সূরা তীন’র ফযীলত ও বৈশিষ্ট্য
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন। আল্লাহর প্রতিটি সৃষ্টিতত্ত্বের গুরুত্ব ও রহস্য অনুধাবন করুন। তাঁর বৈচিত্রময় সৃষ্টিরাজির পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় তাঁর মহানত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করুন। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃষ্টিরাজি ও কুদরতী নিদর্শনাদি তাঁর ওহাদানিয়্যত তথা একত্ববাদের এক অভ্রান্ত দলিল। মহাপ্রভূর অনুপম সৃষ্টি তাঁর পরিচিতির দর্পণ।
সূরা তীন প্রসঙ্গ:
মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ৯৫ তম সূরা “তীন” মক্কী সূরা হিসেবে প্রসিদ্ধ। এ সূরার রুকু সংখ্যা এক, আয়াত সংখ্যা আট, শব্দ চৌত্রিশটি, বর্ণ একশ পাঁচটি।
সূরার অনুবাদ:
১. ডুমুরের শপথ ও যয়তুনের; ২. এবং সিনাই পর্বতের; ৩. এবং ঐ নিরাপদ শহরের; ৪. নিশ্চয় আমি মানুষকে সর্বোৎকৃষ্ট আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি; ৫. তারপর তাকে নিম্ন থেকে নিম্নস্তর অবস্থার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছি; ৬. কিন্তু যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের জন্য অফুরন্ত প্রতিদান রয়েছে; ৭. অত:পর কোন জিনিস তোমাকে শেষ বিচারের দিনটি অস্বীকার করার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে; ৮. আল্লাহ কি সব বিচারকের চেয়ে শ্রেষ্ঠতম বিচারক নন? (তরজমা: কানযুল ঈমান, সূরা: তীন, আয়াত: ১-৮)
সূরার আলোচ্য বিষয়:
১. তীন ও যাইতুনের আলোচনা, ২. সিনাই পর্বত ও পবিত্র মক্কা নগরীর আলোচনা, ৩. মানবজাতির সর্বোত্তম আকৃতি ও কর্ম ফলের আলোচনা, ৪. মু’মিনের সৎকর্মের অফুরন্ত প্রতিদানের আলোচনা, ৫. মহান আল্লাহই শ্রেষ্ঠতম বিচারক হওয়ার ঘোষণা।
তীন বা ডুমুর ফলের বৈশিষ্ট্য: প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু যর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট কিছু তীন বা আনজীর’র গুচ্ছ প্রেরণ করেছিলেন, নবীজি তা থেকে সামান্য আহার করলেন সাহাবাদের বললেন তোমরাও এখান থেকে কিছু খাও। কেননা জান্নাত থেকে কোন ফল যদি অবতরণ হয়ে থাকে এটাই হচ্ছে সেই ফল। (তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, পারা: ৩০, পৃ: ৯৩০)
তীন’র মর্মার্থ: তীন দ্বারা কি উদ্দেশ্য এ প্রসঙ্গে তাফসীরকারদের বিভিন্ন মত ও ব্যাখ্যা রয়েছে। তাফসীরে ইবনে কাছীরে আল্লামা ইসমাঈল ইবনে কাছীর (র.) উল্লেখ করেন, তীন, “যায়তুন” তুরে সীনীন ও “বালাদে আমীন” তিনটি জায়গার নাম, যেখানে আল্লাহ তা’আলা তিনজন প্রসিদ্ধ নবী প্রেরণ করেছেন। তীন ও যায়তুন দ্বারা বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্দেশ্য, যেখানে আল্লাহ তা’আলা হযরত ঈসা (আ.) কে প্রেরণ করেছেন। তুরেসীনীন দ্বারা সিনাই পর্বত উদ্দেশ্য, যে পর্বতে আল্লাহ তা’আলা হযরত মুসা (আ.)’র সাথে কথোপকথন করেছেন, বালাদে আমীন দ্বারা পবিত্র মক্কা নগরী উদ্দেশ্য, যেখানে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী ইমামুল আম্বিয়া রাহমাতুল্লীল আলামীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হয়েছেন। ইমাম কুরতুবী (র.) বলেন “তীন” দ্বারা আসহাবে কাহফের মসজিদ উদ্দেশ্য। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)’র বর্ণনামতে তীন দ্বারা জূদী পাহাড়ে অবস্থিত মসজিদে নূহ উদ্দেশ্য। (তাফসীরে ইবনে কাছীর)
