ড. ছানাউল্লাহ ব্যারিস্টার: এক অনন্য মনীষী

মোহাম্মদ আলম | রবিবার , ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ


মরহুম আল্লামা ড. ছানাউল্লাহ বার-এট-ল ছিলেন এক অসাধারণ বহুমুখী প্রতিভাধর, জ্ঞানসাধক, ইসলামী চিন্তাবিদ, আইন ও রাজনীতিবিদ এবং সমাজ সংস্কারক। তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপ ও ক্ষেত্র অসামান্য অথচ বৈচিত্র্যপূর্ণ বিশাল কর্মযজ্ঞ যে কাউকে একটু হলেও ভাবিয়ে তুলে। কীভাবে সম্ভব এত প্রতিভা আর এত অর্জন! ১৯০৫ সালে ১ মার্চ চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার হালদা নদীর পলি বিধৌত উত্তর মাদার্শা গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। সম্ভ্রান্ত মুসলিম ও ধনাঢ্য পরিবারে পিতা আনর আলী ও মাতা রাফেয়া খাতুনের সংসারে তিনি একমাত্র সন্তান।
বর্তমান মিয়ানমারের আকিয়াব শহরে পিতা আনর আলী ইংরেজদের অধীনে পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। ইংরেজদের সংস্পর্শে থাকায় একমাত্র সন্তানকে শুরু থেকে আধুনিক ইংরেজী শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত করার জন্য পিতাঁর খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শৈশবকাল থেকে ইসলামী দ্বীনি শিক্ষার আগ্রহের কারণে প্রথম ছবক নেন মক্তবে আরবীতে। এরই ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশের বিখ্যাত ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাটহাজারী মইনুল ইসলাম মাদ্রাসা থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে জামাতে উলা ( ফাজিল) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এর পর ভারত বর্ষের প্রখ্যাত মাদ্রাসা সাহারানপুর মোজাহের-ই-উলুম, থেকে দাওরায়ে হাদীস ( টাইটেল সমমানের) ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯২৬ সালে উপমহাদেশের আরেক বিখ্যাত দেওবন্দ মাদ্রাসা হতে সর্বোচ্চ ডিগ্রী ‘ফখরে মোহাদ্দেসীন’ অর্জন করেন।
এর পরপর পরিবারের ইচ্ছায় চট্টগ্রামের রাউজান থানার সুলতানপুর গ্রামের ডেপুটি বাড়ির সাহেব মিয়া চৌধুরীর কন্যা জরিনা বেগমের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁরপর থেকে তাঁর জীবনের ইতিহাস অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় পরিবর্তন শুরু।
শ্বশুরবাড়ীর আধুনিক ইংরেজী শিক্ষিত পরিবারের কেউ কেউ মাওলানার সাথে এ বিয়ে সাদরে গ্রহণ করতে পারেনি। এতে মাওলানা ছানাউল্লাহর মনে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তৎক্ষণাৎ তিনি আধুনিক ইংরেজী শিক্ষার জন্য উজ্জীবিত হয়ে তা অর্জনের জন্য ঝাপিয়ে পড়েন।
তাঁর অদম্য উৎসাহ ও প্রবল ইচ্ছার সাথে অসাধারণ মেধার সমন্বয়ে মাদ্রাসায় পড়ুয়া মাওলানা আধুনিক ইংরেজী শিক্ষায় ঝড়ের বেগে অত্যন্ত সফল ও কৃতিত্বের সাথে একের পর এক ডিগ্রী অর্জন করেন।
১৯২৭ সালে হাটহাজারী পার্বতী উচ্চ বিদ্যালয় হতে বৃত্তি সহ ১ম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বৃত্তিসহ ১ম বিভাগে আই.এ পাস করেন ১৯২৯ সালে। ১৯৩১ সালে আরবী, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে Distinction নম্বর পেয়ে বৃত্তিসহ ১ম বিভাগে বি.এ পাস করেন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। এর পর এম.এ পাস করেন কেনটাব ইউনিভার্সিটি থেকে। একই সময়ে ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পর পর ২ বার উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৪ সালে লিংকন্‌স-ইন ইউনিভার্সিটি থেকে বার-এট-ল ডিগ্রী নিয়ে পিতার লালিত স্বপ্নও পূরণ করেন। ১৯৩৫ সাথে আরবের ইতিহাসের উপর ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।
