গভীরতর তাত্পযের্র বার্তা নিয়ে প্রতিবছর আসে মহান একুশে।এদিন শুধু উৎ সব নয় প্রতিজ্ঞার দিন। বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, শিল্প বানিজ্য -সর্বত্র শক্তি ও মর্যাদা উদ্ধারের দিন।
বেগম রোকেয়া তাঁর একটি বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন -“আমরা সকলেই চেতনা লোকে মোট তিনটা স্তর বা কোঠাকে ধারণ করি।সবচেয়ে নিচের কোঠায় থাকে হিন্দু বা মুসলমানের মতো ধর্ম পরিচয়।সে কোঠার উপরে বাস করে বাঙালি, পাঞ্জাবি বা ইংরেজের মতো আধুনিক জাতি পরিচয় ধারী। আর সবচেয়ে উপরের যে কোঠা সেখানে শুধু মানুষ -কোন ধর্ম পরিচয় নেই, একমাত্র মানুষ। ” ভাষা আন্দোলন সহ এ দেশের গত একশো বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে ও রোকেয়ার এই উপমাকেই মনে করতে হয়। ভাষার সাথে গভীর সম্পর্ক মনুষ্যত্ববোধের কারণ ভাষার সাথে সম্পৃক্ত মানুষের মানসিক ও নৈতিক বিকাশ। মায়ের মুখের বোল এক একটি শব্দ এক একটি বাক্য হয়ে শিশুর সামনে খুলে দেয় ভাবের জগত। এভাবেই ধাপে ধাপে সে হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ একজন মানুষ। তাই মনুষ্যত্ব ও ভাষা নিয়ে কোন আপোষ চলেনা। মাতৃভাষার এই যে দাবি এই যে বৈশিষ্ট্য এরই কারণে ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আমাদের ভাষা সৈনিকেরা অবলীলায় প্রাণ দিয়েছে। অর্থাৎ সত্যের জন্য, মনুষ্যত্বের জন্য মরতে জানার উত্তরাধিকার রেখে গেছে তাঁরা। একুশের বার্তা মানে বাঙালি চেতনার শুদ্ধতর উদ্বোধন। কবি হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের শহীদের স্মরণে একুশের সংকলনে তাঁর কবিতায় চেতনার যে দিগন্ত সেখানে সৃষ্টি হয়েছে দেশ জাতি ও মাতৃভাষা নিয়ে গভীর ভাবনা ও সবকিছুকে ঘিরে মানবতার বিকাশ। একুশে ফেব্রুয়ারি জাতিকে জাতীয় স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত করেছে।একটি দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী একই ভাষা বা বিভিন্ন ধমের্র হলেও ভাষার পরিচয়ই প্রাধান্য পায়।জাতির একাধারে বিজ্ঞানসম্মত ও আধুনিক সংজ্ঞা হলো” ইতিহাসের বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এক স্থায়ী জনসমাজ যখন ভাষা,ভূখণ্ড, অর্থনৈতিক জীবন (ব্যবস্থা নয়) এবং মানসিক গঠন প্রণালীর ঐক্যের মাধ্যমে একই সংস্কৃতির সাধারণাধিকার ভোগ করে, তখন গড়ে ওঠে জাতি”-মহান একুশে আমাদের সাহসী ও প্রতিবাদী করার সাথে সাথে প্রেরণা হয়ে এগিয়ে নিয়েছে সামনের দিকে। ধাপে ধাপে বিভিন্ন আন্দোলন এবং অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ। ঐ সময়ে শিল্পী কামরচল হাসান তাঁর তুলি ও লেখনীতে -“একটি বাংলা অক্ষর একটি বাঙালির জীবন “আর বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান সবাই বাঙালি। ” অসামান্য সেই পোস্টার–” এসো আমরা এই জানোয়ারকে হত্যা করি”- পরম ক্ষোভে ও বেদনায় বলতে হয় আমরা সব ভুলতে বসেছি। একুশের বার্তাকে কতোটা লালন ও ধারণ করছি। ১৯৫৪ সালের যুক্ত ফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পেছনে যে একুশটা দাবি ছিল তার অনেকগুলোই পূরণ করা হয়নি। আমরা কি বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে প্রচলন করতে পেরেছি! বরং ইংরেজী ভাষার প্রতি অতি প্রীতির কারণে কতো কতো ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়! অবশ্যই এই বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজি ভাষা শিখতে হবে কিন্তু বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা কোনভাবেই না। একুশটা দাবির অন্যতম ছিল দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতি বন্ধ সহ আরও অনেক যৌক্তিক দাবি। শিক্ষা পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় যেমন একপ্রকার হযবরল অবস্থা তেমনি পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা তথাকথিত কানাডার বেগম পাড়া! বড়ো লোকদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দুর্বৃত্তায়ন,তরচণদের এক অংশকে নিজেদের লেজুড়বৃত্তিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত করা, একইসাথে বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চুপ থাকা, আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার কাছে নতজানু রাজনীতি সহ চরম এক অবক্ষয়ের মুখোমুখি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চরম সংকটে। কিন্তু মহান একুশের বার্তাতো এসবের সাথে যায় না।
তবে হতাশ না হয়ে বরং আবারও মহান একুশের বার্তায় জাগ্রত হোক বিশেষত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং তরচণ সমাজ। এ প্রত্যাশাকে জাগিয়ে রাখা দরকার। লেখক: শিক্ষক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক