জিনোগ্রাফট : চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত

শঙ্কর প্রসাদ দে | বৃহস্পতিবার , ২৭ জানুয়ারি, ২০২২ at ৮:১১ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের স্বনামধন্য চিকিৎসক ও মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ জাফরউল্লাহ্‌ চৌধুরী বেঁচে আছেন, সপ্তাহে দু’বার ডায়ালিসিসের ওপর। কারণ তাঁর কিডনী ফেইলিউর। স্কুল শিক্ষক নির্মল কাকা বছর খানেক ধরে ডায়ালিসিসের ওপর বাঁচতে গিয়ে হয়েছেন নিঃস্ব। শেষ পর্যন্ত আমাদের ছেড়ে চলেই গেলেন। শিকারপুরের প্রবীর সেনগুপ্ত ডায়ালিসিসের ব্যয় মেটাতে গিয়ে শেষতক মধ্যম গ্রামের বাড়িটাই বিক্রি করেছেন। এখন বৌদি একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। হার্টের বহু রোগের মধ্যে অন্যতম একটি হলো ধীরে ধীরে রোগী চলাচলের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। হার্ট ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে পড়তে থাকে। অবশেষে মৃত্যু অথচ তাৎক্ষণিকভাবে কিডনী রোগীকে কিডনী এবং হার্টের রোগীকে হার্ট সংযোজন করা গেলে মৃত্যু এড়ানো সম্ভব।

সংযোজন বিকল্প মাত্র তিনটি ১) অন্য মানুষের কিডনী বা হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন ২) কৃত্রিম কিডনী বা হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন ৩) অন্য প্রাণীর কিডনী বা হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন। এটিকে বলা হয় জিনোগ্রাফট। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রায় ১৫ দিন দেবী শেঠীর নারায়ণ হৃদয়ালয়ে হৃদরোগীদের সমাগম দেখে স্তম্বিত হয়ে যাই। বেশীরভাগ রোগীই বাংলাদেশী বিশেষত চট্টগ্রামের। বুঝলাম গরুর মাংস আর শুটকীর মতো মুখরোচক খাদ্যের কারণে এই স্বাস্থ্য বিপর্যয়। আমার ডাক্তার বন্ধুর মতে শুধুমাত্র শুটকীর কারণে চট্টগ্রামের মানুষের গড় আয়ু কমছে কম পাঁচ বছর কম। খোঁজ নিয়ে দেখুন আপনার আশে পাশেই ভুরি ভুরি হৃদরোগী। এসব রোগীর বড় অংশের প্রধান সমস্যা শিরা উপশিরা দিয়ে রক্ত চলাচলে বাধা। এটাকে হার্ট ব্লক বলা হয়। এক সময় ওপেন হাট সার্জারীর মাধ্যমে শরীরের অন্য অংশ থেকে শিরা এনে জোড়া দেয়া হতো। সেটি এখন অনেক উন্নত হয়েছে। এখন যান্ত্রিক উপায়ে বেলুনিং পদ্ধতিতে এসব ব্লক পরিস্কার করে দেয়া হয়। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে হার্টের কার্যকারীতা দীর্ঘদিন সচল থাকে।

কিন্তু এমন অনেক রোগী আছেন যাদের হৃদপিন্ডই ক্ষতিগ্রস্ত। এখনো অবধি ক্ষতিগ্রস্থ হৃদপিণ্ড স্বাভাবিক রাখার প্রধান চিকিৎসা মেডিসিন। এটির সহজ একটি সমাধান হলো হার্ট প্রতিস্থাপন। হার্ট সংযোজন সহজ বিষয় নয়। প্রত্যেক মানুষের হার্টতো একটাই। কারো হার্ট অন্যকে দেয়ার সুযোগ নৈতিকভাবে প্রায় নেই বললেই চলে। বিজ্ঞানীরা মৃত্যুপথযাত্রী বা সদ্যমৃত ব্যক্তির হার্ট নিয়ে সংযোজনের প্রচেষ্টা চালিয়ে দেখেছেন। এ ধরণের হার্ট বলতে গেলে পাওয়াই যায় না। অন্যান্য সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধজনিত বাধা তো আছেই। বিংশ শতকে মহাকাশ বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্যের পর চমক দেখিয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞান। তারই ধারাবাহিকতায় গত দু দশক ধরে বিকল্প হার্টের সন্ধানে কৃত্রিম হার্ট প্রকল্প নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেকদূর এগিয়েছেন। একই সময় অন্য প্রাণীর হার্ট মানব শরীরে সংযোজনের একটি প্রকল্প নিয়ে বিজ্ঞানীরা অগ্রসর হয়েছেন। ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড এর একদল গবেষক স্কুল অব মেডিসিনের সার্জন বার্ট লে গ্রিফিথ এই গবেষনার নেতৃত্বে আছেন। তাঁর মতে অনেক রোগীর হার্ট কোন ধরনের চিকিৎসা বা আংশিক মেরামতের পর্যায়ে থাকে না। ঐসব রোগীর জন্য চাই হয় কৃত্রিম হার্ট বা অন্য প্রাণীর হার্ট।

