বায়ান্ন তথা একুশের ভাষা আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে ছিল একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ভাষা যেহেতু একটি সংস্কৃতির প্রধান বাহন সেহেতু ভাষা বিকৃত হলে কিংবা ভাষা হারিয়ে গেলে সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটবে, জাতির অস্তিত্ব ও স্বকীয়তা বিপন্ন হবে সে কথা বা বাস্তবতা পূর্ববাংলার মানুষ ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিল সেদিন।
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত হওয়া পাকিস্তানে তখন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও জাতীয়তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। আর বাঙালির ওপর অপর ভাষা উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা যে বাঙালিকে চিরতরে দাবিয়ে রাখার কৌশল তা খুব সহসাই উন্মোচিত হয়ে পড়েছিল। যে কারণে ভাষা আন্দোলনের গতি ও ব্যাপ্তি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল সমগ্র পূর্ববাংলা জুড়ে।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন সফল হওয়ার পর তার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আমরা পরবর্তীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করি। বিশেষ করে রাজনীতিতে তা দ্রুত প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় ভরাডুবি হয়। জয়লাভ করে যুক্তফ্রন্ট। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কারণে পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট সরকার টেকেনি বটে তবে ততদিনে বাঙালির মানসে জাতীয়তাবোধের স্ফূরণ ঘটেছে।
বায়ান্নের আন্দোলন এভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাগরণ ঘটায়। গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক চেতনা। পুরো ষাট দশক জুড়ে রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জাগরণও ঘটতে থাকে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল। রবীন্দ্রনাথকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করে সরকার। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনায় যে উন্মেষ ঘটে তা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অসামপ্রদায়িক, উদার ও গণতান্ত্রিক চেতনা।
বায়ান্ন থেকে একাত্তর, মাত্র ঊনিশ বছরের মধ্যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো। যার নাম হলো তার ভাষার নামে বাংলাদেশ। যে নীতি ও মতের ভিত্তিতে পাকিস্তানি রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে তার বিপরীত মেরু অর্থাৎ একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বিপরীতে জাতীয়তাবাদ ও ভাষাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র । এই দেশ প্রতিষ্ঠার পর এর মূল চারনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে।
কাজেই বলা যায়, একুশের চেতনার একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
আজ দেশ যখন চরম সামপ্রদায়িক পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করছে, সমাজে যখন মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি, অপসংস্কৃতি ভর করছে তখন পরিত্রাণের আশায় আমরা একুশের চেতনার শরণাপন্ন হচ্ছি। কারণ একুশের চেতনাই পারে এই সমাজকে মানবিক করে তুলতে। সাংস্কৃতিক করে তুলতে। একুশের চেতনাই পারে সমাজ থেকে সকল কূপমণ্ডূকতার অবসান ঘটাতে।
কিন্তু দুঃখজনক হলো, আমরা এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সফল হতে পারছি না। কারণ যে স্বপ্ন ও আদর্শ নিয়ে এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে রাষ্ট্রটিকে সে পথে দীর্ঘদিন চলতে দেওয়া হয়নি। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যা করে এই রাষ্ট্রকে তার কক্ষচ্যুত করা হয়েছে। তাকে আদর্শচ্যুত করা হয়েছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র ঠিক রাখতে না পারলে এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দুরূহ হয়ে পড়বে।
সমাজে আজ যে অনাচার প্রাত্যহিক হয়ে উঠছে তা থেকে মুক্তি দিতে পারে পঞ্চাশ-ষাট দশকের মতো সাংস্কৃতিক জাগরণ। বাঙালির হাজার বছরের যে সংস্কৃতি তার লালন ও চর্চাই পারে আমাদের সকল অশুভ শক্তি থেকে মুক্ত রাখতে। তবে এ কথাও আমাদের স্মরণ রাখা জরুরি যে, ভাষার অমর্যাদা করে, তাচ্ছিল্য করে জাতির স্বকীয়তা রক্ষাও সম্ভব নয়।
কথাগুলো বারংবার বলতে হচ্ছে এ কারণে যে, বর্তমানে ভাষা নিয়ে রীতিমতো অনাচার চলছে দেশে। প্রথমে বানানরীতি নিয়ে বলি। বাংলা একাডেমি একটি বানানরীতি প্রণয়ন করেছে। স্বাভাবিকভাবে দেশের সকলক্ষেত্রে সে বানানরীতিই অনুসরণ করা উচিত। উচিত বলছি এ কারণে, না-ই যদি মানা হলো তাহলে সে বানানরীতি প্রণয়ন করে লাভ হলো কী। এত সময়, এত অর্থব্যয় ও অনেক বিশেষজ্ঞের শ্রম ও মেধা অপচয় করার অর্থ থাকল কী?
