মূকাভিনয় হল বলা আর না বলা কথার যুগলবন্দি আর স্বতঃস্ফূর্ত দৃশ্য চিত্র কাব্যের রসাস্বাদন। প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট বাংলাদেশের মূকাভিনয়ের প্রতিচ্ছবি এবং প্রতিবাদী সংস্কৃতি চর্চার একটি বলিষ্ঠ নাম। বাংলা ১৪০২ সনের ১ বৈশাখ (১৪ এপ্রিল, ১৯৯৫) চট্টগ্রামের ডিসি হিলের পাদদেশে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে মূকাভিনয় প্রদর্শনীর মাধ্যমে সংগঠনটির মঞ্চাভিষেক হয় এবং এদিনটিকেই প্যান্টোমাইম মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাকাল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার অগ্রপথিক ছিলেন দেবাংশু হোর, মইনুল শাওন, শাখাওয়াত টিপু, আবু নঈম মাহতাব মোর্শেদ, গোলাম হায়দার কিসলু, সিরাজুল ইসলাম সিল্টন প্রমুখ। আর নেপথ্যে প্রেরণা যুগিয়েছেন প্রয়াত নাট্যজন মাহবুব হাসান, নাট্যকার প্রদীপ দেওয়ানজী, চলচ্চিত্র পরিচালক শৈবাল চৌধুরী, প্রয়াত চলচ্চিত্রকার সাজ্জাদ হোসেন উপল, বিনয় ধর, স্বাগত ধর প্রমুখ। তাদের যোগ্য উত্তরাধিকার হয়ে রিজোয়ান রাজন, সোলেমান মেহেদী, গোলাম মোস্তফা হিরো, রাজ ঘোষ, শান্তনু দাশ, সাঈদ হিরো, হান্নান সাগর, বদরুল হুদা মামুন, শিল্পী দাশগুপ্তা, রওশন আক্তার, বার্নাডেট শুভ্রা, আবু তালেব সাকিব, আদনান মাহমুদ, রাগিব আহমেদ, ইমতিয়াজ বর্ষণ, ইরফান সাজ্জাদ, সাজিদ হাসান রনি, সাকিরুল হক মারুফ, রাশেদ মাসুম, আসবাবীর রাফসান, মাইম হাসান, শহিদুল মুরাদ, জোবায়েদ রানা, রাইদাদ অর্ণব, মেজবাহ চৌধুরী,
প্রকৃতি সাহা, সাজেদা সাজু, ইশরাত শিপা প্রমুখ দলটিকে দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করে তুলেছেন। যখনই প্রয়োজন পড়েছে, প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট রাজপথের সৈনিক হয়ে উঠেছে। পুলিশি নির্যাতনে ইয়াসমিন ও সীমা হত্যা, হাজতে ডেন্টাল ছাত্র রুবেলের নির্মম মৃত্যু, যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলা, ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন হামলা, আইলা বিধ্বস্ত জনপদের কথা… ইত্যাদি নানা সময়ে উঠে এসেছে প্যান্টোমাইমের পরিবেশনায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাষ্কর্যের উদ্বোধনে, শেরাটন হোটেলে কম্পিউটার সফটওয়্যার উইন্ডোজ ভিসটার আনুষ্ঠানিক যাত্রায়, ঢাকার রেডিসন ব্লু-তে শুধুমাত্র কূটনৈতিক ও বিদেশি অতিথিদের উপস্থিতিতে পানি বন্দী মানুষের জীবন নিয়ে মূকাভিনয় পরিবেশনা প্যান্টোমাইম মুভমেন্টকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে শুধু নয়; মূকাভিনয়কে নানা মাত্রায় নিরীক্ষা করার সাহস যুগিয়েছে। ফলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল হয়ে শেকড় সন্ধানী নাট্যকার সেলিম আল দীনের সাহিত্যও প্যান্টোমাইম মুভমেন্টের মূকাভিনয় হয়ে উঠেছে।
গত ২৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন চর্চায় প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট একটি প্রাচ্য দেশীয় অথচ শাশ্বত রূপ বিনির্মাণ করেছে যা আবার মূকাভিনয়ের আদি ঐতিহ্যকেও ধারণ করে। প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট মূকাভিনয় চর্চায় আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাসী। এই ধারাবাহিকতায় সমপ্রতি রিজোয়ান রাজনের একক অভিনীত মূকাভিনয় ‘দ্য আর্টিস্ট’, ‘প্রাণ প্রকৃতি’ এবং ‘অনীল কাকা’ সেই সাক্ষ্য বহন করছে। ইতোমধ্যে ‘দ্য আর্টিস্ট’ প্রযোজনাটি চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ছাড়াও ভারতের পাঁচটি নাট্যোৎসবে সফলভাবে মঞ্চস্থ হয়েছে। এছাড়া প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ব্যাংকক থিয়েটার ফেস্টিভাল, ভারতের মধ্যপ্রদেশের যথাক্রমে সিদ্ধিতে আন্তর্জাতিক লোক ও সাংস্কৃতিক উৎসব, রেওয়াতে ইন্টারন্যাশনাল মাল্টিল্যাঙ্গুয়াল থিয়েটার আর্টস ফেস্টিভেল, দামোতে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ফেস্টিভেল, পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে আন্তর্জাতিক মাইম ফেস্টিভেল, কলকাতায় আন্তর্জাতিক মাইম ফেস্টিভেল ও তিনবার ভারতীয় জাতীয় মূকাভিনয় উৎসব, নৈহাটিতে ইন্দোবাংলা কালচারাল ফেস্টিভেলে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মূকাভিনয়কে পরিচিত এবং দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছে। প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট মূকাভিনয় চর্চাকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্যান্টোমাইম নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা যা পরবর্তীতে ষান্মাসিক হিসেবে প্রকাশ করে। এই পত্রিকার উদ্যোগে ২০১০ সালে দেশের সর্ববৃহৎ মূকাভিনয়ের মোর্চা সংগঠন বাংলাদেশ মূকাভিনয় ফেডারেশন গঠিত হয়েছিল। রিজোয়ান রাজন দীর্ঘ দশ বছর এই ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে প্যান্টোমাইম মুভমেন্টের সাধারণ সম্পাদক সোলেমান মেহেদী ফেডারেশনের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া মূকাভিনয়ের আরো একটি জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ পথমূকাভিনয় পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবে আছেন রিজোয়ান রাজন। প্যান্টোমাইম মুভমেন্ট দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে মূকাভিনয়ের পদ্ধতিগত প্রশিক্ষণ ও সুষ্ঠু সংস্কৃতির বিকাশে মূকাভিনয়ের পাঠশালা বা প্যান্টোমাইম স্কুলের কাজ শুরু করতে চায়। ইতোমধ্যে পাঠশালার প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে। দলের বেশ কয়েকজন বিদেশ থেকে মূকাভিনয়ের উপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন। এখন শুধু স্বপ্নের পথে আবারো দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পালা।