিভিন্ন সরকারের আমলে পাকিস্তান ভাবাদর্শের অনুসারীরা ঠাঁই করে নেয়। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের আমলে রাজাকার-আলবদর কমান্ডারের গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে। লজ্জায় নুয়ে পড়ে বাংলাদেশ, জয় বাংলাকে করতে চেয়েছিল নির্বাসিত। পারেনি তারা সোনার বাংলাকে খান্ খান্ করতে।
২০২০ সালের ১০ মার্চ জয় বাংলাকে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে গ্রহণের জন্য হাইকোর্ট রায় প্রদান করেন। হাইকোর্টের বিচারপতি নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন। জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান ঘোষণার পর জাতীয় দিবসগুলোতে উপযুক্ত ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদাধিকারী ও রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকর্তা সরকারি অনুষ্ঠানে বক্তব্য শেষে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান যাতে উচ্চারণ এবং সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাত্যহিক সমাবেশ শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণ যাতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করেন সেই আদেশ প্রদান এবং তা আগামী তিন মাসের মধ্যে কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা প্রদান চেয়ে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. বশির আহমেদ হাইকোর্টে রিট করেন।
একটি জাতিকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু একজন নেতাই যথেষ্ট নয়, যদি সেই নেতা তার জাতির সামনে লড়াইয়ের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পরিষ্কার করতে না পারেন এবং তার রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনায় অস্পষ্টতা থাকে। এ কারণে যুগে যুগে পৃথিবীর স্বাধিকার আন্দোলনে কোনও একটি বা কয়েকটি নির্দিষ্ট স্লোগান সেই লড়াই-সংগ্রামে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকেই এই বাংলার পুরো জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করা তথা তাদের স্বাধিকারের পথে নিয়ে যেতে একটি অভিন্ন স্লোগানের খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে। শুরুর দিকে জয় বাংলা স্লোগান নিয়ে কিছুটা মতবিরোধ থাকলেও বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপে সবাই জয় বাংলার পক্ষে অবস্থান নেন।
১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান, রমনা বটমূলে আলোচনা ও র্যালি। সভায় সভাপতিত্ব করেন মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আইয়ুব খান প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার পরে এই প্রথম জনসম্মুখে শেখ মুজিব। মঞ্চে উপবিষ্ট বঙ্গবন্ধুর পেছনে দেবদারু পাতায় ছাওয়া ব্যানারে হলুদ গাঁদাফুল দিয়ে লেখা দুটি শব্দ ‘জয় বাংলা’। ছোট্ট দুটি শব্দ অতি দ্রুত সমাবেশে উপস্থিত জনতার মাঝে ছড়িয়ে যায়। আলোচনা শেষে ছাত্রলীগ ‘জয় বাংলা’ লেখা ওই ব্যানারটি নিয়ে র্যালি বের করে, যা শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। পরদিন সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার পাশাপাশি ‘জয় বাংলা’ ব্যানারটির কথাও উল্লেখ করা হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণের মধ্য দিয়ে কার্যত স্বাধীনতার ডাক দেন। বাঙালি কোথাও পিছিয়ে থাকবে না, বাঙালির কণ্ঠ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাবে- এটাই জয় বাংলার মূল কথা। জয় বাংলা অর্থ বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক। জয় বাংলা স্লোগানটি বাঙালির। জয় বাংলা ও স্বাধীনতা ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজাদী পরিবার শুধু ইতিহাসের অংশ নয়, ইতিহাসের ভিত্তিভূমি।
লেখক : সহ-সম্পাদক, দৈনিক আজাদী