গৌরবের ৭৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে ছাত্রলীগ

মোঃ খোরশেদ আলম | মঙ্গলবার , ৪ জানুয়ারি, ২০২২ at ১০:৫৬ পূর্বাহ্ণ

আজ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের শিশির ভেজা এক সকালে শিক্ষা, শান্তি, প্রগতির পতাকা উড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংগঠনটির নাম দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ৪৭-এ দেশ বিভক্তির পর এ দেশে যত আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছিল প্রতিটি সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে এর নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নাম রাখা হয়। ’৭১ এর মহান সাধীনতা সংগ্রামে এই সংগঠনের ২৬ হাজার নেতা কর্মী প্রাণ দিয়েছিলেন। সেই সময় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতারা স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ছাত্রলীগের গৌরবময় অধ্যায় হল ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২এর এর শিক্ষা আন্দোলন’ ৬৪এর সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষা আন্দোলন’ ৬৬এর ৬দফা আন্দোলন’ ৬৯এর গণ অভ্যুত্থান’ ৭০এর নির্বাচন ’৭১এর মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম। স্বাধীনতা পরবর্তী ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের উপর নেমে আসে অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন। গত বছর ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী বেশ উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উত্তর, দক্ষিণ ও মহানগর ছাত্রলীগ দিবসটি পালন করেছিলেন। মেয়াদ উত্তীর্ণ ও বিভক্ত হয়ে পড়া নগর ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতারা এখন বিবাহিত। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ। পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার পর থেকে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ সাংগঠনিক কার্যক্রম বা জোরদার করেছে। গত বছর এলজিইডি হলে সাবেক ছাত্রলীগের নেতাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত প্রসংশিত হয়েছে। ২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর ইমরান আহমদ ইমুকে সভাপতি ও নুরুল আজিম রনিকে সাধারণ সম্পাদক করে মহানগর ছাত্রলীগ গঠিত হয়। এর মধ্যে ২০১৮ সালের এপ্রিলে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজম রনি পদত্যাগ করলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন জাকারিয়া দস্তগীর। ২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের তিন মাস পর ৫মে তানভীর হোসেন চৌধুরী অপুকে সভাপতি ও মোঃ রেজাউল করিমকে সাধারণ সম্পাদক করে আংশিক কমিটি গঠিত হয়। ২০১৭ সালের ১৪অক্টোবর এস.এম বোরহান উদ্দিনকে সভাপতি ও আবু তাহেরকে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের ৫১ সদস্যের আংশিক কমিটি গঠিত হয়। ২০২০ সালের ৩মার্চ ২৪৭ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালে ৩মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগের এক সমাবেশে বলেছিলেন দানবের সাথে লড়াইয়ে যেকোনো পরিস্থিতিকে মাথা পেতে বরণের জন্য ছাত্রলীগকে জাগ্রত থাকতে হবে। জীবন যৌবনের উত্তাল যুদ্ধ সংগঠনে এ দেশকে সোনার বাংলা বিনির্মাণে কর্মী গড়ার পাঠশালা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বিদ্যার সঙ্গে বিনয়, শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষা, কর্মের সঙ্গে কর্মোঠ জীবনের সঙ্গে দেশপ্রেম এবং মানবীয় গুণাবলীর সংমিশ্রণে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অতিক্রম করছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সময়ের প্রয়োজন মেটাতে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্মের প্রথম লগ্ন থেকে ভাষার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বাঙালি শায়ত্ব শাসন প্রতিষ্ঠা ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান সর্বোপরি স্বাধীনতা ও স্বাধীকার আন্দোলনে সাত দশকের সবচেয়ে সফল সাহসী সারথী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৭৭ সালের ১১আগষ্ট ১ম শহীদ হয়েছিলেন ৬৮-৬৯এর শহর ছাত্রলীগের সভাপতি মৌলভী সৈয়দ আহমদ, ১৯৮১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের এজিএস মেধাবী ছাত্রনেতা তবারক হোসেনকে চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাসে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসীরা চরমভাবে হত্যা করে। ১৯৮৮ সালের ২১আগষ্ট শহীদ হয়েছিলেন সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের জি.এস মো. কামাল উদ্দিন। ২০১৫ সালের ২৫ জুলাই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের কনভেনশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরেছিলেন শহীদ মৌলভী সৈয়দের দুঃসাহসী সংগ্রামের কথা। ১৯৭০এর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে রাউজান থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শেষে শহর অভিমুখে তৎকালীন সিটি কলেজের ভিপি হারুনুর রশিদকে পুলিশ গাড়ী ছাপা দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৯৮৯ সালের ৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফখরুদ্দিন মো. বাবর শহীদ হন কুখ্যাত রাজাকার সাকা চৌধুরীর সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে। এবং রাউজান কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি মুজিবুর রহমানকে রাউজান হলুদিয়া ইউনিয়নের আমির হাটে হত্যা করা হয়। এছাড়াও খুন হয়েছিল রাউজান ছাত্রলীগ নেতা এমদাদ, শফিউল আলম, টিটু, বিটু, রফিক, আসলাম ও রাউজান কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মো. ফারুক। ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসে শিবির হত্যা করে উত্তর জেলা ছাত্রলীগ নেতা শরীফ, শ্যামল, জাফর ও দিদারকে। ১৯৯৩ সালে নিহত হয় বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মো. মোরশেদ আলম। ১৯৮৯ সালের ৩০ এপ্রিল শহীদ হন সরকারি কমার্স কলেজ ছাত্রলীগ নেতা আবদুল কুদ্দুস। ১৯৮৮ সালের ২৮ এপ্রিল গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভা চট্টগ্রাম রেল স্টেশন শিবিরের সশস্ত্র হামলায় নিহত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রনেতা আমিনুল হক। ১৯৯০ এর এরশাদ পতন আন্দোলনে নিহত হন চট্টগ্রাম পলিটেকনিক কলেজ ছাত্রলীগ নেতা বিপুল সাহা, ১৯৯৬ সালে ৪ঠা মার্চ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন নগর ছাত্রলীগ নেতা মাহমুদ আলম। ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে ছাত্রলীগ কর্মী আবৃতিকা বকুলকে হত্যা করে শিবিরের সন্ত্রাসীরা। ১৯৯৮ সালের ৬মে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শাহ আমানত হলে অবস্থানরত বরিশাল থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার্থী ছাত্রলীগ কর্মী মো. আইয়ুবকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। একই বছর ১৮ মে বিশ্ববিদ্যালয় অবরোধ কর্মসূচীতে শিবির বালুচরা এলাকায় শহরগামী একটি শিক্ষক বাসে গুলি করে হত্যা করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের মেধাবী ছাত্রনেতা মুশফিকুল সালেহীনকে। ২০০১ সালে ২৯ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করেছিল ছাত্রলীগ নেতা আলী মর্তুজাকে। চট্টগ্রামের রাজনীতির মহলে এইট মার্ডারের ঘটনা কম-বেশী সকলে জানে। টিটিসিতে শিবিরের ক্যাডাররা আটজন ছাত্রলীগের নেতা কর্মীকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। ২০১৮ সালের নগরীর পাহাড়তলীতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-প্রচার সম্পাদক মহিউদ্দিন সোহেল। ২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর শহীদ হন নগর ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাস। ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ নগর ছাত্রলীগের নির্বাহী সদস্য প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএম (মার্কেটিং) শেষ বর্ষের ছাত্র নাঈম আহমদ সোহেল। ১৯৯৬ সালের ২৪ জানুয়ারী নিহত হন কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের মেধাবী ছাত্রনেতা আবদুল মুবিন।
১৯৯৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রাউজানের কমলার দিঘির পাড় এলাকায় নিহত হন ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা ইকবাল হোসেন ও জামিল হোসেন। ১৯৮৯ সালে শহীদ হন সিটি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা ফারুক মো. ছিদ্দিকী ও মো. ওয়াহিদ আলম। ছাত্রলীগ নেতাদের অনেক রক্ত ঝরেছে বীর প্রসবিনী চট্টগ্রামের মাটিতে। এখানে জন্ম হয়েছিল মাস্টার দা সূর্যসেন, মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, প্রীতিলতা ওয়াদাদ্দার, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম,এ, আজিজ। ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি করতে এই চট্টগ্রামে ’৬৮-’৬৯ এর শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক চট্টলবীর বীর মুক্তিযোদ্ধা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সিটি কর্পোরেশনে বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বর্তমান চট্টগ্রাম আট আসন বোয়ালখালী ও চান্দগাঁও আংশিক এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন আহমদ ’৭০ দশকে শহর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন ’৮০ দশকের ছাত্রনেতা নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দীন। ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারী চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশ নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন ’৭০ এর দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা এম. রেজাউল করিম চৌধুরী। বর্তমান জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মুফিজুর রহমান’ ৯০ দশকের ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। উত্তর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রলীগের অতীতের গৌরবগাথা ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে এ ধরনের নেতার আবির্ভাব হবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ইদানীংকালে দেখা যায় ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা রাজনীতির চেয়ে অপরাজনীতির সাথে নিজেকে বেশী জড়িয়ে ফেলেছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে নেতাকর্মীদেরকে সৃজনশীল রাজনীতির মেধা মননে আত্মনিয়োগ করতে হবে। ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালি জাতির গৌরবের ইতিহাস। দীর্ঘ ৭৪ বছরের গৌরবগাথা ইতিহাসকে সমুজ্জ্বল রাখতে হবে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : শ্রম বিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতাকে যেতে দাও
পরবর্তী নিবন্ধজেমস ওয়েব টেলিস্কোপ : প্রাণের খোঁজে মহাকাশে