করোনাকাল, আমরা ও আত্নজাকথা

নুজহাত নূর সাদিয়া | বৃহস্পতিবার , ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ

চোখের পাতাটা পুনরায় ভিজে উঠছে, সাদা স্বচ্ছ মুক্তো যেন আমার হাতের পাতায় থিরথির করে কাঁপছে। অথচ ক্লান্ত শ্রান্ত চোখ দু‘টি ঠায় আটকে আছে ল্যাপটপের পর্দায়। শরীর-মন জুড়ে এক অদ্ভুত শিহরণ, টানটান উত্তেজনা! একটি দু‘টি নয় পর পর ১৪টি পর্ব একদিনের মনের খোরাক! জয়তু নেটফ্লিঙ, জয়তু দিরিলিস এরতুগুল। সাধে কি আর পুরো দুনিয়ায় ঝড় তুলেছে এরদোগানের দেশের এই ঐতিহাসিক তুর্কি ড্রামা সিরিজ। এরতুগুলের গর্ভধারিণী মাদার হাইমে ওয়ালিদা (তুর্কি ভাষায় মা), ওয়ারিশা, হাতুন কিংবা সে অতি প্রিয় বাংলার মা ডাকটি যেন মাথার নিউরনে সময়ে সময়ে মিষ্টি সুরের ঢেউ তুলে যায় আর শরীরে নতুন প্রাণের আগমনের সে অসাধারণ সুখানুভূতির উঠানামা তো আছেই।
নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছুটা সময় আগেই হাসপাতালের বাতিগুলো একে একে নিভে গেল। আলো আঁধারের এক অদ্ভুত মায়াজাল ছড়িয়ে পড়েছে পুরো হাসপাতালে। নার্স, মিডওয়াইফ আর কর্তব্যরত চিকিৎসকদের হালকা পায়ের শব্দে নিথর সেবালয়টিতে প্রাণের স্পন্দন জাগে। ও আচ্ছা বলতে তো ভুলেই গেলাম, সুবিশাল হাসপাতালের সৃদৃশ্য প্রাঙ্গণের নিয়তি নির্ধারিত যে স্থানটি আমার জন্য পাকাপোক্ত ছিল তা সে ১৮০০ শতকে নির্মিত ‘কারমেন ওর্য়াড’ আর হাসপাতাল, শুধু দক্ষিণ লন্ডন নয় পুরো ইউরোপের অন্যতম সেরা হিসেবে বিবেচিত হয় এই ‘সেন্ট জর্জ হাসপাতালটি’। মেটারনিটি, ট্রমা আর ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত এ হাসপাতালটির আরেকটি আকষর্ণীয় দিক বিস্তৃত বাহারি বাগান। ঘুম আসছে না, চোখ বুজতেই কিছুটা পেছন ফিরে গেলাম, ২০২০ সাল ভয়াবহ আতংকের বছর। ভীষণ অনিশ্চয়তা, প্রিয়জনদের মৃত্যুর মিছিল, অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা আর কোভিড ১৯’র প্রতিষেধক তখনও বাংলার পথে-প্রান্তরে গলা ফাঁটানো ক্যানভাসারদের স্বপ্নে প্রাপ্ত ওষুধই বলা যেতে পারে। তবে, গুরুজনদের ভাষায় অদম্য ইচ্ছে, জীবনবাজি রেখে দিনরাত এক করে যদি কোনো কিছু চাওয়া হয় স্রষ্টা নাকি তা অপূর্ণ রাখেন না!