একটি সময়ে এসে ভাষার সংস্কারের প্রয়োজন হয়। কারণ তার মানদণ্ড স্থির করতে হয় নইলে অরাজকতা তৈরি হয়। ভাষার ব্যকরণ, বানানরীতি এবং সে সঙ্গে উচ্চারণরীতিও স্থির করতে হয় সে মানদণ্ডের ভিত্তিতে। এটাকেই প্রমিত বানান ও উচ্চারণরীতি বলছি আমরা। এখন দেখা যাচ্ছে বাংলা একাডেমি প্রণীত সে রীতি অনেকে মানছে না এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি নিজেই তা মানে না। অনেক ক্ষেত্রে একই বানান দুভাবেই আছে অভিধানে। ফলে দুটি পত্রিকায় একই শব্দের বানান লেখা হলো দু’ভাবে। এতে অনেক পাঠক বিশেষ করে শিশু-কিশোররা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। এর মধ্যে দু’একটা পত্রিকা নিজেরাই আবার আলাদা ভাষারীতি প্রণয়ন করেছে যেমন প্রথম আলো, ওদের ভাষারীতি নামে একটি আলাদা বই-ই আছে। এদের বানানের সঙ্গে আর কোনো পত্রিকার বানানের মিল নেই। বাংলা একাডেমির অভিধানের সঙ্গে মিল থাকা তো দূরের কথা। একটি উদাহরণ দিতে চাই, কয়েকদিন আগে লক্ষ করা গেল প্রথম আলো ক্ষেত (ক্ষেত্র) যেমন, শস্যক্ষেত, বানানটি লিখেছে ‘খেত’ এভাবে। এখন কেউ যদি লিখেন, ‘আমি ধান খেতে যাব’ তাহলে লোকটির ভয়াবহ পরিণাম ভেবে আমরা শঙ্কিত হব। আর বড্ড বিভ্রান্ত হব যদি কেউ লিখেন, ‘আমি পান খেতে যাচ্ছি’ দেখে।
আমি সংস্কারের বিপক্ষে নই তবে সংস্কার যদি বড় কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে তাহলে শঙ্কিত না হয়ে পারা যাবে না। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিম বাংলার নানাক্ষেত্রে তফাৎটি প্রকট হয়ে উঠেছে। বিদেশি শব্দের বানান, ভাষার লিঙ্গবৈষম্য কমানো, বানান জটিল থেকে সহজ করা, বাহুল্য বর্জন করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে কোনো আপত্তি নেই কিন্তু হঠাৎ একদিন ‘ঈদ’কে ‘ইদ’ করে দেওয়া বা ‘ক্ষেত’কে ‘খেত’ করে দেওয়ার মধ্যে অরাজকতা আছে বলে ধরে নিলে দোষ দেওয়া যাবে না। ভাষা বদলাবে, এটাই নিয়ম। শুধু বাংলা নয় বিশ্বের সব ভাষাই একটু একটু করে বদলায়। কারণ ভাষা প্রবহমান নদীর মতো। এর আঁকাবাঁকা গতিপথ থাকবেই। নদীর গতিপথে বাধা দিলে যেমন বিপত্তি তৈরি হয় তেমনি ভাষার ক্ষেত্রেও হয়।
অনেকে অভিযোগ করেন এভাবে ভাষার খোলনলচে পাল্টে দিলে একসময় এদেশের পাঠকরা বলবে, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল তো সব ভুল বানানে লিখেছেন।
এই স্বেচ্ছাচারিতা শুধু বানানের ক্ষেত্রে চলছে তা নয়। উচ্চারণের ক্ষেত্রে এখন চরম নৈরাজ্য চলছে বলা যেতে পারে। বিশেষ করে দেশের নাটক ও কিছু কিছু সিনেমায় যে ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে তা কোথায় প্রচলিত আছে তা ভেবে কূলকিনারা পাওয়া যায় না। প্রথম আলো পরিবারের নতুন সংযোজন চরকিতে কয়েকদিন আগে তুরস্কের একটি সিনেমা দেখতে বসেছিলাম। বলাবাহুল্য চরকি কিছু বিদেশি ছবি ডাবিং করে দেখায়। তো সে ছবি দেখতে গিয়ে আমার আক্কেলগুড়ুম! ছবির পাত্রপাত্রিরা কথা বলছে সামপ্রতিক বাংলা নাটকের সে ভয়াবহ আজগুবি ভাষায় যা একটি বিদেশি ছবির ক্ষেত্রে চরম বেমানান। আমার কাছে কোনোভাবেই বোধগম্য হলো না ডাবিংয়ে কেন সমাজে অপ্রচলিত, চাপিয়ে দেওয়া ভুল ভাষা ব্যবহার করতে হবে।
কোন শব্দ কীভাবে উচ্চারণ করতে হবে তার প্রমিত রীতি আছে। নৈরাজ্য ঠেকাতেই তা করা হয়েছে। সেটা মান্য করা উচিত। নৈরাজ্য সৃষ্টি করা স্বাধীনতা নয়। ফলে ভাষার মানদণ্ড ঠিক রাখতে হলে, শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে, সবার কাছে গ্রহণীয় রীতি অনুসরণ করতে হবে। নতুবা একসময় একেক জায়গার মানুষ একেকভাবে কথা বলবে, ইচ্ছেমতো বানান লিখবে নতুন প্রজন্মের সন্তানরা কোনো দিশকূল পাবে না তখন।
লেখক : কবি-সাংবাদিক