কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে ওঠা হাজার বছরের প্রাচীন জনপদ বন্দরনগরী চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ও সমগ্র উপমহাদেশের আন্দোলন সংগ্রামের আদি পীঠস্থান। চট্টগ্রাম শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিই নয় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির অন্যতম সম্ভাব্য কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। চট্টগ্রামকে ঘিরে বাস্তবায়িত হচ্ছে ট্যানেল, বেসরকারি বে টার্মিনাল, অর্থনৈতিক অঞ্চল, গভীর সমুদ্র বন্দর। অবকাঠামো উন্নয়নে নেয়া হচ্ছে এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, বুলেট ট্রেনের মতো বিশাল বাজেটের প্রকল্প, চট্টগ্রাম– কক্সবাজার রেল লাইন ও মেরিন ড্রাইভ সড়ক। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রাগ্রসর শিল্প–কারখানা স্থাপন, ব্যবসা–বাণিজ্যের বিদ্যমান সম্ভাবনাময় খাতসমূহকে আরো পৃষ্ঠপোষকতা দান ও বৈচিত্র্যময় ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র পর্যটন শিল্পকে সুপরিকল্পিতভাবে উপস্থাপন করা গেলে এ শহর নান্দনিকতা ও আধুনিকতার মেলবন্ধনে এক অনিন্দ্য সুন্দর মোহময়ী স্মার্ট সিটিতে পরিণত হওয়া কোনরূপ অলীক কল্পনা হবার কথা নয়। এটা অনস্বীকার্য যে বর্তমান সরকার চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনুধাবন করে নানামুখী উন্নয়নের মাধ্যমে এই অঞ্চলকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা সম্বলিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তৎপর। পাশাপাশি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে নাগরিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বারটি বিদ্যমান সিটি কর্পোরেশন এর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন একটি ব্যতিক্রমী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যার রয়েছে পরিচ্ছন্নতা, আলোকায়ন, অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশাল অবদান। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রথম চেয়ারম্যান নুর আহমদ এর মাধ্যমে ১৯২১ সালে উপমহাদেশে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু হয়। চসিকের পরিচালনায় চট্টগ্রাম শহরে বর্তমানে শতাধিক স্কুল কলেজ ও ৩৫০টির অধিক মাদ্রাসা, টোল পরিচালিত হয় যাতে শিক্ষা গ্রহণ করে লক্ষাধিক ছাত্র ছাত্রী। চট্টগ্রাম শহরের শিক্ষার চাহিদা পূরণে চসিকের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহ রাখছে বৈপ্লবিক অবদান।একটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এতো অধিক পরিমাণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সারা বিশ্বে বিরল। চট্টগ্রামে যেহেতু পর্যাপ্ত সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই সেহেতু সিটি কর্পোরেশনের স্কুল কলেজগুলো সরকারকে হস্তান্তর করলে চসিক বিশাল ভর্তুকি থেকে রক্ষা পাবে। চসিকের স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে রয়েছে নার্সিং ইনস্টিটিউট, মাতৃসদন, জেনারেল হাসপাতাল ও একচল্লিশটি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র। চসিক স্বাস্থ্য বিভাগ দেশব্যাপী জাতীয় টিকাদান কার্যক্রমে সর্বদা শীর্ষ স্থান অর্জন করে। চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি লালন ও সংরক্ষণে চসিকের বছরব্যাপী থাকে বইমেলা, বৈশাখী মেলা, পিঠা উৎসব, জাতীয় দিবসের কুচকাওয়াজসহ দারিদ্র্য বিমোচনে নানা উদ্যোগ। চট্টগ্রামের পাহাড়ি প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে পানি নিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে সর্বদা বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়। বালিযুক্ত পাহাড় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে প্রতিনিয়ত খাল নালা–নর্দমা ভরাট হয়ে যাওয়ার দরুণ পরিচ্ছন্ন ও প্রকৌশল বিভাগের অতিরিক্ত জনবল প্রয়োজন হয়। এসব গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সেবা প্রদানে চসিকে প্রায় ২৫০০ জন স্থায়ী ও ৮০০০ জন অস্থায়ী কর্মী রয়েছে। এই বিশাল জনবলের জন্য প্রতি মাসে আনুমানিক ২৫ কোটি টাকার বেশি বেতন–ভাতাদি পরিশোধ করতে চসিকের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। বর্তমান সদাশয় মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী দায়িত্ব নেবার পর চসিকের অস্থায়ী কর্মীদের ন্যায্য আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দৈনিক ন্যূনতম বেতনের সরকারী প্রজ্ঞাপন অনুসরণপূর্বক বেতন বৃদ্ধি করে কর্মচারীদের মানবেতর জীবনযাপন থেকে কিছুটা রক্ষার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। চসিক যেহেতু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান সেহেতু উন্নয়ন প্রকল্প