লেখক-পাঠকের আড্ডায় প্রাণবন্ত মেলা

শিল্প সংস্কৃতি রাজনীতি ও আদর্র্শবোধের সূতিকাগার চট্টগ্রাম : আনিসুল হক

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৭:৩৪ পূর্বাহ্ণ

লেখকের প্রতি পাঠকের আকর্ষণ সহজাত। পছন্দের লেখক হলে এ আকর্ষণ হয় আরো দুর্নিবার। তাই লেখকের সঙ্গে আড্ডা দেয়া, অটোগ্রাফ নেয়া কিংবা একটি ছবি তোলার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন পাঠক। তবে এ সুযোগ সবসময় পান না। ব্যতিক্রম কেবল বইমেলা। এখানে মেলবন্ধন ঘটে পাঠক-লেখকের। পূরণ হয় পাঠকের চাওয়াগুলো। পারস্পরিক অন্তরঙ্গ আলাপনে প্রাণসঞ্চার ঘটে মেলায়। মনে হয়, লেখকই যেন পাঠকের অপেক্ষায় ছিলেন এতদিন।
নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে চলছে বইমেলা। গতকাল শুক্রবার ছিল মেলার ষষ্ঠ দিন। এদিন মেলায় উপস্থিত ছিলেন সময়ের জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হক। তাকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন তার পাঠকগণ। মেলামঞ্চে তিনি মুখোমুখি হন পাঠকের। তাদের কৌতূহলী সব প্রশ্নের উত্তর দেন। জানালেন, চট্টগ্রাম নিয়ে তার স্মৃতির কথা। এখানকার নানা গৌরবের ইতিহাস তুলে ধরে বললেন, ‘শিল্প, সংস্কৃতি রাজনীতি এবং আদর্র্শবোধের সূতিকাগার হলো চট্টগ্রাম’।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় গতকাল মেলায় পাঠকের ভিড় ছিল অন্যদিনের চেয়ে বেশি। পাঠকের টানে ছুটে আসেন বহু লেখকও। বিশেষ করে এবার বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত গ্রন্থের লেখকদের সরব উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। তারাও মিটিয়েছেন পাঠকের নানা আবদার। অটোগ্রাফ তো ছিলই, সহ্য করেছেন হাসিমুখে ছবি তোলার অম্লমধুর যন্ত্রণাও। অবশ্য প্রথমদিন থেকেই এ দৃশ্য ছিল স্বাভাবিক। গতকাল মেলার বিভিন্ন স্টলে পাঠকের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখা গেছে এমন সাহিত্যিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার, কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, কবি কামরুল হাসান বাদল, কবি হোসাইন কবির, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান ও মুহাম্মদ শামসুল হক, ছড়াকার আ ফ ম মোদাচ্ছের আলী ও উৎপলকান্তি বড়ুয়া, কবি বিভা ইন্দু, কবি ভাগ্যধন বড়ুয়া, কবি রিমঝিম আহমেদ, কবি তাপস চক্রবর্তী, শিশুসাহিত্যিক শুকলাল দাশ, কথাসাহিত্যিক জাহেদ মোতালেব, গল্পকার শোয়ায়েব মুহামদ, গল্পকার দেবাশীষ ভট্টাচার্য, লোক গবেষক শামসুল আরেফীন, শিক্ষক-গবেষক শামসুদ্দিন শিশির, লেখক সুভাষ সর্ববিদ্যা ও তানভীর পিয়াল। এদের বেশ কয়েকজন সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ ইস্যুতে লেখকের জন্য নির্ধারিত স্থানে প্রাণবন্ত আড্ডা দেন। আড্ডায় সিআরবি ছাড়িয়ে সমকালের বাংলা সাহিত্য থেকে বিশ্বসাহিত্যও স্থান করে নেয়।
পাঠকের মুখোমুখি আনিসুল হক : পাঠকের মুখোমুখি অনুষ্ঠানের সঞ্চালক চবি শিক্ষক ড. আদনান মান্নান শুরুতেই আনিসুল হককে প্রশ্ন করেন, ‘যখন যে শহরে যান সে শহর নিয়ে আপনার স্মৃতির কথা বলেন। চট্টগ্রাম শহরে যখন আসে কি মনে হয়। এ শহর নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
উত্তরে আনিসুল হক বলেন, চট্টগ্রামকে আমি মনে করি শুধু বাংলাদেশের না, এ উপমহাদেশের চিন্তার, আইডিয়ার সূতিকাগার। আমরা এখানে মাস্টারদা সূর্য সেনকে পেয়েছি, প্রীতিলতাকে পেয়েছি। আমরা প্রথম যখন ঢাকা শহরে বিজয় উৎসব, বিজয় মেলা করতে শুরু করলাম, ঢাকায় করার আগে কিন্তু চট্টগ্রামে হয়েছে। আমরা জানি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু কিন্তু বিকেল বেলাতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা মোটামুটি ঘোষণা করে দিয়েছেন। কারণ পুলিশের এসপিকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের মালখানা, অস্ত্র যেখানে আছে খুলে দাও। সব পুলিশ, আনসার, বিডিআরে হাতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে দাও। চট্টগ্রামে নির্দেশ উনি পাঠিয়ে দিলেন- চট্টগ্রামকে বলো তারা যেন সারেন্ডার না করে, কুমিল্লার দিকে আসতে থাকুক। মেজর (অব.) রফিকের ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বইটা পড়ে জানতে পারি এখানে প্রথম মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সিআরবিতে উনি সদর দপ্তর স্থাপন করেন’।
তিনি বলেন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজের লেখার মধ্যে আছে- শেখ হাসিনা যখন ছোট ছিলেন, শেখ রেহানা যখন ছোট ছিলেন, কামাল যখন ছোট ছিলেন। উনারা একবার এখানে বেড়াতে এসেছিলেন। আজিজ সাহেব ছিলেন এখানকার নেতা, হান্নান সাহেব ছিলেন। তারা একদিন পাহাড়ে বেড়াতে বেড়াতে বলেছিলেন- দেখো একদিন আমরা এখান থেকে স্বাধীনতা শুরু করবো। এটা কিন্তু আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিকথার মধ্যে লিখেছেন।
আনিসুল হক তার প্রিয় শিল্পী তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, আইয়ুব বাচ্চু, নকীব খান, শেফালী ঘোষের তথ্য জানিয়ে বলেন, এরা সবাই চট্টগ্রামের। এমনকি মাইজভাণ্ডারী গান এখন যে হাবিব (হাবিব ওয়াহিদ) শিরিনকে দিয়ে গাওয়াচ্ছে সবই চট্টগ্রামের। বলেন, আলাউলের সেই কাব্য এবং এবং এর যে গবেষক ছিলেন তিনিও চট্টগ্রামের। চট্টগ্রামের লিটল ম্যাগাজিন ও প্রকাশনা সব আমার খুব প্রিয় ছিল। কী অপূর্ব বই বেরিয়েছিল। সব মিলিয়ে চট্টগ্রামের দিকে আমরা এখনো তাকিয়ে আছি। চট্টগ্রাম বাংলাদেশকে এখনো দিশা দিক। কর্মজীবনের শুরুতে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে রেলওয়েতে যোগ দেয়ার পর প্রথম চট্টগ্রাম পোস্টিং হওয়ার কথাও জানালেন আনিসুল হক।
সাহিত্যের নানা শাখায় লেখালেখি করলেও নিজেকে কোন ঘরানার লেখক মনে করেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি একজন লেখার শ্রমিক। যে চেষ্টা করছে। এ শব্দগুলো আমার ভালো লাগে। আমি কিন্তু সফল লেখক না। কিন্তু আমি চেষ্টা করি, এটা বলার মধ্যে সততা আছে। এই পরিচয়টা আমার ভালো লাগে, লেখক হওয়ার সিরিয়াস চেষ্টারত একজন তরুণ।
বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন আনিসুল হক। সুযোগ ছিল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি নেয়ার। জীবনকে উপভোগ করার। সব বাদ দিয়ে বেছে নিয়েছেন লেখালেখি। এর কারণটা জানালেন তিনি। বললেন, বোকা বলেই কবি হলাম। আমি যখন ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে আসলাম তখন আমরা বন্ধুরা নানা কথা বলেছিল। তখন তাদের বলেছিলাম, ঢাকা গিয়ে বই লিখব, বিক্রি হবে। যদিও বই লিখলে প্রকাশিত হবে, নাটক চিত্রায়িত হবে তার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু ঘটনাক্রমে এটা ঘটে গেছে। এসময় তিনি লেখক হিসেবে পাওয়া পাঠকের ভালোবাসাকে বড় প্রাপ্তি বলেও জানান। বলেন, শেরপুর থেকে ক্যান্সার আক্রান্ত একজন মা আমাকে দেখার জন্য ঢাকা বইমেলায় এসেছেন। এটার চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে।
বাওয়া স্কুলের শিক্ষার্থী ইন্নির প্রশ্ন ছিল, ২০১৪ সালে গ্রন্থিত আইসটি বই-ই বর্তমানে পাঠ্য। অথচ ২০২২ সালে এসে খাতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষা পাশের জন্য সেই পুরনো তথ্যই লিখতে হবে কেন? আনিসুল হক বলেন, ‘তুমি যেটা সত্য বলে জান সেটা লিখবে। বেশি মার্কসের জন্য মিথ্যা লিখবে না’।
ক্ষুদে পাঠকদের উদ্দেশে বলেন, জীবনে যদি সুখি হতে চাও অন্যের আনন্দ সুখী হও। অন্যের সাফল্যে সুখী হও। যখন লেনদেন করবে তখন ভাববে বেশি পেয়েছি নাকি দিয়েছি। যদি বেশি দিয়ে থাকি তাহলে আমি জিতেছি। কেনাকাটার সময়ও এটা করবে। আমরা যেন দেয়ার বেলায় এগিয়ে থাকি। পাওয়ার বেলায় না। এর আগে আনিসুল হক তারুণ্য উৎসবে বলেন, তারুণ্যের চোখে মুখে স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল বলেই আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। এ প্রজন্মের তরুণরা ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি, তাই বলে দেশের প্রতি ভালবাসা কোন অংশে কম নয়, দেশকে জানতে বুঝতে শিখেছেন প্রতিনিয়ত। তারাই আগামী দিনের উজ্জ্বল নক্ষত্র, তাদের নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে আগামীর বাংলাদেশ। বাংলার তারুণ্য জ্বলে উঠলে আলোকিত হবে বাংলাদেশ। তরুণদের ভালো মানুষ হতে হবে। তারা গড়ে উঠেলে বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে তারুণ্য উৎসবে বক্তব্য রাখেন বইমেলা কমিটির আহ্বায়ক ও কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইন্দু নন্দন দত্ত, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডা. বিদ্যুৎ বডুয়া।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাহাড়ে জনপ্রিয় হচ্ছে মাশরুম চাষ
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন আজ