বলা হয়ে থাকে, প্রতিটা দেশের প্রাণ তার নাগরিক, নাগরিকদের অধিকার উপেক্ষা করে রাষ্ট্রযন্ত্র কখনোই সচল থাকতে পারে না, নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত না করতে পারলে রাষ্ট্র মুখ থুবড়ে পড়বে। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার মৌলিক মানবাধিকার। এর বাস্তবায়ন সব সরকারের পবিত্র দায়িত্ব। এটি নিশ্চিত করার যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে তেমনি গ্রহণের জন্যও নাগরিক এর দায়িত্ব রয়েছে। সরকার এবং নাগরিক এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে স্বাস্থ্য সেবাকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার কৌশলগুলো নিয়ে কাজ করা এখন জরুরি। দেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং সেবা প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেবাপ্রদানকারী – সেবাগ্রহণকারীর মধ্যে নানা দিক থেকেই উপলব্ধির ঘাটতি রয়েছে। নানাবিধ কারণে সাধারণ মানুষ চিকিৎসা সেবা গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে। এর মধ্যে হাসপাতালের অব্যবস্থাপনাই মুখ্য একটি কারণ।
গতকাল ৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদীতে ‘৮ ঘণ্টা বন্ধ ডায়ালাইসিস সেবা, দুর্ভোগে রোগীরা, চমেক হাসপাতালের স্যান্ডর সেন্টার আপাতত চালু হলেও কাটছে না অনিশ্চয়তা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরকারের কাছ থেকে বকেয়া পাওনা না পাওয়ায় গত বুধবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের নিচ তলায় কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ রাখে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান স্যান্ডর মেডিকেইডস (প্রা.) লিমিটেড। হঠাৎ ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ করায় দূর-দূরান্ত থেকে সেবা নিতে আসা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কিডনি রোগী ও তাদের স্বজনরা দুর্ভোগে পড়েন। আগাম ঘোষণা ছাড়া সেবা বন্ধ রাখায় সেন্টারের সামনে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন তারা। যদিও পরবর্তীতে বিকেল ৪টার দিকে পুনরায় সীমিত আকারে এ সেবা চালু করা হয়েছে। তবে সীমিত আকারে চালু করা হলেও এখন থেকে এ ডায়ালাইসিস সেবা চালু রাখা নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় ঢাকার জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও চমেক হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিসে দুটি সেন্টার স্থাপন করে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্যান্ডর মেডিকেইডস (প্রা.) লিমিটেড। সেবাদান বাবদ সরকারের কাছ থেকে ২৩ কোটি টাকা পাওনা বকেয়া রয়েছে দাবি করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে একযোগে ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে গত ৫ জানুয়ারি থেকেও দুটি সেন্টারে একযোগে ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর আগের দিন (৪ জানুয়ারি) রাতেই ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধের এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে প্রতিষ্ঠানটি। স্যান্ডর কর্তৃপক্ষের দাবি- ওই দিন (৪ জানুয়ারি) বৈঠকে এক সপ্তাহের মধ্যে বকেয়া পাওনা পরিশোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত করে। সরকারের ওই আশ্বাসের প্রেক্ষিতে কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধের ঘোষণা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু প্রায় মাস হতে চললেও সরকারের কাছ থেকে বকেয়া পাওনা পাওয়া যায়নি। আর সরকারের কাছ থেকে বিল না পাওয়ায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না স্যান্ডর। যার কারণে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তাদের আর কাঁচামাল সরবরাহ করছে না। এতে করে ডায়ালাইসিস সেবা চালু রাখা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বলে জানানো হয়।
করোনা মহামারীতে স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে ভয়াবহ ব্যর্থতা দেখা গেছে সে রকম অব্যবস্থাপনা কিন্তু স্বাভাবিক সময়েও থাকে। দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসক, হাসপাতাল শয্যার সংখ্যা, মাথাপিছু বরাদ্দ এতটাই কম যে সংশ্লিষ্ট সেবা খাতটি কোনো সময়েই ন্যূনতম সেবাও নিশ্চিত করতে পারে না। আর তেমন একটি বাস্তবতায় খুব স্বাভাবিক কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির বিষয়টি আরো অবহেলিত থেকে গেছে। আর বিষয়টি এমন নয় যে শুধু আর্থিক বরাদ্দ বাড়িয়ে দিলেই সমাধান হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির পূর্বশর্ত হিসেবে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যার জন্য সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, বিদ্যমান বৈষম্য সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক-অর্থনীতির খোলনলচে পাল্টানোর প্রয়োজন হবে। গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক আর ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া সেকেলে উন্নয়ন ধারারও বদল দরকার হবে। সর্বোপরি প্রয়োজন হবে অধিকারভিত্তিক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। রোগীরা ডায়ালাইসিসের জন্য এসে সেন্টার বন্ধ পেলে তাদের মধ্যে কীরকম প্রতিত্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে, তা সহজে অনুমেয়। ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ করা যেমন অনূচিত, তেমনি সরকারের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা বকেয়া থাকাও শোভনীয় নয়। আমরা এ ব্যাপারে স্থায়ী সমাধান প্রত্যাশা করছি।