মশক নিধন ইস্যুতে হট্টগোল

দুই কাউন্সিলরের বাকবিতণ্ডা ।। প্রধান প্রকৌশলীর ওপর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ক্ষোভ ।। চসিকের সাধারণ সভায় দখলমুক্ত ফুটপাতের ঘোষণা মেয়রের

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ১ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

মশক নিধন ইস্যুতে হট্টগোল হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সাধারণ সভায়। এ সময় বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন প্যানেল মেয়র-১ আবদুস সবুর লিটন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. মোবারক আলী। দুজনের কথা কাটাকাটি হলেও বেশ কিছুক্ষণ চুপ ছিলেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। পরে অবশ্য তিনি দুজনকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানান।
সভায় দ্রুত সময়ে মশক নিধনে ওষুধ সংগ্রহ করার দাবি জানান বেশিরভাগ কাউন্সিলর। এছাড়া চলমান উন্নয়ন প্রকল্প এলাকায় প্রকল্পের তথ্য এবং জনগণকে সতর্ক করে সাইনবোর্ড না টাঙ্গানো নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এক কাউন্সিলর। পাশাপাশি প্রধান প্রকৌশলীর ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। সভায় উপস্থিত একাধিক কাউন্সিলর ও চসিকের কর্মকর্তা বিষয়টি দৈনিক আজাদীকে নিশ্চিত করেছেন। গতকাল সকালে আন্দরকিল্লা নগর ভবনে কেবি আবদুচ সাত্তার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় চসিকের বর্তমান পর্ষদের ১০ম সাধারণ সভা। এতে সভাপতিত্ব করেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।
দুই কাউন্সিলরের বাকবিতণ্ডা : সভায় উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম চৌধুরী বলেন, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী যেসব ওষুধ ব্যবহার করেন সেগুলো সংগ্রহ করা হবে। তাদের কার্যাদেশের তথ্য অনুযায়ী, পূর্ণাঙ্গ মশক নিধনের জন্য প্রতি লিটার এডাল্টিসাইটের দাম ৫৯০ টাকা এবং লার্ভিসাইডের দাম পড়বে তিন হাজার ৮৮০ টাকা।
তখন কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, শহরে মশা বেড়ে গেছে। যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে সেটা দিয়ে মশা মরছে না। তিনি বলেন, মশার ওষুধ ১৬০ টাকায় পাওয়া যায়। এ দামে ঢাকা থেকে সংগ্রহ করে ছিটাচ্ছি। সুফল মিলছে। এ সময় তিনি ওই ওষুধ কার্যকর কিনা তা পরীক্ষার জন্য এক ড্রাম ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহ করবেন বলেও ঘোষণা দেন।
তখন কাউন্সিলর মোবারক আলী বলেন, ইচ্ছে করলেই ওষুধ সংগ্রহের সুযোগ নাই। টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন ওষুধ সংগ্রহ করে। এছাড়া জাতীয় নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছে সরকার। সেখানেও সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে। ওষুধ কেনার ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার বাধ্যবাধকতা আছে। প্রতিউত্তরে লিটন বলেন, সবকিছু টেন্ডার করতে হবে কেন? চসিকের কিছু টাকা সাশ্রয় হলে সমস্যা কোথায়?
এ নিয়ে দুজনই পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিতে থাকেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। এ সময় অন্য কাউন্সিলরগণও হৈ চৈ করেন। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মেয়র দুজনকে শান্ত হয়ে যার যার বক্তব্য উপস্থাপন করতে বলেন। কয়েকজন কাউন্সিলর অভিযোগ করেন, পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমে যত শ্রমিক বণ্টন করার কথা বলা হয় বাস্তবে ওয়ার্ডে তত শ্রমিক পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুস সবুর লিটন আজাদীকে বলেন, আমার ওয়ার্ডে, আমার ব্যক্তিগত ফ্যাক্টরিসহ অন্যান্য জায়গায় ১৬০ টাকা করে কিনে ব্যবহার করছি। সুফলও পাচ্ছি। কর্পোরেশনেও এটা সংগ্রহ করতে বলেছি। এক্ষেত্রে আমি এক ড্রাম দেব বলেছি। ৪১ ওয়ার্ডে ৫ লিটার করে পাবে। তারা ব্যবহার করে দেখুক, কাজ হয় কিনা। তিনি বলেন, বলা হচ্ছে ওষুধ নেয়ার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতার কারণে বিভিন্ন পরীক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য, ওষুধগুলো তো আমদানি করা হয়েছে। পরীক্ষা ছাড়া কি আমদানির সুযোগ আছে?
