নগরীর খুলশী থানাধীন ঝাউতলা-জাকির হোসেন রোড রেল ক্রসিংয়ে ডেমু ট্রেনের সাথে বাস, ম্যাক্সিমা ও সিএনজি টেক্সির সংঘর্ষে একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী, একজন ট্রাফিক কনস্টেবলসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো ১০ জন। গতকাল শনিবার বেলা পৌনে ১১টায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রেন আসার এই সময়ে গেটম্যান আশরাফুল আলমগীর ভূইয়া ক্রসিংয়ের পশ্চিম পাশের ব্যারিয়ার ফেললেও পূর্ব পাশের ব্যারিয়ার না ফেলার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ, রেলওয়ে কর্মকর্তা এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন। ঘটনার পরপরই গেট কিপার আশরাফুল পার্শ্ববর্তী বাসা থেকে পরিবার নিয়ে পালিয়ে গেছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এই ঘটনায় রেলওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি এবং রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পক্ষ থেকে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন পাহাড়তলী ডিগ্রি কলেজের এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী সাতরাজ উদ্দিন শাহীন (১৯)। তিনি গত বৃহস্পতিবার এইচএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন পদার্থ বিজ্ঞান পরীক্ষা দিয়েছেন। তার পিতার নাম ফজল করিম। গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ির নানুপুর। অপরজন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক কনস্টেবল মো. মনির হোসেন (৪০)। তিনি ট্রাফিক উত্তর বিভাগে কর্মরত। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার খোয়াজপুর গ্রামে। নিহত অন্যজন হলেন ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ বাহাউদ্দিন আহমেদ (৩০)। তিনি ডালিয়া কনস্ট্রাকশনের প্রকৌশলী। তার পিতার নাম সৈয়দ সোহরাফ হোসেন, তার বাসা হামজারবাগে।
পাঁচলাইশ মডেল থানার ওসি (তদন্ত) সাদেকুর রহমান বলেন, আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারা হলেন আবুল হোসেন (৬৫), জমির হোসেন (৪৮), শহীদুল ইসলাম (৪০), জয়নাল (২৬), জোবাইদা (২০), শামীমা (১১), মোহাম্মদ (১০) ও আদনান (৭)। এদের মধ্যে আবুল হোসেন ও জমির হোসেনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। ঘটনার পর নিহত ও আহতদের চমেক হাসপাতালে নেয়া হলে নিহতদের পরিবারের আত্মীয়-স্বজনের কান্নায় পুরো পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কুলসুম বেগম ও শায়লা আক্তার জানান, নাজিরহাট থেকে যাত্রী নিয়ে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন আসছিল ডেমু ট্রেনটি। ট্রেনটি পৌনে ১১টায় ঝাউতলা জাকির হোসেন রেল ক্রসিং অতিক্রম করার সময় পশ্চিম পাশের রেল ক্রসিংয়ে ব্যারিয়ার ফেলে বন্ধ করা হলেও পূর্ব পাশের (জিইসির দিক থেকে আসা) গেট খোলা ছিল। ডেমু ট্রেনটি যখন ক্রসিংয়ের কাছাকাছি চলে আসে তখন গেটম্যান আলমগীর তার ঘরের (ক্রসিংয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে) সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা তাকে লাইনের বাঁশ (ব্যারিয়ার) ফেলার জন্য বলছিলাম। কিন্তু তিনি তার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় একটি ম্যাক্সিমা (চট্টমেট্রো-ফ-১১-২৬৪৩) এবং একটি সিএনজি টেক্সি (চট্টমেট্রো-১৩-১১৭৯) একেবারে কাছে চলে এলে ট্রাফিক কনস্টেবল মো. মনির হোসেন গাড়িগুলো থামাতে যান। এ সময় চোখের পলকে পেছন দিক থেকে বেপরোয়া গতিতে ৭ নম্বর রুটের (চট্টমেট্রো-ছ-১১-১৬২৩) নিউ মার্কেট থেকে ভাটিয়ারীগামী একটি মিনিবাস সজোরে সিএনজি ও ম্যাক্সিমাকে ধাক্কা দিলে গাড়ি দুটো চলন্ত ট্রেনের সাথে লেগে দুমড়ে মুচড়ে যায়। একটি টেক্সি ট্রেনের নিচে চাপা পড়ে এবং ম্যাক্সিমাকে সামনে অনেক দূরে নিয়ে যায়। এ সময় ট্রেনটি ক্রসিংয়ের কিছুদূর সামনে গিয়ে থেমে যায়। ঘটনাস্থলেই ট্রাফিক কনস্টেবল মো. মনির হোসেন নিহত হন। একই ঘটনায় এইচএসসি পরীক্ষার্থী সাতরাজ উদ্দীন শাহীন (১৯) ও প্রকৌশলী সৈয়দ বাহাউদ্দিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আহত হন আরো ৯/১০ জন।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন রেলওয়ে পুলিশ সুপার হাসান চৌধুরী। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ডেমু ট্রেনটি যখন ক্রসিং এলাকা অতিক্রম করছিল তখন রেল গেট ফেলা না ফেলা নিয়ে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে। তবে রেল গেটের এক পাশের ব্যারিয়ার খোলা ছিল বলে জেনেছি। গেট কিপারকে এসে পাইনি। নাজিরহাট থেকে কদমতলীর দিকে আসা ডেমু ট্রেনটির সাথে বাস, সিএনজির ত্রিমুখী সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করতে আমরা তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছি।
