দেশে জ্বালানি তেলের মজুদের সক্ষমতা বাড়িয়ে সরকার বছরে দশ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল মজুদের সক্ষমতা থাকলেও তা কাজে লাগানো হচ্ছে না। বর্তমানে দেশে কেবলমাত্র বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) নিজেদের ট্যাংকে জ্বালানি তেলের মজুদ রাখতে পারে। বিপিসির বর্তমান তেল মজুদের সক্ষমতা মাত্র ৪২ দিনের। অথচ সরকার চাইলে দেশে অন্তত ৮ মাসের জ্বালানি তেল মজুদ করতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্র চীন এক বছরের এবং ভারত ছয় মাসের জ্বালানি তেল মজুদ রাখতে পারে। একইভাবে আমেরিকা, কানাডা, জাপান, কোরিয়া, রাশিয়ায়ও রয়েছে বিপুল তেল মজুদের সক্ষমতা। বৈশ্বিক বাজারে দামের ওঠানামায় তারা হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ওঠানামা করে। এই ওঠানামায় বিভিন্ন দেশ শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য করে। কিন্তু পর্যাপ্ত মজুদের সুবিধা না থাকায় বাংলাদেশ এক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। একবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে এদেশে আর কমানোর সুযোগ থাকে না। অথচ বিশ্বের অনেক দেশে সকাল-সন্ধ্যা তেলের দাম বাড়ানো বা কমানো হয়। বৈশ্বিক বাজারে দর কমে গেলে তখন বিপুল পরিমাণ তেল কিনে মজুদ করতে পারলে বাড়তি দামের সময় সুরক্ষা পাওয়া যায়। আবার কম দামে কিনে চড়া দামে বিক্রি করেও আয় করা যায় কোটি কোটি টাকা। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ জ্বালানি তেলের মজুদ নিয়ে সুরক্ষিত থাকে। জানা গেছে, বাংলাদেশের সক্ষমতা ৪২ দিন থেকে বাড়ানোর জন্য বিকল্প নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও তা কার্যকর করা হয়নি। বিশেষ করে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অয়েল ট্যাংকার (জাহাজ) ভাড়া নেয়ার একটি আলোচনা হলেও তা হয়নি। এর বাইরে সরকারি-বেসরকারি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোরও ট্যাংকার রয়েছে, রয়েছে ট্যাংকও। এসব ট্যাংকার ও ট্যাংকে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন তেল মজুদের সক্ষমতা রয়েছে। দেশে ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল মজুদ করা গেলে তা দিয়ে অনায়াসে ৮ মাসের চাহিদা মোকাবেলা সম্ভব। অর্থাৎ বৈশ্বিক বাজারে দাম কমে গেলে বিপিসি ৮ মাসের প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল কিনে মজুদ রাখতে পারে।
সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে চীন ও আমেরিকা নিজেদের মজুদ থেকে বিপুল পরিমাণ তেল বাজারে ছেড়ে দেয়। এতে বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার পাশাপাশি দুই দেশ বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ গত বছর প্রায় ৫৮ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করে। এতে ব্যয় হয় প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। কম দামে তেল কেনার সুযোগ থাকলে বিপিসি বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করতে পারত। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপিসি ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়েছিল। এতে অভ্যন্তরীণ নানা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। জ্বালানি তেলের বাড়তি মূল্যে বিপিসি দাম বাড়ালেও বৈশ্বিক বাজারে তেলের দাম কমলে বিপিসি দাম কমাতে পারেনি।
বিপিসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, দেশে বেসরকারি খাতে এক লাখ টন ধারণক্ষমতার দুটি বড় ট্যাংকার রয়েছে। এর একটি ইউনাইটেড গ্রুপের এবং অপরটি ওমেরার। এছাড়া আনোয়ারায় ইউনাইটেড গ্রুপের ১০ ট্যাংকারে ধারণক্ষমতা এক লাখ টন।
সরকারি-বেসরকারি (তেলভিত্তিক রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও আইপিপি) মিলে মোট ৬৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিন মাসের প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল মজুদের সক্ষমতা রাখতে হয়। দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে ৩০ লাখ টনের মতো জ্বালানি তেল মজুদের সক্ষমতা রয়েছে। খরচ বেশি হওয়ার কারণে জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বছরের বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকছে। অধিকাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে আমদানিকৃত এলএনজি কিংবা দেশীয় গ্যাস দিয়ে। ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অয়েল ট্যাংক জ্বালানি তেল মজুদে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশে অন্তত ৮ মাসের জ্বালানি তেল মজুদ করা যায় বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যাংকগুলো ভাড়া নিয়ে মজুদ বাড়ানো গেলে বিপিসি বৈশ্বিক বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে জ্বালানি তেলের দাম কমাতে পারত। এতে শুধু বিপিসি নয়, দেশের কোটি কোটি মানুষও উপকৃত হতো বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।
বিপিসির শীর্ষ একজন কর্মকর্তা গতকাল আজাদীকে বলেন, জ্বালানি তেলের মজুদ বাড়াতে সরকারিভাবে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা চলছে। বিশেষ করে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ট্যাংকার ভাড়া নেয়ার বিষয়টি নিয়ে বেশ অগ্রসর হচ্ছে সরকার। তবে এক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও চিহ্নিত হয়েছে। সব দিক বিবেচনা করে দেশের জন্য কল্যাণকর পদক্ষেপই সরকার নেবে। বৈশ্বিক বাজার থেকে কম দামে জ্বালানি তেল কিনে মজুদ করতে পারলে বিপিসি কোটি কোটি টাকা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দেশের মানুষও উপকৃত হবে বলে জানান তিনি।