এক কুয়াশাঘেরা ভোর, কোভিড আক্রান্ত আম্মুর দুর্বল কণ্ঠটি ফোনের ওপাশটায় বেজে উঠল: আজ ভোরে একটি চমৎকার স্বপ্ন দেখলাম- কী সুন্দর, পরীর মত ফুটফুটে বাচ্চাটি। হাসলাম আমি, কাছের বেশ কয়েকজন শুভাকাঙ্খীরাও একটি সুন্দর ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিলেন। অপেক্ষার পালা শুরু হল, ভাগ্যিস সংক্রমণটি অল্প ছিল তাই বেশ তাড়াতাড়িই মা সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরলেন।
ব্রিটেন কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন আবিষ্কর্তা হিসেবে ইতিমধ্যে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে। বিদায়ী ২০২১ সাল লকডাউন, ফারলো স্কিম, রেস্তোরাগুলোতে শতকরা ৫০ ভাগ ডিসকাউন্টে খাওয়ার সুযোগ সহ অর্থমন্ত্রী ডিশি রিশির নব নব পরিকল্পনা- বিশ্বব্যপী নতুন ঝড় ‘অমিক্রন‘-র আঘাত সামলানোর নতুন ঘোষণা ব্রিটেনের রেস্তোরাগুলোকে পুনরায় ৬,০০,০০০ (ছয় লাখ) পাউন্ড আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে এবং সর্বশেষ বুস্টার টিকা। এরই মাঝে দর্শকশূন্য সিনেমা হলগুলোতে গুটিকয়েক দর্শকের উপস্থিতিতে পর্দা উঠানোর মত সরকারি হাসপাতাল গুলোর বারান্দায় শোভা পাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন প্রদত্ত সারি সারি এম্বুলেন্স, অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম, আর পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষানবিশ চিকিৎসক আর স্বেচ্ছাসেবক স্বাস্থ্যকর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পার্টটাইম আর ফুলটাইম সেবার মোড়কে জরুরি পরিস্থিতি সামাল দিতে তৈরি করা।
মাত্র ১টি বছর, অথচ ব্রিটেনের পরিবেশ পরিস্থিতির কি আমূল পরিবর্তন। আমি তো মনের সুখে, দায়িত্বরত এক সেবিকাকে বলেই ফেললাম; জো, নিজেকে আমার রাণিমাতা এলিজাবেথ মনে হচ্ছে! জো সহ অন্য সেবিকা রা তো হেসেই কুটিকুটি; নিশ্চিতভাবেই তুমি তাই ম্যাম। এ করোনাকালে আমরা প্রতিটি রোগীকে সর্ব্বোচ স্বাস্থ্য সেবা দিতে বদ্ধপরিকর।
অকৃপণভাবেই ধন্যবাদটুকু প্রাপ্য এন.এইচ.এস‘র (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস) অর্থাৎ ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থার।
কী সুসংগঠিতভাবেই না তারা এই ঘাতক ব্যাধিটিকে পরাস্ত করতে নিত্য নতুন পন্থা অবলম্বন করছে! পরিকল্পিত সাক্ষাৎকার, কৌতুহল আর সপ্তাহখানিক সেবালয়টিতে আবাস গাড়া সুযোগ হয়ে গেল জীবন ও মৃত্যুর সন্ধি স্থাপনের সে অভূতপূর্ব লড়াই দেখার। সময় যায় আর আমার সুপ্ত অনুসন্ধিৎসার পাল্লাটি ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের কী দারুণ অগ্রগতি-শরীরের উপর ছোট্ট একটি স্টিকার সেটে দেওয়া আর গালভারি নাম ট্রাকিওশান। না কোনা কাঁটাছেঁড়া না ভারি ভারি যন্ত্রের ঘড়ঘড় আওয়াজ, কী সূক্ষ্ণভাবেই না শরীরের ভেতরকার শিরা উপশিরা আর নাড়ির গতিবিধি জানান দিয়ে যাচ্ছিল এই ছোট্ট অথচ কার্যকর স্টিকারটি। মুগ্ধতার পাল্লাটি আরও বাড়ল যখন কর্তব্যরত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের টিমটি তাদের সময়ানুবর্তিতার প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করতে পারায় আন্তরিক ভাবে দু:খ প্রকাশ করলেন। কী অসাধারণ বিনয়, পেশার প্রতি কী নিখাদ দায়বদ্ধতা! ইশ!এক গোপন আফসোস মনের অজান্তে মুখ হতে বের হয়ে এল। বাংলাদেশ সহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যদি মেডিকেল সিস্টেমটিকে জাতীয়করণ করা যেত?
অন্যদিকে, কর্মব্যস্ত সময়গুলোকে সাময়িক ছুটি জানিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠাঁয় বসে থাকতেন জনাব অর্থাৎ কন্যার বাবা। অপেক্ষা আর ধৈর্য্যের সে যুগলবন্দী সময়টি ঘণ্টা পেরিয়ে দিন, দিন পেরিয়ে মাস আর সবশেষে বছরে পা রাখতে চলেছে। সময় আর পরিকল্পনার প্রতি আজীবন দায়বদ্ধ মানুষটি ঘরণীর সাময়িক অনুপস্থিতি আর অসুস্থতার ফলাফল স্বরূপ আর্বিভূত হলেন ত্রাণকর্তা হিসেবে। নতুন প্রাণের অস্তিত্ব, মুখের স্বাদের রকমফের কর্তার হাতের জিভে জল আনা নানা লোভনীয় রান্নার উপযুক্ত যোগান তো ছিলই। ডালের বাগাড়ের স্বাদ নেওয়া, ঘরে বানানো পিৎজা কিংবা মাছের মুড়িঘণ্ট দিন শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছি মিষ্টি ফলারের স্বাদ নিয়ে। কড়া ব্যবস্থাপকটির ভালোবাসা আর যত্নে ভরা তীক্ষ্ণ নজরদারিতে বৈচিত্র্য এসেছে নতুন মায়ের জীবনযাত্রায়। আর বাড়তি সংযোজন ছিল যত্নে গড়া বাগানটিতে, পুদিনা, শিম ফুলকপি, বাটারনাট স্কোয়াশ সহ (রের্কড সংখ্যক ১৭টি কুঁড়ি) নানা রঙ-বেরঙের ফুলের সমারোহে মনটাকে প্রফুল্লতায় ভরানো। আর মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মত সময়ে সময়ে দোরগোড়ায় কিছু অকৃত্রিম বন্ধু আর প্রতিবেশীর নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় ভরা ঝুলিগুলো উঁকি দিয়েছে।
কথায় বলে, অতিথির প্রকৃত সমাদর চাই নাহলে অতিথি শূন্যতায় গৃহ খাঁ খাঁ করবে। বাজার ঘুরে বাড়ি বয়ে আনা নতুন অতিথির গৃহসজ্জার সরঞ্জামগুলো অলসতা আর সময়াভাবে ঠিক গোছানো হচ্ছিল না। স্রষ্টা হয়তোবা সে কারণে আমাদের পরিকল্পনাটিতে জল ঢেলে দিয়ে তাঁর সৃষ্টিকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন সর্ম্পূণ প্রাকৃতিক উপায়ে।
পূর্ব নির্ধারিত সময়টি এক বিশেষ কারণে ১টি দিন পিছিয়ে গেল, মানসিক প্রস্তুতিতে কিছুটা হলেও ভাটা পড়ল। মনের কোণে অজান্তে একটু একটু করে ভয় দানা বাঁধছে আর কানের কাছে স্বজনদের আশ্বাস ভরা বুলি হৃদয়ের গভীরে সাহস আর আশার পুঞ্জীভূত আবেগটিকে ক্রমশঃ বড় করছে। কী অদ্ভুতভাবেই না ঘটনার মোড় ঘুরে গেল, নির্ধারিত অপারেশনের আলোয় ভরা কক্ষ নয় সমুদ্র গর্জন সম তীব্র তীক্ষ্ণ অনুভূতির মুখোমুখি আমি আমাদের প্রাণপ্রিয় কন্যাটির মুখ দেখতে পেলাম ঠিক সকাল ৬টা বেজে ২৮ মিনিটে। দিনটি ছিল শুক্রবার, আর অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসা এই নতুন মাটির স্থান নির্ধারিত হল সৌভাগ্যের ৭ নামাঙ্কিত লেবার রুমটিতে।
দিনগুলো এখন অনিশ্চয়তা, আনন্দ আর নিত্য নতুন অভিজ্ঞতায় ক্রমশঃ সমৃদ্ধ হচ্ছে। ‘অমিক্রন’ নামক সে নতুন আতঙ্কটির দ্রুতগতির বিস্তার, অন্যদিকে আত্নজার নানুভাই আর দাদুমণির উচ্ছ্বাস ভরা উক্তি, আমরা আমাদের নাতনীটির জন্য আরও কয়েক বছর বেঁচে থাকতে চাই।
মজার ব্যাপার, আনন্দ-বেদনাকে সাথী করে চলা এই ২০২১ সালটিতে স্বজন, সহকর্মী আর প্রতিবেশী সহ আমরা মোট ১২ জন সকলের ঘর আলো করে কখনো সপ্তাহ, কখনোবা মাসের ফারাক একে একে স্বাগত আমাদের ভালোবাসার আত্নজ ও আত্নজারা। মহামারীর এ ঘোর অমানিশা একদিন নিশ্চিতভাবেই পুরোপুরি কেটে যাবে। দুঃসময় জয় করা নতুন প্রজন্মের এ আলোর সারথিরা বর্তমান পৃথিবীকে সে সুন্দরের পানে এগিয়ে নিবে আসন্ন ২০২২ বছরটিতে এতটুকুই শুভকামনা- প্রজাপতির পাখনার তিরতিরে নাচন, শরীরের শিরা উপশিরার আজব সে কম্পন, কখনো ভালো লাগা কখনো মন্দ লাগা, মনের দ্বৈত সত্তার এক আশ্চর্য সন্ধি স্থাপন। দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী, ঘুম হারা সময়ের ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস, নিশ্চুপ আনন্দ আর অস্থিরতার এক যুগল সম্মিলন। কমলা রাঙ্গা রোদের স্বাগত ভাষণ, শুভ্র বেলি বকুলের সে স্নিগ্ধ সৌন্দর্য, নারী আমি হৃদয়ে মাতৃত্ব অনুভবের সেই চির নতুন গান-জয়তু জননীগণ।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানুষ চেনা দায়
পরবর্তী নিবন্ধনতুন বছরের উদ্বেগ উৎকন্ঠা-অমিক্রন