হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৫:২৩ পূর্বাহ্ণ

একাত্তরের গণহত্যার সাক্ষী হয়ে ঢাকার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক ‘রমনা কালী মন্দির’ অনেক দিন পর আবারো ‘লাইমলাইটে’ এলো। বিশেষ করে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সমপ্রতি তার বাংলাদেশ সফরকালে পুনঃসংস্কার করা এই মন্দির পরিদর্শনে আসার পর। বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মোগল সাম্রাজ্যের সময়ে নির্মিত সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বীদের এই মন্দির। এই পবিত্র ধর্মীয় উপাসনালয় গুড়িয়ে দিয়েছিলো ঘৃণিত হানাদার পাকিস্তান সেনা বাহিনী, যখন তারা একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে তথাকথিত ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে বাঙালি নিধনে ঢাকার রাজপথে নেমেছিল। নির্বিচারে হত্যা করেছিল নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালিকে। ভীতি ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল গোটা দেশে। এর মধ্যে দিয়ে হানাদার পাক বাহিনী দমিয়ে দিতে চেয়েছিল বাঙালির আত্মচেতনাবোধ, স্বাধীনতার স্পৃহা। তারা মাকে ‘মা’ বলে ডাকার অধিকার হরণ করে নিতে চেয়েছিল বাঙালির। গুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল বাঙালির স্বাধীন চেতনাবোধকে। রাতের আঁধারে তারা আক্রমণ করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ ছাত্রাবাস। হত্যা করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের। গুড়িয়ে দিয়েছিল মন্দির, জ্বালিয়ে দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল এই ধর্মীয় উপাসনালয়টিও। পাক হানাদার বাহিনী ২৭ মার্চ হত্যা করেছিল রমনা কালী মন্দিরের পুরোহিত সহ মন্দিরকে ঘিরে বসবাসরত শতাধিক নিরীহ হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকজনকে। তাদের মধ্যে পুরুষ, নারী, শিশু কেউ বাদ পড়েনি। কিন্তু তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন আবার। ঘুরে মাথা উঁচু করে আবার দাঁড়িয়েছে এই ঐতিহাসিক রমনা কালী মন্দির। এই মন্দিরের আর একটি উল্লেখযোগ্য ও ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে মঞ্চ থেকে বাঙালির স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ডাক দিয়েছিলেন, ছবিতে দেখা যায় সেই মঞ্চের অনেক দূরে রমনা কালী মন্দিরের চূড়া। সে সময় মন্দিরের এই চূড়াটি ছিল ঢাকার অন্যতম উঁচু। মন্দিরের পাশেই মা আনন্দময়ী আশ্রম, সেখানে থাকতেন পূজারী, ভক্তকূল। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি গত ১৭ ডিসেম্বর ২০২১ পুনঃসংস্কার করা মন্দির উদ্বোধনকালে বলেন, ‘এই ঐতিহাসিক মন্দির ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের প্রতীক’। ভারত সরকার বর্তমান মন্দিরের সংস্কারের জন্যে সাত কোটি ভারতীয় রুপি অনুদান দিয়েছে বলে জানা যায়। স্বাধীনতার অনেক বছর পরও এই মন্দিরে কোন পূজা অর্চনা করা যায়নি। অনুমতি মেলেনি স্বাধীন বাংলাদেশেও। বেহাত হয়ে গেছে মন্দিরের বেশ কিছু অংশ। সেই কথাটিই সমপ্রতি দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে বললেন ওই দিনের হত্যাযজ্ঞের অন্যতম সাক্ষী বিকাশ রায়।
সপ্তাহ খানেক আগে কথা হচ্ছিল হল্যান্ডে দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় ধরে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিক বিকাশ রায়ের সাথে। পাক হানাদার বাহিনী যেদিন এই রমনা কালী মন্দির আক্রমণ করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তার অন্যতম প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন বিকাশ রায়। সাক্ষী ছিলেন মরণের মুখ থেকে বেঁচে যাওয়া তার মা কমলা রায়, বাবা পি কে রায় ও বোন। যেদিন পাক হানাদার বাহিনী রমনা কালীবাড়ি আক্রমণ করে তখন বিকাশ রায় তার বাবার সাথে