ঘরে সাপ, বাইরে সাপ। ক্ষেত-খামার, খাল-বিল বাদ যাচ্ছে না কিছুই। যেদিকে যাবেন সেদিকেই সাপ। ঘরের মধ্যে, বিছানায়, পুকুর, রাস্তাঘাট-কোথায় নেই? সাপের ভয়ে আতঙ্কে আছে বোয়ালখালী উপজেলার দক্ষিণ সারোয়াতলী গ্রামের মানুষ। এতে করে একদিকে যেমন নির্ঘুম রাত কাটাতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে, অন্যদিকে ক্ষেতের ফসল নষ্ট হচ্ছে। ক্ষেতে কাজ করার লোকও পাওয়া যাচ্ছে না।
এলাকাবাসী জানান, প্রায় মাসখানেক ধরে এখানে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে সাপের উপদ্রব। মীর আইচ নামের এক কৃষক বলেন, ক্ষেতে কাজ করছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে কি যেন কামড় দিল বুঝতে পারিনি। পরে হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার বললেন বিষধর সাপে কামড়েছে। আট দিন হাসপাতালে ছিলাম। শুক্রবার বাড়িতে ফিরেছি। এখন ক্ষেতে যেতে ভয় পাচ্ছি। শুধু আমি নই, সাপের ভয়ে এখন কেউ জমিতে নামতে চাচ্ছে না।
বাবুল চৌধুরী নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, রাতে ঘুমাতে গিয়ে দেখি ঘরের চাল থেকে বিছানায় পড়ে বিষধর এক সাপ। রাতভর ঘরের কেউ ঘুমাতে পারিনি।
তাপস নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়ার টেবিলে গিয়ে দেখি চেয়ারের নিচে ফনা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটি সাপ। চিৎকার দিতেই বাড়ির অন্যরা ছুটে এসে পিটিয়ে মারার পর স্বস্তি পাই।
শীতনিদ্রার এই মৌসুমে সাপের উৎপাত কেন? বোয়ালখালীর মানুষ বলছেন, শীতের এই সময়ে সাপের উপদ্রবের কারণ ভিন্ন।
সারোয়াতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন জানান, গ্রামে একটি প্রাচীন খাল ছিল। কৃষি জমিতে সেচের পানি সরবরাহ ঠিক রাখতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (বিএডিসি) এ খাল খনন করছে। এর অংশ হিসেবে কয়েক মাস আগে তাদের গ্রামের লাগোয়া রায়খালী খালপাড়ের জঙ্গল কেটে ফেলা হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ কৃষি জমিতে, উঠানে, রাস্তায় এবং বাড়িঘরে ঢুকে পড়ছে। চারদিকে সাপ আতঙ্ক বিরাজ করছে। অবশ্য আগের তুলনায় এখন কিছুটা কমে এসেছে। আমরা ব্যাপারটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।
কম বিষধর সাপের পাশাপাশি বিষধর গোখরা, শঙ্খিনীর সঙ্গে দাঁড়াশের মতো ভয়ঙ্কর সাপেরও দেখা মিলছে বলে জানান দক্ষিণ সারোয়াতলীর স্থানীয় মেম্বার সুরেষ চৌধুরী। তিনি বলেন, কৃষি জমির পাশাপাশি বাড়িঘরেও সাপ দেখা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এখানকার ১০/১২ জনকে সাপ কামড়েয়েছে। কৃষকরা ধান কাটতে জমিতে যেতে ভয় পাচ্ছে।
চট্টগ্রাম পরিবেশ আদালতের পিপি অ্যাভভোকেট হুমায়ুন রশীদ রোবেল বলেন, আমরা শুনেছি আতঙ্কের কারণে ওখানে অনেকে সাপ মারছেন, যা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। এতে পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি সেখানকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়বে। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুন নাহার বলেন, ইতোমধ্যে এ বিষয়ে খোঁজ নিয়েছি। ঝোপ-জঙ্গল কাটা বন্ধ করতে বলেছি। আগামীকাল (আজ) সরেজমিনে যাব। দেখে পরবর্তীতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেব।
বিডিনিউজ সূত্রে জানা যায়, পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাপের আবাস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সেগুলো লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব সাপ যদি নিধন করা হয়, তাহলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি কিউরেটর ও চিকিৎসক শাহাদাত হোসেন শুভ বলেন, সাপ মারা হলে ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে যাবে। তাতে রোগ জীবাণু ছড়াবে এবং প্রচুর পরিমাণ ফসল নষ্ট হবে। অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্য দুই দিকেই ক্ষতি। তবে কাউকে সাপে কাটলে অপেক্ষা না করে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী মনে করেন, আবাসস্থলে আঘাত আসার কারণেই সাপগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। উষ্ণ গোপন স্থানে আশ্রয় পাওয়ার আশায় বাড়িঘরে ঢুকেছে। আসলে যে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের আগে ইকোলজিক্যাল ইমপেক্ট কী হতে পারে সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। যেটা আমাদের সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দেখা হয় না। আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র ক্ষতি মনে হলেও এটা এক সময় বৃহৎ আকার ধারণ করে। অর্থনৈতিকভাবে চিন্তা করলে ইঁদুরসহ বিভিন্ন ক্ষতিকারক পোকা এবং প্রাণী খেয়ে ফেলে সাপ বছরে কয়েক কোটি টাকার ফসল রক্ষা করে। বিশেষ করে ধান উৎপাদন ও সংরক্ষণে এর ভূমিকা ব্যাপক।
তিনি করেন, সাপের অর্থনৈতিক উপকারের বিষয়টি হিসেব করা গেলেও সাপ নিধনে যে ‘ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স’ নষ্ট হবে, সেটার মূল্য নির্ধারণ করা যাবে না। সাধারণত মানুষজন সাপকে ভয় পায় এবং অজ্ঞতা থেকে সেগুলো মারে; যেটা পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। কোথাও সাপ দেখা গেলে দূর থেকে শব্দ করলেই কিন্তু সেগুলো চলে যাবে। সাপের উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে বাড়ির আশপাশে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
বিবিসি বাংলা জানায়, দেশে প্রতি বছর বর্ষায় প্রায় ৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। অন্তত ৬ হাজার মানুষ মারা যান বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রাম, কঙবাজার, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ এলাকায় সাপের কামড় এবং তা থেকে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে।