হাদীস শরীফের আলোকে যায়তুন: হাদীস শরীফের বর্ণনার আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, যায়তুন বরকতময় গাছের নাম, এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহ তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা যায়তুনের ফল খাও এবং এর তৈল ব্যবহার কর, কারণ এটা একটা বরকতপূর্ণ বৃক্ষ। (মিশকাত, দারেমী, তিরমিযী, শামায়েলে তিরমিযী, পৃ: ১২৪)
যায়তুন একটা ফলদায়ক বৃক্ষের নাম ঐ বৃক্ষের ফলকেও যায়তুন বলা হয়। সিরিয়া দামেস্ক এবং এর আশে পাশে এ বৃক্ষ প্রচুর জন্মে থাকে। শীত প্রধান দেশেও এ গাছ পাওয়া যায়। যায়তুন তৈলে বহুবিধ উপকার সাধিত হয়। আবু নাঈম (র.) বলেন, এ তৈলে সওর প্রকার রোগের উপশম হয়। এ গাছ শুস্ক পর্বতসমূহে কোন প্রকার সেবা যত্ন ছাড়াই উৎপন্ন হয়। যায়তুন ফল ও তৈল দুটিই বিশেষ উপকারী এবং ফলদায়ক, হৃৎপিন্ড, মস্তিস্ক, এবং গুরুত্বপূর্ণ, অঙ্গ প্রত্যঙ্গের জন্য শক্তি বর্ধক, এর ফল ও তৈল খাদ্য ও ঔষধ দুটিই। আরব দেশে যায়তুনের তৈল ঘি’এর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়। সূরা নূর-এ যায়তুন বৃক্ষ কে “শাজারাতিম মুবারাকা” বা বরকতময় বৃক্ষ বলা হয়েছে। (সূরা: নূর, আয়াত: ২৫)
সূরা তীন ছাড়াও সূরা আবাসা, সূরা নাহল, এবং সূরা আনআমে, যায়তুনের আলোচনা এসেছে যায়তুন বৃক্ষ প্রায় হাজার বৎসর বাঁচে। মধ্য প্রাচ্যে এটি শান্তি সমৃদ্ধি সৌন্দর্য ও শক্তির প্রতীক ও নিদর্শন হিসেবে পরিচিত। এটি ঔষধ তৈরীতে কসমেটিক প্রস্তুতে সাবান তৈরীর কাজে ব্যবহৃত হয়। মানব সভ্যতার উন্নয়নে এ প্রাচীন বৃক্ষের ভূমিকা অপরিসীম। যায়তুন বৃক্ষ চল্লিশ বছর বয়সে ফলবান হয়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)’র বর্ণনা মতে এ গাছের প্রতিটি জিনিসই উপকারী ও ফলপ্রসূ। এর তৈল দিয়ে প্রদীপ জালানো যায়, খাওয়া যায়, চামড়া প্রক্রিয়াজাত করণের কাজে লাগে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং যায়তুন তৈল ব্যবহার করতেন।
নিরাপদ শহর: পবিত্র মক্কা নগরীকে নিরাপদ শহর বলা হয়েছে। এখানে শুধু মানুষ নয় বরং শিকারের পশু, বৃক্ষরাজি, গাছপালা পর্যন্ত নিরাপদ। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন আল আমীন, আমানতদার তথা (বিশ্বস্ত)। ওদিকে ইঙ্গিত করে নবীজির কারণে মক্কা নগরী শপথের উপযোগী হয়েছে। এ মক্কা শহরে হুযুরের সাথে আল্লাহর কথোপকথন হয়েছে ‘হুযুরের ওহী লাভ’ কুরআন অবতরণের সূচনা, মিরাজ তথা উর্ধ্বজগতে পরিভ্রমণ, দিদারে এলাহী অর্জন মক্কা মুআযযমায় হয়েছে। (তাফসীরে নূরুল ইরফান)
মানব জাতি সুন্দরতম সৃষ্টি: আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম আকৃতিতে। (সূরা: তীন:৪), মানব সৃষ্টিতে দৈহিক গঠন, আকৃতি, ওজন, মস্তিষ্ক, বাকশক্তি, বুদ্ধি বিবেচনা, সকল কিছুতেই ভারসাম্যপূর্ণ সামঞ্জস্য বিদ্যমান। মানুষের গঠন এক বিস্ময়কর বিষয়, এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তিনি আল্লাহ যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অত:পর তোমাকে সুবিন্যস্ত করেছেন, সুঠাম এবং সুসমঞ্জস্য করেছেন, তাঁর ইচ্ছামত তোমার আকৃতি তৈরী করেছেন। (সূরা: ইনফিতার, আয়াত: ৭-৮)
মানব দেহের আকৃতি ও গঠন শৈলী সুনির্দিষ্ট পরিমাপের উপর প্রতিষ্ঠিত, মানুষের দৈর্ঘ্য সাধারণত: ১ থেকে ২ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বর্তমান দৈর্ঘ্যের চেয়ে যদি দৈর্ঘ্য ২-৩ গুণ বেশী হতো তখন অবস্থা কি দাড়াত? এ অবয়ব ও পরিমাপ নির্ধারণ মহা প্রজ্ঞাময় প্রভূর প্রজ্ঞার সুস্পষ্ট উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু মুসা আশআরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা হযরত আদম (আ:) কে এক মুষ্টি মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, যা তিনি পৃথিবীর সমস্ত প্রান্ত থেকে গ্রহণ করেছিলেন এ কারণেই মানবাকৃতির রূপ ও রঙের ভিন্নতা রয়েছে। কেউ শেতাঙ্গ, কেউ কৃষ্ণাঙ্গ, কেউ ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের। (তাফসীরে ইবনে কাছীর, খন্ড: ১৫)
মানব সৃষ্টি আল্লাহর কুদরতের অনুপম সৃষ্টি: সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানব জাতির গঠন আকৃতি ও তার চেহারা এতই সুন্দর মনোরম যে জিন ও ফিরিস্তাও তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। প্রখ্যাত তাফসীরকার হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.) এ প্রসঙ্গে তাফসীরে নূরুল ইরফানে বর্ণনা করেন, মহান আল্লাহ মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে এমনভাবে সৌন্দর্যমন্ডিত সুবিন্যস্তরূপে সৃষ্টি করেছেন যেমনটি শোভা পায়। নাক হাতীর মতো লম্বা দেননি, পাখির ন্যায় অদৃশ্য রাখেন নি, শরীরের গঠনও এমনভাবে করেছেন যাতে কিয়াম, রুকু, সিজদা, ক্বা’দাহ্ বৈঠক তথা সমস্ত ইবাদতই সম্পন্ন করতে পারে।
অকৃতজ্ঞ বান্দারা জাহান্নামে যাবে:আয়াতে বর্ণিত হয়েছে মানুষকে এত সুন্দর ও সুঠামভাবে সৃষ্টি করা সত্বেও বান্দা যদি আল্লাহর নিয়ামতের মূল্যায়ন না করে অকৃতজ্ঞ হয় ঈমান গ্রহণ না করে কুফর শির্কে লিপ্ত থাকে নানাবিধ অপকর্মে নিয়োজিত হয় তখন তাকে নিম্ন থেকে নিম্নস্তরে নিক্ষেপ করবে অর্থ্যাৎ মানুষ হয়ে জানোয়ার থেকেও নিকৃষ্ট, জাহান্নাম হবে তার ঠিকানা। ঈমানের দাবী অনুসারে যারা সৎ কর্ম সম্পাদন করবে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে শরয়ী বিধি বিধান মেনে চলবে তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত প্রতিদান অর্থাৎ তারা চিরস্থায়ী সুখময় জান্নাতে প্রবেশ করবে।
বিচার দিবসকে অস্বীকার করা কুফরী: মহান সত্তা যিনি অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন, মানব জাতিকে পুনরূজ্জীবন দান করা তাঁর পক্ষে মোটেই অসম্ভব নয়। অতএব হে কাফিররা! কিয়ামত সংঘটিত হওয়া ও সকলের হিসাব নিকাশ হওয়া কী ভাবে তোমরা অস্বীকার করবে?
সূরার সমাপ্তিতে মহান আল্লাহ শ্রেষ্ঠতম বিচারক’র পরিচয় বিঘোষিত হয়েছে, সেদিন তাঁর মহান আদালতে প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মফল ভোগ করবে কারো প্রতি অবিচার হবেনা।
সূরা তীন’র শেষ আয়াতের গুরুত্ব: হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন কেউ যখন সূরা তীন’র শেষ আয়াত “আলাইসাল্লাহু বে আহকামিল হাকেমীন” পড়বে, সে যেন বলে “বা’লা ওয়াইন্না আলা যালিকা মিনাশ শাহেদীন”, হ্যা আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহর চাইতে কোনো বড় বিচারক নেই।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে এ বরকতময় সূরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বুঝার তাওফিক দান করুন। আমীন।
অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম।
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন
আমান বাজার, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।