লুকিয়ে ছিলেন মন্দিরের গুহায়। সে সময় তার মা ও বোন ছিল গুহার বাইরে। হানাদার বাহিনী মন্দির ও আশপাশের সবাইকে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করায়। তার মা ও বোনও ছিল সেই সারিতে। পুরুষদের আলাদা করা হয় এবং তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এই সময় মন্দিরের সেবাইত পরমানন্দ গিরি, তৎকালীন পুলিশ বিভাগে কর্মরত বিভূতি ও জয়ন্ত চক্রবর্তী সহ অনেককে জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে মরতে দেখেন সে সময়ের কিশোর বিকাশ রায়। সেদিনের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে লক্ষ্য করি রায় বাবু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। সেটিই স্বাভাবিক। পঞ্চাশ বছর আগে যে ঘটনা মনের মধ্যে যেভাবে দাগ কেটেছে তা তো এই জীবনে যাবার নয়। তিনি হতাশ সুরে বলেন, ‘এই স্থানে আমাদের অনেকদিন পূজা-অর্চনা করতে দেয়া হয়নি। তিনি জানান, ‘দেশ স্বাধীন হবার তার মা-বাবা এবং আরো কেউ কেউ রমনা কালী মন্দিরের জায়গায় অবস্থান করতে থাকেন এবং কাঁটা তাদের বেড়া দিয়ে মন্দির ও আশ্রম চিহ্নিত করে রাখেন। দেশ স্বাধীন হবার পর ভারত থেকে অনেকেই ফিরে এসে তাদের পুড়ে যাওয়া ভিটে-মাটিতে বসবাস করতে শুরু করেন। কিন্তু এক পর্যায়ে সেখান থেকে তৎকালীন সরকারের পূর্ত মন্ত্রণালয় তাদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে পোস্তগোলার বালুর মাঠে নিয়ে যায়। প্রায় দশ বছর পর ১৯৮২ সালে রমনা কালী মন্দিরে পূজা করার অনুমতি চেয়ে তৎকালীন উপ-আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক বরাবর আবেদন করলে সে সময়কার সামরিক কর্তৃপক্ষ পাঁচ দিনের জন্যে পূজা করার অনুমতি দেন। এই অনুমতি পাবার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেন বিকাশ রায়। রমনা কালী মন্দির পুনরুদ্ধার করার জন্যে যে কমিটি করা হয় তার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বিকাশ রায়। তবে সে কারণে তাকে অনেক নাজেহাল হতে হয়েছিল এবং বিপদের মুখে পড়তে হয়েছিল বলে রায় বাবু জানান। তিনি বলেন, ঘটনাটি ঘটে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের আমলে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তাদের পিছু লাগে এবং হুলিয়াও জারি করে। বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বিকাশ রায় বলেন, ‘সে সময় তিনি যদি আমাদের রক্ষা না করতেন তাহলে আমাদের কী হতো জানি না। তার হস্তক্ষেপে আমাদের উপর জারি করা হুলিয়া তুলে নেয়া হয় এবং আমরা স্বাভাবিক চলাচল করতে শুরু করি।’
পরবর্তী সময়ে গঠিত হয়েছিল রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ গণতদন্ত কমিশন। বিচারপতি কে এম সোবহানকে চেয়ারম্যান করে মোট ৬-সদস্য বিশিষ্ট কমিশনের বাকি সদস্যরা হলেন, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, সাংবাদিক ও লেখক শাহরিয়ার কবির, সাংবাদিক বাসুদেব ধর, দ্বীপেন চট্টোপাধ্যায় ও চন্দ্রনাথ পোদ্দার। রায় বাবু আমাকে ২০০০ সালে কমিশন-প্রকাশিত রিপোর্টটি ধরিয়ে দিয়ে বলেন, এই কমিশনের সামনে উপস্থিত হয়ে হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসাবে আমি ও আমার মা সাক্ষ্য দিয়েছিলাম।’ রিপোর্টে যা উল্লেখ করা হয় তার অংশ বিশেষ এখানে পাঠকের জন্যে তুলে ধরলাম। “পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সহযোগীদের নিয়ে ২৭ মার্চ রাত দুটোর দিকে সান্ধ্য আইন (কারফিউ) চলাকালীন রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ঘেরাও করে। সেনাবাহিনীর সার্চ লাইটের আলোয় গোটা রমনা এলাকা আলোকিত হয়ে যায়। এরই মধ্যে শুরু হয় গোলাবর্ষণ। রমনা কালী মন্দিরে ঢুকে পাকিস্তানিরা মূর্তির দিকে এক ধরনের বিস্ফোরক ছুঁড়ে দেয়। অবশ্য কারো মতে গোলাবর্ষণ করা হয়। ফলে মূর্তি সহ মন্দিরের পেছনের অংশ উড়ে যায়। পরে মন্দির ও আশ্রম ধ্বংস করা হয়। মন্দির ও আশ্রম এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাতকরা ঢোকার সময় অনেকে ঘুমিয়ে ছিলেন, কেউ কেউ উৎকণ্ঠায় জেগে ছিলেন। এ সময় আচমকা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হানা দিলে প্রাণভয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায়। আতংকিত সবাই ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে শুরু করেন। মেয়েরা শাঁখা খুলে ফেলেন, সিন্দুর মুছে ফেলেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা পুরুষদের এক লাইনে ও মহিলা শিশুদের অন্য লাইনে দাঁড় করায়। তারা মন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরিকে ‘কলেমা’ পড়তে বাধ্য করে এবং তারপরই পেট বেয়োনেট দিয়ে ফেঁড়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। ওই মুহূর্তে ৮৫-১০০ জনকে হত্যা করা হয়। সাক্ষ্যে কয়েকজন মহিলা ও শিশু পুড়ে মারা যাবার কথা উল্লেখ্য করা হয়। পাক সেনারা দুই যুবককে ‘জয়বাংলা’ বলতে বাধ্য করে এবং মুখের ভেতর গুলি করে তাদের হত্যা করে। ভোর চারটার দিকে লাইনে দাঁড় করানো মহিলাদের থেকে পাক হানাদার বর্বর সেনারা কয়েক যুবতী মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়, যাদের আর কখনো ফিরে পাওয়া যায়নি বলে সাক্ষীদের কয়েকজন জানান। পাক সেনাবাহিনী স্থান ত্যাগ করার সময় নির্দেশ দেয়, যাদের বাঁচিয়ে রাখা হলো তারা যেন পরদিনই ভারতে চলে যায়।”
তদন্ত কমিশনের দীর্ঘ রিপোর্টে পাক সেনাদের যে সমস্ত অমানবিক ও জঘন্য কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা স্রেফ গণহত্যা। এমন হত্যাযজ্ঞ হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। হিন্দু, বৌদ্ধ, ক্রিস্টান, মুসলমান কেউ বাদ পড়েনি। ত্রিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছে পাক হানাদার বাহিনী। নয় মাসে দুই লক্ষাধিক নারী ও মেয়ের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছে ওরা। প্রাণভয়ে এক কোটির বেশি বাঙালি দেশ ত্যাগ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এতো কম সময়ে এত লোকের প্রাণহানী, এত নারকীয় অত্যাচার ইতিহাসে আর ঘটেনি। অথচ এই গণহত্যার কোন বিচার আজও হয়নি। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার যে ১৯৫ পাক সেনা সদস্য এই হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী তাদের বিচার দাবি করেছিল। পাকিস্তান দুঃখ প্রকাশ করুক, ক্ষমা চাক সরকারিভাবে তেমনটি দাবি করেছিল। কোনটিই এখনো হয়নি। পরে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট গঠন করে পাক বাহিনীর স্থানীয় দোসরদের কারো কারো বিচার করে এবং শাস্তি দেয়। কিন্তু এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে অনেকেই। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেকেই বহাল তবিয়তে আছে হিন্দুদের, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি জোরদখল করে। তাদের পাকড়াও করে, তাদের শাস্তি দেয় সে শক্তি কার! বিকাশ রায় দুঃখ করে বলেন, তিনি তার গ্রামের ভিটা ছেড়ে দিয়েছেন। স্থানীয় এক প্রভাবশালী বেদখল করে আছে। আইন-আদালত করে কেবল অর্থ যাবে, হয়তো প্রাণও। তার চাইতে ভালো ছেড়ে দাও। মনের দুঃখে, হতাশ হয়ে সব ছেড়ে দিয়েছি বলে, জানালেন তিনি। শুনে কষ্ট হয়। পরদেশে নয়, নিজ দেশে, নিজের বাপ-দাদার ভিটা সেটি ছাড়তে হলো, না, পাকিস্তানের সময় নয়, স্বাধীন বাংলাদেশে। যে স্বাধীন দেশে সকল সমপ্রদায়ের সমান অধিকার থাকার কথা ছিল। আমরা কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? বিকাশ রায়ের মত অনেকের প্রশ্ন আজ। মেলেনি উত্তর। কে দেবে উত্তর?
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধনীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : আধুনিক বাংলা কবিদের অন্যতম
পরবর্তী নিবন্ধঅর্থব্যবস্থা ও অভিশপ্ত পাচার অপসংস্কৃতি