ব্যতীত সরকার থেকে থোক বরাদ্দ পাওয়া যায় না বিধায় প্রতিষ্ঠানটির যাবতীয় ব্যয় কর্পোরেশনের নিজস্ব তহবিল থেকে মিটাতে হয়। সিটি কর্পোরেশনের আয়ের মূল উৎস হচ্ছে রাজস্ব। প্রতি মাসে রাজস্ব বিভাগ কর্তৃক যা রাজস্ব আদায় করা হয় তাতে কোন ক্রমে কর্মচারীদের বেতন ভাতা দেয়া গেলেও উন্নয়ন কাজ পরিচালনা ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের আনুতোষিকের টাকা প্রদান প্রায় দুরূহ হয়ে পড়ে। অবসরে যাওয়া কর্মচারী ও বকেয়া বিল পাবার আশায় ঠিকাদাররা প্রতিনিয়ত হেড অফিসে ধর্না দিতে থাকে। অফিস থেকে ঈদে কোরবানে তাদের দু তিন লক্ষ টাকা করে বকেয়া প্রদান করা হয় যা প্রাপ্য টাকার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এটা নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী ও ভুক্তভোগী ঠিকাদারদের মাঝে বিরাজ করছে দারুণ উদ্বিগ্নতা ও হতাশা। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী বিভিন্ন খাতে ১১শ‘ কোটি টাকা চসিকের দেনা রয়েছে। এমতবস্থায় চসিকের রাজস্ব আদায় খাতভিত্তিক বৃদ্ধি করা অতীব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিটি কর্পোরেশন আইন অনুযায়ী চসিকের সেই সুযোগও রয়েছে। ২০০৯ সালের সিটি কর্পোরেশন সংক্রান্ত প্রণীত আইনের ৮২ ধারার আওতায় কর্পোরেশন সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে প্রবিধান দ্বারা ২৬ টি খাত থেকে কর, উপকর, রেইট, টোল ও ফিস আরোপ করতে পারবে। খাতগুলো হচ্ছে ১) ইমারত ও জমির বার্ষিক মূল্যের উপর কর ২)স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের উপর কর ৩,)ইমারত নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণের জন্য আবেদনের উপর কর ৪) নগরীতে ভোগ, ব্যবহার বা বিক্রয়ের জন্য পণ্য আমদানির উপর কর ৫) নগর হইতে পণ্য রপ্তানির উপর কর ৬)টোল জাতীয় কর ৭) পেশা বা বৃত্তির উপর কর ৮) জন্ম, বিবাহ,দত্তক গ্রহণ ও যিয়াফত বা ভোজের উপর কর ৯)বিজ্ঞাপনের উপর কর ১০) পশুর উপর কর ১১)সিনেমা ড্রামা ও নাট্য প্রদর্শনী এবং অন্যান্য আমোদ–প্রমোদ ও চিত্তবিনোদনের উপর কর ১২) মোটরগাড়ি ও নৌকা ব্যতীত অন্যান্য যানবাহন এর উপর কর ১৩) বাতি ও অগ্নি রেইট ১৪)ময়লা নিষ্কাশন রেইট ১৫)জনসেবামূলক কার্য সম্পাদনের জন্য রেইট ১৬)পানি কল ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য রেইট ১৭)সরকার কর্তৃক আরোপিত করের উপর উপকর ১৮)স্কুল ফিস ১৯)কর্পোরেশন কর্তৃক পরিচালিত কোন জনসেবামূলক কার্য হইতে প্রাপ্ত করের উপর ফিস ২০)মেলা, কৃষি প্রদর্শনী, শিল্প প্রদর্শনী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং অন্যান্য জনসমাবেশের উপর ফিস ২১) বাজারের উপর ফিস ২২)কর্পোরেশন কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্স অনুমোদন ও অনুমতির জন্য ফিস ২৩)কর্পোরেশন কর্তৃক কৃত কোন বিশেষ কাজের জন্য ফিস ২৪)পশু জবাই দেওয়ার জন্য ফিস ২৫)এই আইনের যেকোনো বিধানের অধীনে অনুমোদিত অন্য কোন ফিস ২৬)সরকার কর্তৃক আইন বলে আরোপিত অন্য কোন কর। উপরোক্ত খাতগুলোর প্রতিটি থেকে সিটি করপোরেশন রাজস্ব আয় করতে পারে। কার্যত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মাত্র গৃহকর, বাতি ও অগ্নি রেইট, ময়লা নিষ্কাশন রেইট, ব্যবসা পরিচালনার লাইসেন্স বাবদ কর ও ভূমি হস্তান্তর কর আদায় করে থাকে। সুতরাং কর্পোরেশনের বিদ্যমান আর্থিক সংকট নিরসনে অন্যান্য খাতওয়ারি রাজস্ব ধার্য করে রাজস্ব আয়ের পরিধি বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থ সংকট দূর করা সম্ভব। চট্টগ্রাম বন্দরের অত্যধিক ওভারলোডেট যান চলাচলের কারণে নগরীর সড়কসমূহের প্রতিনিয়ত সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ নিমিত্তে সার্ভিস চার্জ আকারেও অর্থ আদায় করা যায়, এ বিষয়টি বন্দর কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় নেওয়া উচিত। আয় বৃদ্ধির জন্য সফল মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ন্যায় যুতসই আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। বর্তমান মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর শুদ্ধাচার নীতি এবং ব্যয় সংকোচনমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে কর্পোরেশনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল ও ফলপ্রসূ হচ্ছে। কাউন্সিলর ও কর্মচারীদের সেবার মানোন্নয়নে পরিচালিত হচ্ছে দক্ষতাউন্নয়ন প্রশিক্ষণ। সরকারের লক্ষ্যানুযায়ী ডিজিট্যালাইজ করা হচ্ছে সেবা কার্যক্রমগুলো। তথাপি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চট্টগ্রামকে নান্দনিক ও উন্নত স্মার্ট নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নাগরিক সেবার মান আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
লেখক : শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী