‘স্লিপ এপনিয়া সিনড্রোম’ একটি ভয়ঙ্কর ব্যাধি

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | সোমবার , ২০ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৪২ পূর্বাহ্ণ

স্লিপ এপনিয়া সিনড্রোম (sleep apnoea syndrome) একটি ভয়ঙ্কর রোগ-যা ভুক্তভোগীদের জীবন দূর্বিষহ করে তোলে। এটি এখন বৈশ্বিক সমস্যা। পৃথিবীর উন্নত দেশ সমূহের অধিবাসীদের মধ্যে এ রোগটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়। এ রোগটি এতই ভয়ানক যে, রাত-বিরাতে ভুক্তভোগীদেরকে জিহ্বা মুখগহ্বরের পেছনে চলে যাওয়ার কারণে শ্বাসকষ্টের মধ্যে পড়তে হয়। এটি নিয়ে কৌতুহল আমার অনেকদিনের। আমি নিজেও স্লিপ সার্জারী করেছি কয়েকটি। ইউপিপি-ইউভুলু প্যালাটো ফেরিঙ্গোপ্লাস্টি (uvulopalatopharyngoplast)- যাতে টনসিল, উভয় পিলার, ইউভুলা কেটে ফেলা হয়। চার-পাঁচটা অপারেশনের মধ্যে সবাই সুস্থ আছেন, ভালো আছেন। কেউ কোন অভিযোগ করেননি। কিন্তু দিন আরও অনেক এগিয়েছে। নতুন নতুন পদ্ধতিতে স্লিপ সার্জারী করেন আধুনিক স্লিপ সার্জারী বিশেষজ্ঞগণ। বাংলাদেশের ঢাকায় বেশ স্লিপ সার্জারী হয়। অবসট্রাকটিভ স্লিপ এপনিয়া(obstructive sleep apnoea) যেটার জন্য এত হ্‌ইচই, ঘুমের সময় শ্বাসনালীর উর্ধ্বাংশ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া, সেটা সম্পূর্ণ/আংশিক/সাময়িক হতে পারে- যার ফলে দিনের বেলায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ঘুমে আচ্ছন্ন থাকেন। যেহেতু রাতের বেলা প্রচন্ড নাক ডাকার কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম হয় না, তখন মেজাজ খিটখিটে হওয়ায় স্বাভাবিক আচরণে প্রভাব পড়ে। শ্বাসযন্ত্র কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণঃ অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া আর হৃদযন্ত্রের কর্মক্ষমতা অকার্যকর হওয়া। এটি স্লিপ ল্যাবরেটরীতে নির্ণয় করা হয়। অস্থায়ীভাবে শ্বাসনালী থেমে যাওয়ার কারণে যে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে তা পুরুষদের মাঝে ২৪% ও মহিলাদের মাঝে ৯% দেখা দেয়-যা স্লিপ ল্যাবরেটরীতে নির্ণয় করা হয়। অনেক সময় বয়স্ক ও স্থূলকায় লোকদের ক্ষেত্রে অনুপাতটা বেড়ে যায়। ঘুমে নাক ডাকা রোগীদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশী ঝুঁকির মধ্যে থাকেন তারা হলেন বয়স্ক, পুরুষ, গর্ভবতী মহিলা ও মাসিক ঋতুস্রাব পরবর্তীকাল। যাদের স্বাস্থ্য মোটা, অতিরিক্ত মেদযুক্ত শরীর, মোটা ঘাড় ও অন্যান্য এনাটমিক্যাল অসামঞ্জস্যতা (মুখ ও মুখগহ্বরের ঊর্ধ্বশ্বাসনালী)। অন্যান্য কারণেও (OSA) দেখা দিতে পারে। যেমনঃ বংশগত, ধূমপান, মদ্যপান, রক্তে থাইরয়েড হরমোন এর ব্যতিক্রম উপস্থিতি, খর্বকায় শরীর, মহিলাদের ডিম্বাণু সংক্রান্ত জটিলতা, প্রতিবন্ধিতা এবং কিছু মেডিসিন (বেঞ্জোডায়াজেপিন, মাসেল রিলাক্সেন্ট, টেস্টোস্টেরন)। রোগীদের শরীরে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা অন্যান্যদের থেকে দুই/তিন গুণ বেশী। যারা হার্ট ফেইলিয়ুরের রোগী তাদের (OSA) হওয়ার সম্ভাবনা ৪০%-৭০%। যারা (OSA)-তে ভোগে তাদের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার আশংকা বেশী থাকে। (OSA)-তে যেহেতু অক্সিজেন শূন্যতা ও কার্বন ডাই অক্সাইডের আধিক্য দেখা যায় বারবার, ফলে ফুসফুসের উপর চাপ বাড়ে, পালমোনারী হাইপারটেনশান (pulmonary hypertension) ডেভেলাপ হয়। (OSA) -তে রাতের বেলায় যেসব উপসর্গ দেখা দেয় তা হলোঃ অনেক বড় করে ঘুমে নাক ডাকা, যা পাশের জনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। অনেক সময় নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে সংশ্লিষ্ট জন ঘুম থেকে উঠে পড়ে। দিনের বেলার উপসর্গগুলোর মধ্যে হচ্ছে-সারাবেলা মাথাব্যথা, গলাব্যথা, দিনের বেলায় অতিরিক্ত ঘুমের প্রয়াস, বিশেষ করে পড়ালেখা আর টিভি দেখার সময়। বিভিন্ন কাজকর্ম, যেমন: স্কুলে যাওয়া, স্বাভাবিক কাজকর্ম করা, ড্রাইভিং এর সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া। অতি মাত্রায় ক্লান্ত হয়ে যাওয়া, স্মৃতিভ্রম, বুদ্ধিমত্তা লোপ পাওয়া, যৌনশক্তি হারানো, পেটের পীড়া, উচ্চ রক্তচাপ ও হতাশাও দেখা দেয় (OSA) রোগীদের। যারা অতিরিক্ত মোটা, হার্টফেইলিউর, Type-2 diabetes, stroke, pulmonary HTN, ট্রাক ড্রাইভার-তাদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের গ্রুপে ফেলা হয়। রোগীদের ফিজিক্যাল বীধসরহধঃরড়হ করতে গিয়ে যা আমাদের সর্বাগ্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, তা হল স্থূলকায় শরীর। উপরিস্থ শ্বাসনালী বন্ধ হওয়ার উপসর্গসমূহ: ঘাড়ের আকার বৃদ্ধি পাওয়া (১৭চ পুরুষ, ১৬চ মহিলা), টনসিলের পাশে ফুলে যাওয়া, জিহ্বার আয়তন বৃদ্ধি পাওয়া, টনসিলের আকার বৃদ্ধি পাওয়া, লম্বা/বড় ইউভুলা, নাকের গুটি বড় হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। স্লিপ এপনিয়ার মাত্রা বেড়ে যাওয়া নির্ণয় করতে গিয়ে যে দুটি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা হল পলিসমনোগ্রাফী এবং পোর্ট্যাবল মনিটর। পলিসমনোগ্রাফী-শুধুমাত্র Sleep related breathing (Standard) এর জন্য করা হয়, পোর্ট্যাবল মনিটরের সাহায্যে moderate to severe OSA diagnosis করা হয়। যাদের CCF, neuromuscular disease, pulmonary disease আছে তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। PSG or PM-নিয়মিতভাবে OSA এর উপস্থিতি নির্ণয় করা হয় অথবা নাক ডাকা রোধকল্পে নির্দিষ্ট সার্জারীর জন্যও করা হয়। সার্জারী পরবর্তী কালেও PSG or PM-করা হয়। এছাড়াও স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাসের পথে সুনির্দ্দিষ্ট প্রতিবন্ধকতার দিকও নির্ণয় করা হয়। অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষা সমূহের মধ্যে রয়েছে: ড্রাগ ইনডিউচ্‌ড স্লিপ এন্ডোস্কপি। DISE Protocol-এর পূর্ব প্রস্তুতিসমূহ হলো: অপারেশন থিয়েটার, এন্ডোস্কপি স্যুট, সাকার মেশিনের সুবিধা, অভিজ্ঞ অ্যানস্‌থেসিস্ট, যিনি difficult intubation করতে পারদর্শী, জরুরী Tracheostomy, কার্ডিওরেসপিরেটরী মনিটরিং, ফ্লেক্সিবল এন্ডোস্কোপ, রেকর্ডিং সিস্টেম, স্লিপ গজও-যেটার সাহায্যে স্বাভাবিক ঘুমের সময় উপরিস্থ শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঠিক দিকটা নিরুপণ করা হয়।
চিকিৎসা পদ্ধতি: সংশ্লিষ্ট রোগীদের নিয়মিত ব্যায়াম, ওজন কমানোর পরামর্শ প্রদান করা।
সার্জারী পূর্ববর্তী পরীক্ষাসমূহ: কোয়াগুলেশন প্রোফাইল (coagulation profile), ব্লাড গ্রুপিং ও টাইপিং, থাইরয়েড ফাংশন টেষ্ট, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, পালমোনারী ফাংশন টেষ্ট।
সার্জিক্যাল চিকিৎসা: যে সমস্ত রোগী Positive airway pressure (PAP) সহ্য করতে পারেন না বা তা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয় বা যারা PAP থেরাপী refuse করেন তাদের ক্ষেত্রে সার্জিক্যাল চিকিৎসা দরকার।
ক) নাকের সার্জারী: যাদের নাকের হাড় বাঁকা থাকে, নাকের গুটি বড় থাকে, নাকের পিছনে এডিনয়েড নামক গ্রন্থি বড় হয়ে যাওয়া বা নাকের পলিপ থাকে অথবা নাকের টিউমার থাকে তা সর্বাগ্রে নিরাময় করা হয় নাকের সার্জারীর মাধ্যমে, যাতে মানুষের পরিমাণমত ঘুম হয়।
খ) Soft palate-এর উপর সার্জারী: বিভিন্ন ধরনের সার্জারী করা হয়, যেমন: Zeta palatoplasty, expansion sphincter palatoplasty, lateral pharingoplasty.
গ) জিহ্বার পেছনের অংশের উপর সার্জারী: এ সার্জারীতে আবেদনবিদ থাকতে হবে অত্যন্ত অভিজ্ঞ, যিনি difficult intubation-এ পারদর্শী। Equipment: Intubation এর সুবিধা থাকা, laryngeal mask airway, emergency tracheostomy(গলায় ছোট একটা ছিদ্র করে শ্বাসনালীকে বাইপাস করা)। জিহ্বার মধ্যখানে কেটে ফেলা, Coblation method এর মাধ্যমে জিহ্বার পেছনের অংশ, লিংগুয়াল টনসিল ফেলে দেয়া।
Transoral robotic surgery: এ সার্জারী অভিজ্ঞ Sleep apnoea surgeon-গণ ই করে থাকেন।
ঘ) Multilevel Surgery: নাক, palate, base of the tongue এবং epiglottis-এ সার্জারী Single stage অথবা Staged procedure-দু’ভাবেই করা হয়- তা নির্ভর করে সম্পূর্ণ সার্জন এর অভিজ্ঞতার ওপর এবং আইসিইউ সুবিধা সম্বলিত হসপিটাল থাকা চাই। Single stage-এ নাকে প্যাক না দেয়াই উত্তম। অন্যদিকে Staged multilevel surgery-তে nasal and nasopharyngeal surgery করা হয়। সাথে orophryngeal and endoluminal hypopharyngeal surgery ও করা হয়ে থাকে, তবে এক্ষেত্রে কয়েক সপ্তাহ interval দিয়ে করা উত্তম। Palatal surgery-major nasal surgery এর সাথে করা হয় যেখানে nasal packing করা হয় যদি Tongue base বেশী বড় না হয়।
যদি DISE/Sleep MRI করার সময় দেখা যায় Tongue base Uv partial/ complete collapsed তখন উক্ত combination surgery করা হয় না। সার্জারী ২৪ ঘন্টা পর ন্যাসাল প্যাক remove করা হয় অথবা tube withdraw করা হয়। এ সার্জারী যেহেতু বিপদজনক সেহেতু নিম্নোক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় ; যদি টেবিলেই tube withdraw করতে হয় তবে patient সম্পূর্ণভাবে conscious থাকতে হবে, তার রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে কিনা তা ensure করতে হবে। nasopharyngeal airway- সম্পূর্ণ রক্তবিহীন আছে কি-না তা ensure করা। ঘুমের ঔষধ না দেওয়াই উত্তম। পুনরায় টিউব দেয়া বা tracheostomy সুবিধা থাকা চাই। Auto APAP/ADU/Post operative ward/ non invasive ventilation এর সুবিধা থাকা চাই।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
জেনারেল হাসপাতাল, রাঙামাটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমালোচনা নয়, প্রয়োজন সহযোগিতার
পরবর্তী নিবন্ধসাঙ্গু নদীর কপার মহাশোল