পড়ালেখা শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্ম জীবন শুরু হয়। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের আরেক মহান কৃতী পুরুষ ও সমাজ সংস্কারক মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদীর সাথে জমিয়াতুল হিন্দ পার্টিতে অন্যতম সহসভাপতি পদে যোগ দিয়ে রাজনীতি জীবন শুরু করেন। রাজনীতিতে তিনি এবং তাঁর দল জাতীয়তাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে নিখিল ভারত কংগ্রেস দলের সাথে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে সহযোগী ভূমিকা পালন করেন। রাজনীতিতেও তিনি বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শীতার পরিচয় দেন। ১৯৩৭ ও ১৯৪৫ সালে অবিভক্ত ভারতের বঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের উত্তর চট্টগ্রাম আসন হতে দু’বার এম এল এ নির্বাচিত হন।
রাজনীতি তাঁর জীবনে একমাত্র পেশা ছিল না। বহুমুখী প্রতিভাধর এ মহান মনীষী জীবনের বিভিন্ন সময় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
১৯৪২ সাল হতে ভারতের পি.এস.সি তাঁকে বিভিন্ন উচ্চতর ও গুরুত্বপূর্ণ পদে মনোনীত করেন। সর্বশেষ পশ্চিম বাংলার সিনিয়র এডুকেশনাল সার্ভিসের ‘প্রফেসর’(আই.সি.এস. সমতুল্য) হিসেবে মনোনীত হন। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ফেডারেল পাবলিক কমিশনার পদেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
কলকাতা হাইকোর্টে প্রথম শ্রেণির গেজেটেড জুডিশিয়াল কর্মকর্তা হিসেবে তিনি কাজ করেন। দীর্ঘ ১২ বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী, ফার্সি ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা ও প্রধান পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনীতি ও অন্যান্য পেশাগত কারণে তিনি অধিকতর সময় কলকাতা ও চট্টগ্রামে অবস্থান করতেন। তাঁর কলকাতার বাসভবন ছিল চট্টগ্রামের ধনী-দরিদ্র ছাত্র ও বেকারদের আশ্রয়স্থল। কলকাতা থাকাকালীন সময়ে শেরে বাংলা এ.কে ফজুলুল হক, গণমানুষের অন্যতম প্রাণ পুরুষ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও ডা. বিধান কৃষ্ণ রায়ের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠে।
তাঁর স্বকীয় চিন্তার উপলব্ধি ও দূরদর্শীতা দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের উৎপত্তির সাথে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব বাংলা) অন্তর্ভুক্তি ভৌগলিক, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে কখনও স্থায়ী এবং টেকসই হতে পারেনা। তাই তিনি প্রায়শ বলতেন এটা পাকিস্তান নয়, ফাঁকিস্তান। পরবর্তীতে তাঁর ধারণা সঠিক প্রমাণিত হলেও পাকিস্তান জন্মের সময় আনন্দের আবেগে কেউ কেউ তাহাকে সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এর জন্য তাঁকে কিছুটা সমালোচিত হতে হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক তখনকার সময়ে চট্টগ্রামের এক জনসভায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ড. ছানাউল্লাহ ব্যারিস্টার আমাদের দেশের এক অমূল্য সম্পদ। তাঁর যেন কোনো অমর্যাদা করা না হয়।
১৯৫৮ সালে ড. ছানাউল্লাহ পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের এডিশনাল ক্লেইম কমিশনার নিযুক্ত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা হাইকোর্টের এডমিনিস্ট্রেটর জেনারেল পদে থাকাকালীন ১৯৬৩ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এর আগে আট বৎসর চট্টগ্রাম জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও স্কুল বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁর জীবনের ইতিহাস থেকে জানা যায় কলকাতা, চট্টগ্রাম সহ সারাদেশে অন্তত ২৪টি সরকারি ও বেসরকারি সেবা- সমাজকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
তাঁর রচিত ও বাংলা অনুবাদের অনেক পুস্তিকার মধ্যে তাঁর অনন্য সৃষ্টি (তাঁর পিএইচডি থিসিস) The Decline of the saljuqid empire বইটি কলকাতাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে Reference ও পাঠ্য বই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ১৯৪৫ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত The Biographical Encyclopedia of the world এর তৃতীয় সংস্করণে পৃথিবীর অন্যসব বিখ্যাত মনীষীদের সাথে তাঁর নামও স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। ইংরেজীতে আরও একটি অন্যতম সৃষ্টি Islamic Conception of State and some two political institution of Islam. এছাড়া তাঁর রচিত ও অনুবাদকৃত অনেকগুলো বই রয়েছে যা বর্তমানে প্রায় দুষ্প্রাপ্য।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন হযরত মুফতিয়ে আযম ফয়জুল্লাহ (রাঃ) এর তিনি একজন প্রিয় ছাত্র ও খলিফা ছিলেন। উপমহাদেশের আর এক প্রখ্যাত ইসলামী সাধক মৌলানা ইলিয়াস (রা.) এর তিনি অনুসারী ও শিষ্য ছিলেন।
তিনি সারা জীবন পবিত্র কোরআন ও হাদিস এর আলোকে নিজের জীবনকে গড়ে তুলে পরিপূর্ণ মুসলমান হিসেবে জীবন যাপনে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। দেশে বিদেশে অগণিত মুসলমানদেরকে মহান আল্লাহর প্রদত্ত শান্তির ধর্ম ইসলামী জীবন চর্চা ও অনুসরণে সুশিক্ষা এবং অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তাঁর জীবনের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, আধুনিক ইংরেজী শিক্ষায় এত ডিগ্রী ও জ্ঞান অর্জন তাঁর জীবন যাপনে প্রাচ্যের কোনো প্রভাব বা ছায়া একটুও পড়েনি। জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মনে প্রাণে, চাল-চলনে, আচার-ব্যবহারে একজন খাঁটি মুসলমান হিসেবে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।
কোরআন হাদিস ছিল তাঁর সারা জীবনের আদর্শ ও সঙ্গী। তিনি তাবলিক জামাতের নেতৃত্ব নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশ ও স্বদেশের আনাচে কানাচে ভ্রমণ করেছেন। সহি কোরআন সুন্নাহর দাওয়াতি কাজ করে ইসলাম প্রচার, প্রসার ও এর মহিমাকে অগণিত মুসলমানের কাছে পৌঁছে দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। সারা জীবন অতি সাধারণভাবে জীবন যাপন করেছেন। এ মহান মুসলিম মনীষীর জীবন কলুষমুক্ত বর্ণাঢ্য বিশাল গৌরবময় কর্মযজ্ঞ যা সততা, পাণ্ডিত্য ও কৃতিত্বের সফলতায় ভরপুর। তাঁর জীবনের অন্যতম ও প্রধান ব্রত মানুষের কল্যাণ, সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করা। কোরআন হাদিসের আলোকে সত্য, ন্যায় ও সহি পথে দাওয়াত দেওয়া। আর এসব কর্ম কেবল মহান আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তিনি অরিরাম মেহনত করেছেন। কাউকে যশ, খ্যাতি ও ক্ষমতা দেখানোর জন্য নয়। বর্তমান সমাজের অন্ধকার, কুসংষ্কার, অপসংস্কৃতি ও নৈতিকতা সহ সব অবক্ষয় থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা এবং অনুপ্রেরণা হতে পারে মরহুম আল্লামা ড. ছানাউল্লাহ ব্যারিস্টারের জীবনের গল্প। ক্ষণজন্মা এ মহান মুসলিম মনীষীর ৫৯ তম মৃত্যুদিবসে এই প্রত্যাশা রইল।
লেখক: সৌদি আরব প্রবাসী প্রাবন্ধিক ও সিআইপি

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধদৈনিক আজাদী