৩৫ বছর পর ট্যারিফ বৃদ্ধির উদ্যোগ

নিয়োগ দেয়া হয়েছে বিদেশি পরামর্শক মাশুল বাড়ালে ব্যবসা করা কঠিন হবে : বিজিএমইএ

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ৭ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

বিভিন্ন সেবার বিপরীতে ৩৫ বছর পর ট্যারিফ(মাশুল) বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে নির্ধারণ করা ট্যারিফ বৃদ্ধির বিষয়ে বন্দর ব্যবহারকারীদের মতামত জানতে চিঠি দেয়া হয়েছে। বিষয়টির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গঠন করা হয়েছে ‘পরামর্শক টিম’। বন্দর ব্যবহারকারীদের পক্ষ থেকে করোনা মহামারির এ সময়ে কোনো ধরনের ট্যারিফ না বাড়ানোর জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। সূত্র জানায়, বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের মাশুল আদায় করে থাকে। বর্তমানে যে মাশুল নেয়া হচ্ছে তা ১৯৮৬ সালে নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর থেকে আর কোনো মাশুল বৃদ্ধি করা হয়নি। দুই বছর আগে ২০১৯ সালে মাশুল বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু বন্দর ব্যবহারকারীদের বিরোধীতার মুখে তা হয়নি। পরবর্তীতে বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় থেকে মাশুল বৃদ্ধির বিষয়ে মতামত দেয়া হলেও নানা জটিলতায় তা আর হয়ে উঠেনি। পরবর্তীতে করোনা মহামারির কারণে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। করোনার প্রকোপ কমার পর নিউ নরম্যালে অভ্যস্ত হওয়ায় বন্দর কর্তৃপক্ষ নতুন করে মাশুল বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সেবার মাশুল বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক একটি পরামর্শক টিম নিয়োগ দিয়েছে। স্পেনের মেসার্স আইডিওম কনসালটিং, ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড আর্কিটেক্ট ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান মেসার্স এস লজিকফ্রুম লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
তারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সমীক্ষা শুরু করেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দর ব্যবহারকারীদের মতামত নিচ্ছে। উক্ত মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে বলে বন্দরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানায়, বন্দরে বিভিন্ন সেবার মান বেড়েছে, বিভিন্ন প্রযুক্তি সংযোজন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বন্দরের সক্ষমতা বেড়েছে। খরচ বেড়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অপারেটরদের খরচ বেড়েছে। সবকিছু মিলে ১৯৮৬ সালে নির্ধারিত মাশুলে সেবা দেয়া কঠিন হয়ে উঠছে। তাই সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে মাশুল বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখন সবার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে।
বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংগঠনের একাধিক নেতা গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, মাশুল বৃদ্ধির বিষয়ে আমাদের কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে। আমরা স্পষ্টভাবে ‘না’ বলে দিয়েছি। করোনাকালে যখন আমরা সবাই দিশেহারা তখন বন্দর কর্তৃপক্ষ এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে আমাদেরকে বেকায়দায় ফেলার কোন মানে হয় না। তাঁরা বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ ১৯৮৬ সালে ট্যারিফ নির্ধারণ করলেও তা অনেক বেশি। আশপাশের দেশগুলোর অন্যান্য অনেক বন্দরের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল অনেক বেশি। মাশুল এত বেশি যে তা নতুন করে বৃদ্ধির সুযোগ নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক বন্দর ব্যবহারকারী বলেন, বন্দর কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়, সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। বন্দর বলছে- তাদের সেবা-সক্ষমতা বেড়েছে। সুতরাং তাদের মুনাফাও বেড়েছে। বন্দরের উচিত- ট্যারিফ না বাড়িয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে অপারেশনাল কাজে গতি এনে প্রচলিত হারে মাশুল আদায় করা। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- বন্দর আমাদের কাছ থেকে অধিকাংশ মাশুল আদায় করে ডলারে। ১৯৮৬ সালে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৪০ টাকার নিচে। বর্তমানে ডলারের বিনিময় হার ৯০ টাকার কাছাকাছি। এতে মাশুল না বাড়লেও আমাদের খরচ কিন্তু দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তাই নতুন করে মাশুল বৃদ্ধির কোন যৌক্তিকতা নেই বলেও তাঁরা মন্তব্য করেছেন।
বন্দরের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালের মতো এবারও বন্দর ব্যবহারে ১৫টি সেবার বিপরীতে বিভিন্ন উপখাতে মাশুল ৩৩ থেকে ৪৮৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ পোর্ট ডিউজ, পাইলটেজ ফি, বার্থিং-আনবার্থিং ফি, বার্থে অবস্থান, মুরিংয়ে অবস্থান, পানি সরবরাহ চার্জ, রিভার ডিউজ (প্রথাগত) ও ল্যান্ডিং অথবা শিপিং চার্জ (প্রথাগত), বন্দরের স্থান ব্যবহার ভাড়া ( স্পেস রেন্ট), কন্টেনার বোঝাই ও খালাসকরণ, রেফার কন্টেনার সেবা, রিভার ডিউজ (কন্টেনারাইজড), লিফট অন/লিফট অফ চার্জ (চট্টগ্রাম বন্দর), লিফট অন/লিফট অফ চার্জ (ঢাকা আইসিডি) ও ঢাকার আইসিডিতে কন্টেনারের স্টোরেজ ভাড়া খাতে মাশুল বৃদ্ধি করতে চায় বলেও সূত্র জানায়।
উল্লেখ্য, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে পাঁচটি সেবায় ২৩ শতাংশ মূল্য বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা)। অপরদিকে লাইটারেজ জাহাজের ভাড়াও ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেছেন- মাশুল বাড়ানোর একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সবার সাথে আলোচনা করা হচ্ছে। সবার মতামত নিয়েই মাশুল বাড়ানো হবে।
বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মাশুল বৃদ্ধির বিরোধিতা করে বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। সবাই মাশুল বাড়াচ্ছে। অবস্থা এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পক্ষে ব্যবসা করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে কয়েকদিন আগে পণ্য পরিবহন, বেসরকারি আইসিডি ও লাইটার জাহাজের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এখন বন্দরও যদি মাশুল বাড়ায় তাহলে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে উঠবে। তিনি বন্দর কর্তৃপক্ষকে আরো অন্তত দুই বছর পর মাশুল বৃদ্ধির বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপালিয়ে যাওয়া আসামি ফের গ্রেপ্তার
পরবর্তী নিবন্ধআমার গাড়ি নিরাপদ