দুটি তদন্ত কমিটি গঠন : দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল গফুরকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এদিকে এই দুর্ঘটনায় বিষয়ে তদন্তের জন্য রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির কর্মকর্তারা হলেন আহ্বায়ক সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান। সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সহকারী কমান্ড্যান্ট সত্যজিৎ দাশ, সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী (এইএন) ফারুক হোসেন, সহকারী যান্ত্রিক প্রকৌশলী (এমই) অপারেশন বজরুল রহমান ও অপরজন সহকারী সার্জেন্ট চট্টগ্রাম।
এ ব্যাপারে আরএনবির এসিসট্যান্ট কমান্ড্যান্ট সত্যজিৎ দাশ বলেন, তদন্তের দায়িত্ব দেয়ার পর আমরা দুর্ঘটনার বিষয়টি তদন্ত করছি।
দুর্ঘটনাস্থল ঝাউতলা জাকির হোসেন রেল ক্রসিং অফিসে বসে রেলওয়ে থানার ওসি নাজিম উদ্দীন আজাদীকে বলেন, গেট কিপার আশরাফুল আলমগীর ভূইয়াকে পাচ্ছি না। কী কারণে এই ঘটনা ঘটেছে সে ভালো বলতে পারত। শুনেছি, পূর্ব পাশের গেট খোলা ছিল। এ সময় একটি ম্যাক্সিমা ও সিএনজি ক্রসিংয়ে উঠে গেলে পেছন দিকে থেকে একটি বাস জোরে ধাক্কা দিলে নজিরহাট থেকে আসা ডেমু ট্রেনের সাথে লেগে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এসআই আশিকুর রহমান আজাদীকে বলেন, দুর্ঘটনায় ৯ জনের মতো আহত ব্যক্তি চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য : রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলওয়ে ট্রাফিক বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকা এ গেটে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের কথা তিনজন গেটম্যানের। আশরাফুল আলমগীর ভুইয়া ছাড়াও এ গেটে ডিউটিতে থাকেন গেটম্যান মাকসুদ ও আজাদ। কিন্তু গেটম্যানরা কখনও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতেন না। তারা অধিকাংশ সময় ডিউটিতে থাকতেন না। ব্যস্ততম এ গেটে প্রায় সময় বস্তির বাচ্চাদের দিয়ে গেট ফেলাতেন।
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী দোকানদার সুজিত চৌধুরী জানান, গেটম্যান সড়কের এক পাশের গেট ফেললেও অন্য পাশেরটা ফেলেননি। এতে জিইসি মোড় থেকে এ কে খান গেটগামী গাড়িগুলো রেললাইনের ওপর চলে আসে। তখনই দুর্ঘটনা ঘটে। গেট কিপার এখানে নিয়মিত উপস্থিত থাকেন না। তিনি আশেপাশের বস্তির ছেলেদের ১০/২০ টাকা দিয়ে গেট খোলা বা বন্ধ করার কাজ করাতেন।
প্রত্যক্ষদর্শী টেক্সি ড্রাইভার আলী আকবর জানান, গেটম্যান আশরাফুল আলমগীর ভূঁইয়া রেলগেটের পশ্চিম ব্যারিয়ার ফেললেও পূর্ব পাশের ব্যারিয়ার ফেলেননি। এতে একটি টেক্সি ও একটি ম্যাক্সিমাকে পেছন দিক থেকে একটি মিনিবাস সজোরে ধাক্কা দিলে চলন্ত ট্রেনের উপর গিয়ে পড়ে। এ সময় ট্রেনটি গাড়িগুলোকে সামনে অনেক দূর নিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলে ট্রাফিক সদস্য মনির হোসেন ও চমেক হাসপাতালে সাতরাজ উদ্দীন শাহীন ও প্রকৌশলী সৈয়দ বাহাউদ্দিন মারা যান।
সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, জাকির হোসেন সড়কের দুই পাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনাস্থলে লোকজনের পাশাপাশি নিহত ও আহতদের আত্মীয়-স্বজন ভিড় করেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ও রেলওয়ের পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ক্রসিংয়ের পূর্ব পাশে খাদে পড়েছিল একটি টেক্সি ও একটি ম্যাক্সিমা।
বাস চালককে খুঁজছে পুলিশ : খুলশী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. শাহীনুজ্জামান আজাদীকে বলেন, প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এই দুর্ঘটনার জন্য বাস চালকই দায়ী। আমরা বাস চালককে খুঁজছি। তাকে আটক করতে পারলে জিজ্ঞাসাবাদে সবকিছু জানা যাবে। বাসটি রেলওয়ে পুলিশ আটক করেছে। রেলওয়ে পুলিশ এই ব্যাপারে সবকিছু দেখছে।
রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দিন বলেন, আমরা বাসটি আটক করেছি। চালককে খুঁজছি। এই দুর্ঘটনার জন্য বাসের চালকও দায়ী। বাস চালককে প্রধান আসামি করে একটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।