গ্রাফটিং এখন গ্রামের মানুষও বুঝে। যতটুকু বুঝেছি জাম্বুরা ও লেবুর জেনেটিক কোড কাছাকাছি। জাম্বুরা গাছের সাথে লেবু গাছের একটি ডাল জোড়া লাগিয়ে দেয়ার কিছুদিন পর দেখা যায়, লেবুর ডালটি বড় হচ্ছে। লেবু ধরছে। আসলে বৃক্ষের গ্রাফটিং এর অন্য সংস্করণ হলো জিনোগ্রাফট।

বহু প্রাণীর উপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে শুকুরের হার্ট জেনেটিঙ মানব জেনেটিক্‌সের কাছাকাছি। একটি সুস্থ শুকুরের হার্টের কিছু জিনগত মেরামতের পর মানব শরীরের জীনগত বৈশিষ্টসম্পন্ন করে তোলার অক্লান্ত পরিশ্রম পরিণতি পেয়েছে ২০২০। একটি শুকুরকে বেছে নেয়া হয়েছিল এবং শুকুরটির হার্টের উপর বহুমাত্রিক জিনগত অভিযোজনের পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে প্রতিস্থাপনের। এই প্রকল্পে জড়িত আছেন একজন বাঙালী বিজ্ঞানী মহিউদ্দিন আহমদ। তাঁর আশাবাদী মন্তব্য হলো, এতে করে মানুষের বহু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্য প্রাণী থেকে প্রতিস্থাপন করা যাবে। অন্য প্রাণীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করার ব্যাপারটি হলো আমার একটা আঙ্গুল কেটে গেলে, এই কাটা আঙ্গুলের স্থলে বানরের একটি আঙ্গুল জোড়া দেয়া সম্ভব হলে সমস্যার যুৎসই চিকিৎসা সমাধান সম্ভব।

গত দু’ শতাব্দী ধরে পৃথিবীব্যাপী বহু অঘটনের জন্য আমেরিকা অবশ্যই দায়ী। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, জ্ঞান বিজ্ঞানে আমেরিকা যে অবদান রেখে চলেছে, বাকি বিশ্বের অবদান একসাথে করলেও আমেরিকার সমান হবে না। তেমনি এক বিষ্ময়কর প্রকল্প হলো, জেনেটিক্যালি রূপান্তরিত শুকুরের হৃদপিন্ড মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন। ৭ জানুয়ারী ২০২২ এই বিষ্ময়কর অপারেশনটি সম্পন্ন হয়েছে এবং বিজ্ঞানীদের অভিমত তাঁরা প্রাথমিকভাবে সফল। এখন দেখার পালা সংযোজিত এই হৃদপিন্ড কতদিন কাজ করে এবং এর ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো কি কি উঠে আসে। ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো সারিয়ে তোলা নিতান্তই গবেষনা ও প্রচেষ্টা সাপেক্ষ মাত্র।

আজ টেস্টটিউব বেবী পদ্ধতি পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয় হচ্ছে অতিদ্রুত। জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং চিকিৎসা বিজ্ঞানের সামপ্রতিকতম শাখা। দ্রুত এই শাখাটি বিকশিত হচ্ছে। এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের বহু সনাতনী চিন্তা ভাবনাই পাল্টে দিচ্ছে। কয়েক বছর আগেও যে সব রোগ বা শারীরিক জটিলতার সমাধান অসম্ভব মনে করা হচ্ছিল, আজ আর ওভাবে ভাবা হচ্ছে না। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন নিকট ভবিষ্যতে জেনেটিঙ ইঞ্জিনিয়ারিং বহু চিকিৎসা সমস্যার সমাধান এনে দেবে। এই আশাবাদ যদি সত্যি হয় তবে মানব সভ্যতা এগিয়ে যাবে কয়েক শতাব্দী। দশম শতাব্দীর মুসলিম বিজ্ঞানী আল হাইথাম বলেছিলেন, চোখ নিজ থেকে কোন কিছু দেখতে পায় না। এরিস্টটলের চোখ নিজ থেকে দেখতে পাওয়ার বক্তব্য খণ্ডন করে হাইথাম দেখিয়েছেন যে, বস্তুর আলো চোখে এসে পড়ে বলেই মানুষ বস্তটিকে দেখতে পায়। এই আবিস্কার দেড়হাজার বছরের ভুল ধারণা থেকে মানবজাতিকে উদ্ধার করে সঠিক পথে চালিত করে। মানব সভ্যতা এগিয়ে গেলো সহস্র সহস্র বছর। তেমনি জিনোগ্রাফটিং সভ্যতাকে এগিয়ে নেবে বহুদূর। জয় হোক জ্ঞানের, জয় হোক বিজ্ঞানের, জয় হোক মুক্ত মনের, জয় হোক মানব সভ্যতার।

লেখক : কলামিস্ট; আইনজীবী, হাইকোর্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধগ্রাম : আমাদের শেকড় আমাদের অস্তিত্ব
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল