২য় পর্ব
আবদুল জব্বার খান এবং তৎকালীন প্রাদেশিক সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন যৌথভাবে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে বঙ্গবন্ধুর কাছে জমা দেন। ১৯৫৫ সালের শেষ দিকে ইতালির একটি চলচ্চিত্র মিশন ঢাকায় আসে। তারা ঢাকার চলচ্চিত্রামোদীদের সঙ্গে এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও দেখা করেন এবং ঢাকায় স্টুডিও স্থাপনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন।
১৯৫৬ সালে তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার চলচ্চিত্র শিল্প প্রসারের লক্ষ্যে পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনার ঘোষণা দেন যার নেপথ্যে উদ্যোগী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি মাধ্যমটির গুরুত্ব সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন।
১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে লাহোরে একটি সরকারি সংস্থা স্থাপনের লক্ষ্যে এক কোটি টাকা বরাদ্দ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশের জন্যেও সম পরিমাণ অর্থ বরাদ্দের দাবি করেন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান নাজীর আহমদ। তাঁকে সমর্থন জানান পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্রানুরাগীরা। ব্যাপারটি রীতিমত একটি সাংস্কৃতিক দাবিতে পরিণত হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের জন্যে চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বলাবাহুল্য, এর নেপথ্যে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন সঞ্জাত বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও বাংলা সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও বিকাশের চেতনা সক্রিয়ভাবে কাজ করে। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তারা তখন পূর্ব পাকিস্তানে একটি সরকারি চলচ্চিত্র সংস্থা গঠনের পরামর্শ দেন। নাজীর আহমদ তখন শিল্প দপ্তরের সচিব আসগর আলী শাহ ও উপসচিব আবুল খায়েরের মাধ্যমে বিষয়টি বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নজরে আনেন। বঙ্গবন্ধু সব শুনে অতি সত্ত্বর ‘চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ প্রতিষ্ঠার বিলের একটি খসড়ার জন্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করার নির্দেশ দেন। হাতে তখন একেবারে সময় ছিল না। প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশন শেষ হতে তখন মাত্র দু’দিন বাকী। এই দু’দিনের মধ্যেই আবুল খায়ের ও নাজীর আহমদ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন বা এফডিসি বিলের খসড়া তৈরি করেন।
১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশনের শেষ দিন সকালে বঙ্গবন্ধু ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ বা ‘ইপিএফডিসি’ বিল উত্থাপন করেন। অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন ১১ জন মন্ত্রী ও ২৫০ জন সদস্য। বিল উত্থাপনের পর তিন সদস্য আবদুল মতিন, ইমদাদ আলী ও মনীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বিলে কিছু সংশোধনী আনার পর সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাশ হয়। এসময় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও আতাউর রহমান খান ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, শুভ সূচনা হয় এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিকতার।
বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই যাত্রা শুরু হয় এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিকতার ও প্রসারের। বাংলাদেশ সরকার ৩ এপ্রিল তারিখটিকে জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস ঘোষণা করেছে ২০১২ সালে। সেই থেকে ৩ এপ্রিল বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস হিসেবে গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে।
বঙ্গবন্ধুর আনা বিলের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৭ সালে ২৮ জুন এফডিসি গঠিত হয়। প্রথমে এর অফিস ছিল বায়তুল মোকাররমে। পরে তেজগাঁওতে এর পূর্ণাঙ্গ স্টুডিও ও কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় যা এখনো চালু রয়েছে। যদিও এর অবস্থা এখন অত্যন্ত সঙ্গীন।
এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের অনেক নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল। এঁদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের কল্যাণে অনেক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। চলচ্চিত্রসেবীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পের স্বার্থরক্ষায় বিদেশি ছবির আমদানী নিয়ন্ত্রণে তিনি উদ্যোগ নেন। দেশে উর্দু, হিন্দি ও কলকাতার বাংলা ছবির প্রদর্শনী নিষিদ্ধ করেন দেশীয় চলচ্চিত্রের বিকাশ সাধন ও বাণিজ্য স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দেশে উর্দু, হিন্দি ও কলকাতার বাংলা ছবি প্রদর্শিত হতো। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর হিন্দি ও কলকাতার বাংলা ছবির প্রদর্শন নিষিদ্ধ হলেও লাহোর-করাচির উর্দু ছবি প্রদর্শিত হতো স্বাধীনতার পর। একটি মহল ১৯৬৫ পূর্ব অবস্থায় দেশীয় প্রদর্শন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুললে বঙ্গবন্ধু তা নাকচ করে দেন।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার নতুন প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণে শিল্প ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শেষোক্ত তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর। সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হতে সময় লেগে যায়। ১৯৭৪ সালে গৃহিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হতে সময় লেগে যায়। ১৯৭৪ সালে গৃহিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় কয়েক বছর পর এবং এর কৃতিত্বের দাবিদার হয় বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী অন্যদলীয় সরকার (বলা ভালো সামরিক সরকার)।
১৯৭২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের জন্যে বাংলাদেশ সরকার ভারতের বিভিন্ন শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। যাঁদের মধ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, বিশ্বজিৎ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নার্গিস দত্ত, সুনীল দত্তসহ কলকাতা ও মুম্বাইয়ের শীর্ষস্থানীয় অনেক চলচ্চিত্র শিল্পী কলাকুশলী। আমন্ত্রিত শিল্পীরা সকলেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেবার এবং এরপরে তিতাস একটি নদীর নাম নির্মাণ করার সময়ে ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ হয়।
বঙ্গবন্ধু সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের অনুরাগী ছিলেন। তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে ঢাকার বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাস মাঝেমধ্যে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন। বঙ্গবন্ধু সেসব প্রদর্শনীতে সুধীজনদেরও আমন্ত্রণ জানাতেন তাঁর বাড়িতে। ভারতীয় দূতাবাসকে তিনি অনুরোধ করতেন সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র প্রদর্শন করার জন্য। সত্যজিতের চারুলতা ছবিটির বঙ্গবন্ধুর খুব পছন্দের ছিল। এসব কথা জেনেছিলাম শিল্পী মুর্তজা বশীরের সঙ্গে ব্যক্তিগত কথোকপথনে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে একটি বিশেষ চলচ্চিত্র প্রকল্প চালু ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে সারা দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে সাতটি ভারতীয় চলচ্চিত্র ভারত সরকারের অনুদানের ভিত্তিতে প্রদর্শিত হতো। ছবিগুলো ছিল; অপুর সংসার, গুপী গাইন বাঘা বাইন, সুবর্ণরেখা, কাবুলিওয়ালা, পৃথিবী আমাকে চায়, দীপ জ্বেলে যাই ও সাধারণ মেয়ে। সবকটি ছবি বাংলা। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে ছবিগুলো চলতো। তহবিল সংগ্রহের পাশাপাশি দর্শকরুচির উন্নয়নেও এই প্রকল্প যথেষ্ট কার্যকর ছিল। ১৯৭৫ এর পর এই প্রকল্পটি বাতিল হয়।
কিন্তু আমরা তাঁর সেই অনুরাগের মূল্যায়ন করতে পারিনি। তাঁর শহীদ হওয়ার পর ৪৫টি বছর পার হয়ে গেছে। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন করা হচ্ছে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে একটি বায়োপিক ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র শেষ পর্যন্ত তৈরি হলো না।
শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় নির্মিতব্য বায়োপিকের কাজ আরো অনেক আগে শুরু করার দরকার ছিল। উদ্যোগটা অনেক আগে থেকে শুরু করা যেত অবশ্যই। বঙ্গবন্ধুর দলের সরকার গত কয়েক মেয়াদে এদেশের ক্ষমতায় আসীন। সুবর্ণ সুযোগ ছিল ভালো একটি বায়োপিক ও নির্ভরশীল একটি ডকুমেন্টরি ছবি নির্মাণের।
এ প্রসঙ্গে আমরা রিচার্ড এ্যাটেনবরো পরিচালিত ‘গান্ধী’ ছবির কথা বলতে পারি, যে ছবি সারা বিশ্বে গান্ধীকে পরিচিত করেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। কিন্তু এ-ছবিটি হুট করে তৈরি হয়নি। ১২ বছর সময় নিয়ে এটেন বরো এ ছবির কাজ করেছেন। দীর্ঘ সময় নিয়ে ভারত ও অন্যান্য দেশে গবেষণা করেছেন পরিচালক। দীর্ঘ সময় নিয়ে সারা ভারত ঘুরে বেড়িয়েছেন। স্বভাবতই এই বিশাল কার্যযজ্ঞে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে গেছেন কংগ্রেস দলের নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার।
বাংলাদেশে শ্যাম বেনেগালের নির্মিতব্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ছবির ক্ষেত্রে এ-ধরনের কোনো দীর্ঘ প্রস্তুতির কথা জানা যায় না। এই মহান নেতার স্মৃতি ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে, ভারত-পাকিস্তানসহ নানান দেশে। তথ্য নিষ্ঠতার খাতিরে দীর্ঘ প্রস্তুতির অবশ্যই প্রয়োজন ছিল, যার অবকাশও ছিল যথেষ্ট।
তেমনি প্রয়োজন রয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তথ্যনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের। উদ্যোগটি অত্যন্ত জরুরি। টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা যেসব চলচ্চিত্র ধরনের ফুটেজ দেখি, এগুলি সব সরকারি নিউজরিল। ডকুমেন্টারি নয়। এসব ফুটেজ দেখে মনে হয় ডিএফপি, বিটিভি এবং আর্কাইভে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচুর ফুটেজ রয়েছে। ভাগ্যক্রমে এসব ফুটেজ কালো চক্রের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেছে। তথ্যনিষ্ঠ একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে এসব ফুটেজ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সুন্দর একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন জাপানের প্রথিতযশা চলচ্চিত্রকার নাগিশা ওশিমা। ‘রহমান দি ফাদার অফ নেশন’ ছবিটি তৈরি হয় ১৯৭৩ সালে। প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটিতে যথেষ্ট যত্ন এবং আন্তরিকতার ছাপ পরিলক্ষিত হয়। তব্ে এটা আমাদের জন্যে যুগপৎ আনন্দের ও লজ্জার। আনন্দ সুদূর জাপানের এক নামকরা চলচ্চিত্রকারের হাতে বঙ্গবন্ধুকে আবিষ্কার ও মূল্যায়নের কারণে। আর লজ্জা আমাদের অদ্যাবধি নিশ্চুপতার জন্যে।
অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় নির্মিতব্য বায়োপিকটি আর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে নির্মিত হতে পারবে না। তারপরে হলেও হোক। আর প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি নির্মাণেও উদ্যোগী হওয়া জরুরি। আমরা সবকিছু করি দেরিতে। তবুও Better Late Than Never.