সংগীতের নানা শাখার মধ্যে গণসংগীত অন্যতম একটি ধারা। সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার সংগীতই হচ্ছে গণসংগীত। সাধারণ মানুষের দুঃখ ও সংগ্রাম যে সংগীতের উপজীব্য হয় সেই সংগীতকেই আমরা গণসংগীত বলি। গণসংগীত সঙ্গীতের একটি ধারা, যা মূলত রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক শোষণ, নির্যাতন, অত্যাচার অনাচারের বিরুদ্ধে গণমানুষকে উদ্দীপ্ত করার গান। গণসংগীত আমাদের অনেকেরই প্রিয় একটি চর্চার মাধ্যম। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ নানা বঞ্চনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণসংগীত আমাদের নানাভাবে উজ্জিবীত করেছে। ইতিহাসের নিরিখে বিচার করলে বাংলা গণসংগীতের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। লৌকিক জীবন নির্ভর প্রতিবাদী স্বদেশি গানের হাজার বছরের উত্তরাধিকারী আমাদের গণসংগীতের যাত্রা বিশ শতকের তিরিশের দশক থেকে। বাংলা গণসংগীত ও তার আন্দোলনের কথা আসলে প্রথমে যাঁর নাম আসে তিনি হলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। আমাদের গণসংগীতের বহুমাত্রিক উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য নিয়ে চমৎকার একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন গণসংগীত বিশারদ হেমাঙ্গ বিশ্বাস নিজেই, ‘স্বাদেশিকতার ধারা যেখানে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার মহাসাগরে গিয়ে মিলেছে, সেই মোহনায় গণ-সংগীতের জন্ম।’ বাংলা গণসংগীত আন্দোলন যাঁরা সংগঠিত করে জনতার সংগ্রামী প্রত্যয়কে কালজয়ী সুরের সংমিশ্রণে নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী, রমেশ শীল,সলিল চৌধুরী, বিষ্ণু দে, অরুণ মিত্র, খালেদ চৌধুরী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুধন্য দাশগুপ্ত, নিবারণ পণ্ডিত, কলিম শরাফী, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখ। এই গুণী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রমেশ শীল আমাদের চট্টগ্রামেরই সন্তান। তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভা আমদের চট্টগ্রামের সংগীতকে করেছে সমৃদ্ধ।
রমেশ শীলের গণসংগীত আমাদের শোষণ নিপীড়নের বিরুুদ্ধে আমাদের সাহস যুগিয়েছে সময়ে সময়ে। ঔপনিবেশিক ভারতে তিরিশ ও চল্লিশের দশকে শ্রমজীবী জনতার অর্থনৈতিক দাবিদাওয়াকে কেন্দ্র করে যে বিক্ষোভ দানা বেঁধেছিলো, সে সময় কমিউনিস্টদের উদ্যোগেও বহু লড়াই-সংগ্রাম-বিদ্রোহ গড়ে ওঠে। কমিউনিস্ট ও প্রগতিবাদী লেখক-শিল্পীরা সর্বহারা আন্তর্জাতিকতার চেতনায় সেদিন যে কর্তব্যনীতি অনুসরণ করেছিলেন, তা ছিল ফ্যাসিজমের দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতি কর্মীদের সংগঠিত করে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলা। তাঁদের প্রচেষ্টায় সেদিন গড়ে উঠেছিল সাড়াজাগানো ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ প্রগতি লেখক সংঘ ও গণনাট্য আন্দোলন। এই সংগঠনগুলো কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট হিসেবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে গণসংগীতের উৎসভূমি নির্মাণে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল।
তিরিশ ও চল্লিশের দশকে এই সংগঠনগুলো সংস্কৃতির সামাজিক চরিত্র নিরূপণে একটি দিকনির্দেশনা প্রদান করে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল; যার মূল বক্তব্য ছিল জীবনের জন্য শিল্প, শিল্পের জন্য জীবন নয়। এই ধারণা সেদিন জাতীয়তাবাদী চিন্তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে আরো উন্নত সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার ধ্যান-ধারণা গণসংগীতকে আন্দোলনের নতুন ধারা হিসেবে মানুষের কাছে নিয়ে যায় রাজনৈতিক সংগ্রামের অস্ত্র হিসেবে। সেই সংঘ শৌখিন সংস্কৃতিচর্চার পরিবর্তে মানুষের বিবেককে শাণিত করে যাবতীয় অনাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী হয়ে ওঠার প্রেরণা জাগায়। তিরিশ ও চল্লিশের ব্যতিক্রমী এই ধারার প্রভাব পড়েছিল দেশব্যাপী। কৃষক কণ্ঠে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল গণসংগীত। তিরিশ ও চল্লিশের গণসংগীত নতুন সম্ভাবনা সঞ্চারিত করে। কলকাতাকেন্দ্রিক সংগঠিত হলেও এর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছিল গোটা বাংলার গ্রামগঞ্জে ও মফস্বল শহরে। কলকাতার বাইরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট, নোয়াখালী, বরিশাল ছাড়াও আসাম প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় সাংস্কৃতিক স্কোয়াড গড়ে ওঠে। এ সময় ঢাকাসহ পূর্ব বাংলায় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন কবিয়াল রমেশ শীল, ফণী ভূষণ বড়ুয়া, মুনীর চৌধুরী, সত্যেন সেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, রণেশ দাশগুপ্ত, আবদুল লতিফ, সিকান্দার আবু জাফর, শেখ লুৎফর রহমান ও আলতাফ মাহমুদ প্রমুখ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও আমাদের ঐতিহ্যবাহী গণসংগীতের ধারাকে অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা বর্তমান ছিল। পাকিস্তান ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন- শোষণের অভিজ্ঞতা প্রায় অভিন্ন ধারায় পরিচালিত হওয়ায় পূর্ববাংলায় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগ্রামের বিভিন্ন লক্ষণ দানা বেঁধে উঠতে থাকে। পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ‘কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন।’
পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে এই সাংস্কৃতিক সম্মেলনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সম্মেলনে খ্যাতনামা দ্রোহী কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, গায়করা উপস্থিত হয়েছিলেন। আমাদের দেশের লোককবি, বাউল ও গণসংগীত শিল্পীদের মধ্যে রমেশ শীল, পরিমল দাশগুপ্ত, শাহ আবদুল করিমসহ উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদী শিল্পীদের সমাবেশ ঘটে। গণসংগীতের ইতিহাসে দেশে বিভিন্ন সময়ে কবিয়াল রমেশ শীলের প্রতিনিধিত্বে চট্টগ্রাম বারবার আলোকিত হয়েছে এবং সাথে সাথে কবিয়াল ফণী ভূষণ বড়ুয়ার অবদানও উল্লেখযোগ্য। এভাবে কবিয়াল ঘরানার বলয় থেকে বেরিয়ে এসে গণসংগীত ধীরে ধীরে জনমনে একটি আলাদা স্থান করে নেয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মঞ্চে গণসংগীত হয়ে ওঠে মানুষকে উজ্জীবিত করার এক সম্মোহনী শক্তির গান। এ পথ পরিক্রমায় চট্টগ্রামে গণষংগীত গেয়ে যাঁরা এ সংগীত শাখাকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁেদের মধ্যে হরিপ্রসন্ন পাল, নির্মল মিত্র, তেজেন সেন,মিহির নন্দী, প্রবাল চৌধুরী, বাণী চৌধুরী, অশোক সেনগুপ্ত (সেন্টু), রবিন দে, শ্যামল বিশ্বাস, মোঃ নাসির, কবিয়াল রাইগোপাল দাশ,.কলাণী চৌধুরী,শাহারিয়ার খালেদ, গোলাম কিবরিয়া, মৃণাল ভট্টাচার্য, কল্পনা লালা, শ্রেয়সী রায়, কাবেরী সেনগুপ্তা, সমর মোদক, শীলা দাশগুপ্ত ও বর্তমান উদীচীর শিল্পীরা। এ দেশে বহুল সমাদৃত কিছু গণসংগীতের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ওই লৌহকপাট’, ‘এই শিকল-পরা ছল মোদের এই শিকল-পরা ছল’ ‘মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যম মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল’,‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’, রজনীকান্ত সেনের ‘ মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা ও সলিল চৌধুরীর সুরে ‘অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’, এস, এম, আবু বকরের কথা ও রবিউল হুসেনের সুরে ‘রুখে দাও, রুখে দাও, রুখে দাও, রুখে দাও’, সিকান্দর আবু জাফরের কথায় ‘জনতার সংগ্রাম চলবে জনতার সংগ্রাম চলবেই’, পিন্টু ভট্টাচার্যে কথা ও সুরে ‘লাখো লাখো হাত খুলেছে আজিকে ভীরুতা খিল রাজপথে-পথে উত্তাল তাই জনমিছিল’,সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে ‘ক্লান্তি নামে গো, রাত্রি নামে গো বাইতে পারিনা যে তরণী আর কতদূর’, আবু বকর সিদ্দিকির কথায় ‘ব্যারিকেড বেয়নেট বেড়াজাল’, সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা ও ইমতিয়াজ আহ্মেদের সুরে ‘হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয় এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো’,‘সাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয় জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘আমি যে দেখেছি সেই দেশ- দেশ উজ্জ্বল সূর্য রঙিন।’
গোাবিন্দ হালদারের লেখা ও সমর দাসের সুরে ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল’, সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে ‘নওজোয়ান,নওজোয়ান, বিশ্বে জেগেছে নওজোয়ান’ মুকুন্দু দাসের ‘ভয় কি মরণে, রাখিতে সন্তানে মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে’, ‘বান এসেছে মরা গাঙে’, নাজিম মাহমুদের কথা ও সাধন সরকারের সুরে ‘বজ্র কঠিন শপথ আবার লহ সবাই’, ‘আমাদের নানা মত নানা দল’, ‘কমরেড, এই রাত আধিয়ার’, মকসুদ আলী খান সাঁই রচিত ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের শ্মশান করেছে কে’, মোহিনী চৌধুরীর লেখা ও কৃষ্ণ চন্দ্রে দের সুরে ‘ মুক্তির মন্দির সোপান তলে’, আবুল কাশেম সন্দীপ ও সুজেয় শ্যামের সুরে ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’ সলিল চৌধুরীর ‘হেই সামালো ধান হো’, এস, এম, আবু বকরের কথা ও রবিউল হুসেনের সুরে ‘ষোলই ডিসেম্বর তুমি গর্ব আমার, আমার অহঙ্কার সালাম তোমায়, তোমায় নমস্কার’ সলিল চৌধুরীর কথায় ‘তোমার বিচার করবে যারা’ কিংবা ‘তীরহারা এই ঢেউ-এর সাগর পাড়ি দিবো রে’, ‘দিন এসেছে এইবার কিষাণ তোমার ভয় কি আর শ্রমিক তোমার ভয় কি আর’এ গানগুলো এবং আরো অনেক গণসংগীতের কথা উল্লেখ করা যায় যেগুলো সময়ের প্রয়োজনে আমাদের চট্টগ্রামের গনসংগীত শিল্পীরা নিজেদের কণ্ঠ তুলে নিয়ে আমাদেরকে শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে উজ্জীবিত করেছেন। তাই গণসংগীত সবসময়ই সমকালীন অত্যাচার অনাচারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী হাতিয়ার।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ। প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক