আমাদের চারপাশের কর্মকাণ্ড দেখলে বোঝা যায় আমরা কতটুকু একুশের চেতনার দ্বারা প্রভাবিত।হতাশার বিষয় হচ্ছে আমরা নিজ ভাষা চর্চা থেকেও পরভাষা চর্চায় আগ্রহী। ভুলে ভরা ইংরেজী,হিন্দীর চর্চাকে আধুনিকতা মনে করি।ভাষার দাবীতে শহীদরা প্রাণ দিয়ে যে আত্মত্যাগের, দেশপ্রেমের, সংস্কৃতি রক্ষার নজির স্থাপন করে গেছে তাতে আজ রক্তক্ষরণ চলছে। আমাদের এতো সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা থাকতে আমরা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র ইংরেজিতে নামকরণ করার চেষ্টা করছি, আবার যেসব সাইনবোর্ডে বাংলা লিখা তাও আবার ভুলে ভরা। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ইংরেজি হরফে বাংলা লিখছি, এ লজ্জা রাখি কোথায়? কারণ পাকিস্তানী শাসকচক্র ও এমনটা চেয়েছিল। আমাদের এমন পরিণতির কারণ আমরা ইতিহাস বিমুখ, ইতিহাসের চেতনা অন্তরে ধারণ করি না।
১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রথম আদমশুমারীতে দেখা যায় পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫৪.৬০% বাংলা,২৮.০৪% পান্জাবী, ৭.২%উর্দু, ৭.১%পশতু, ৫.৮%সিন্ধি এবং বাকীটা অন্যান্য ভাষাভাষীর নাগরিক। উর্দু তৃতীয় স্থানে থাকার পরও সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য শাসকগোষ্ঠী বেশকিছু পরিকল্পনা নেয়।যেমন-উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে গণমাধ্যমে উর্দুর ব্যবাহার,মানিঅর্ডার, ডাকটিকেট এবং সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উর্দুর ব্যবহারের নির্দেশে বাঙালী প্রতিবাদ জানায়। ১৯৪৮ সালের মার্চে পাকিস্তানের গভর্নর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে এসে রেসকোর্সে নাগরিক সমবর্ধনা ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে মতামত দিলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ১৯৪৯-১৯৫১ পর্যন্ত আরবী হরফে বাংলা লিখার ষড়যন্ত্র চালায়। ১৯৪৯ সালে ভাষা সংস্কারের জন্য গঠিত ভাষা কমিটি কতিপয় বাংলা বর্ণমালার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে এগুলি হিন্দুদের সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে এগুলিকে অ্যা বর্ণযুক্ত করার পরামর্শ দেয়। ১৯৫২সালে খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ২৭জানুয়ারী উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে প্রতিবাদে বাংলার ছাত্রসমাজ ধর্মঘট পালন করে, সরকার ২১শে ফেব্রুয়ারি এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারী করলে বাঙালিরা তা অমান্য করলে পুলিশের গুলিতে শহীদদের তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়। পূর্ববর্তী পদক্ষেপসমূহ ব্যর্থ হলে ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খান রোমান হরফে বাংলা ও উর্দুভাষা প্রবর্তনের পদক্ষেপ নেয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় বেতার টেলিভিশনে রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করা হয়,১৯৬৭ সালে পহেলা বৈশাখ পালনকে আইয়ুব খান হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব আখ্যা দিয়ে বাঙালী সংস্কৃতির উপর কুঠারাঘাত করেন। বাংলার শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, ছাত্র জনতা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে শরীক হয়।উল্লেখ্য ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু তিনবার গ্রেফতার হন। ১৯৭১ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী বাংলা একাডেমীর একুশের অনুষ্ঠানমালা উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু হবে।তিনি কথা রেখেছিলেন ১৯৭৫ সালের ১২ই মার্চ এক আদেশে বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি স্বাধীনতার তিনবছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজী ভাষায় নথিপত্র লিখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আইন থাকা সত্বেও সর্বস্তরে বাংলাভাষা প্রচলন হচ্ছে কিনা তা দেখবার জন্য কোনো মনিটরিং সেল নেই।
বহু আন্দোলন সংগ্রাম ও শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের বাংলা ভাষা। সে ভাষার বিকৃতি দেখলে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। ভারত, জার্মান, সৌদিআরবসহ অনেক দেশের মানুষ ইংরেজি জানা সত্বেও ইমিগ্রেশনসহ অন্যত্র বিদেশীদের সাথে ইংরেজী না বলে মাতৃভাষায় কথা বলে আর আমরা ইংরেজী ভালো না জেনেও নিজেকে জাহির করার জন্য আগ বাড়িয়ে ভুলে ভরা ইংরেজী বলি। আমাদের দেশপ্রেম তলানীতে। আমাদের বিদেশী পন্য বিদেশী ভাষার প্রতি দরদ বেশী। সময়ের দাবী সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে যানবাহনে বাংলার নীচে ইংরেজী থাকতে পারে। যেখানে ২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সেখানে বাংলা ভাষা চর্চার প্রতি আমাদের দরদ বেশী থাকতে হবে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও একুশের চেতনা অন্তরে ধারণ করতে হবে তবেই সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার করার প্রতি আগ্রহী করে তোলা সম্ভব।