জানতে চাইলে কাউন্সিলর মোবারক আলী বলেন, উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তার বক্তব্যের আলোকে আবদুস সবুর লিটন ওষুধের ক্রয়মূল্য নিয়ে কথা বলেন। তখন স্বাভাবিকভাবে বর্জ্য স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি হিসেবে আমাকে বিষয়টি নিয়ে বলতে হয়েছে। আমরা যখন ওষুধ কিনি তার সঙ্গে ভ্যাট ও ট্যাঙও যুক্ত হয়। ফলে দাম বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া উনার বক্তব্য হচ্ছে টেন্ডার ছাড়া কেনা। এটাও তো সম্ভব না।
প্রধান প্রকৌশলীর ওপর ক্ষোভ প্রকাশ : কয়েকদিন আগে সরকারি একটি সংস্থা থেকে চসিকের কাছে এরিয়ার লিফট (বিশেষ যান) চেয়েছে। তখন প্রধান নির্বাহী খবর নিয়ে জানতে পারেন বিদ্যমান ১২টি এরিয়ার লিফটের সবকয়টি নষ্ট। গতকালের সাধারণ সভায় বিষয়টি নিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধান নির্বাহী। প্রধান প্রকৌশলী নতুন লিফট ক্রয়ে প্রকল্প রয়েছে জানালে প্রধান নির্বাহী বলেন, প্রকল্প অনুমোদন হতে সময় লাগবে। তাই বলে নষ্টগুলো মেইনটেনেন্স হবে না। প্রধান নির্বাহী এক পর্যায়ে গত ৮/৯ মাসে দৃশ্যমান কি কাজ হয়েছে প্রশ্ন তুলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। প্রধান নির্বাহী বলেন, মানুষ ট্যাঙ কেন দেবে। তারা দৃশ্যমান কাজ চায়।
সাইনবোর্ড না থাকা নিয়ে প্রশ্ন : উন্নয়ন প্রকল্প এলাকায় সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন ২৯ নং পূর্ব মাদাড়বাড়ী ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম মো. জোবায়ের। বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি আজাদীকে বলেন, কর্পোরেশন অনেক জায়গায় রাস্তার কাজ করছে। ওয়াসাও খোঁড়াখুঁড়ি করে। কিন্তু কোথাও সাইনবোর্ড দিয়ে কাজ চলার বিষয়টি জানানো হয় না। ফলে ওই রাস্তা দিয়ে লোকজন গিয়ে আটকে পড়েন। অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। জা্যম সৃষ্টি হয়। অথচ আগে থেকে সাইনবোর্ড দেখে জানতে পারলে লোকজন ওই সড়ক এড়িয়ে চলতে পারতেন।
মেয়রের বক্তব্য : সভায় মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, মশক নিধনের কার্যকর ওষুধ ছিটানোসহ নালা-নর্দমা ও ঝোপ-ঝাড়সমূহ পরিকল্পিত ও সঠিক তদারকির মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু করা হবে। তিনি যে সকল রাস্তা, গলি ও উপগলিতে খানা-খন্দের সৃষ্টি হয়েছে তা প্যাচওয়ার্কের মাধ্যমে সংস্কার করার নির্দেশনা দেন।
তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিতে যেখানে খাল, নালা মাটি ভরাট হয়ে জলজটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে স্থানগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। চলতি মৌসুমে মাটি উত্তোলনের জন্য প্রয়োজনে চসিকের জনবলের বাইরেও শ্রমিক নিয়োগ করতে হবে।
মেয়র বলেন, আমি পরিচ্ছন্ন নগরী দেখতে চাই। পরিচ্ছন্ন বিভাগে কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করার পরেও চট্টগ্রাম নগরী পরিপূর্ণভাবে পরিচ্ছন্ন নগরী হয়ে উঠতে পারেনি, যা কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, ফুটপাতগুলোকে যতবারই দখলমুক্ত করা হয়েছে তা ততবারই বেদখল হয়ে যায়। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রশাসনের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ হয়েছে। তারা আমাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে।
তিনি বলেন, নগরীতে সরকারের যে সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে সেগুলো যেন ঝুঁকি ও ঝামেলামুক্ত থাকে, নাগরিক নিরাপত্তা বিঘ্ন ও জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে না দাঁড়ায় এবং নির্বিঘ্নে কাজগুলো সম্পাদন হতে পারে সেজন্য সকল সেবা সংস্থার সমন্বয় অত্যাবশ্যক। শীঘ্রই নগরীর ফুটপাতগুলোকে অবৈধ দখলদারমুক্ত করে জন চলাচলে উপযুক্ত করা হবে বলে ঘোষণা দেন তিনি।
সভায় সিটি কর্পোরেশনের মার্কেট ও দোকানসমূহে প্রি-পেইড মিটার স্থাপন, আবাসিক এলাকায় অনুমতিবিহীন গেট ও স্ল্যাব অপসারণ, সৌন্দর্যবর্ধনে নীতিমালা প্রণয়ন, বাস-ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ, নগরীর সবুজায়ন উদ্ধারকরণসহ সাতটি রাস্তা সম্প্রসারণ, চসিক উন্নয়ন কাজ চলাকালে নির্ধারিত স্থানে সাইনবোর্ড স্থাপন, যান্ত্রিক বিভাগের গাড়িগুলো মেরামতের জন্য মাদারবাড়ীতে শেড তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগৌরবদীপ্ত বিজয়ের মাস শুরু
পরবর্তী নিবন্ধবাঁশখালী পৌরসভা নির্বাচন ১৬ জানুয়ারি